ছবি সংগৃহীত

লন্ডনি কইন্যা-দামানের মোহনীয় প্রতারণার শিকার হচ্ছে যুবক-যুবতী

priyo.com
লেখক
প্রকাশিত: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪, ০৩:৪৪
আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪, ০৩:৪৪

(প্রিয়.কম) সিলেটে বিপুলসংখ্যক যুবক-যুবতী বিয়ে করে যুক্তরাজ্যে যাওয়ার আশায় লন্ডনি দামান-কইন্যার প্রতারণার জালে আটকা পড়ে সর্বস্ব খুইয়েছেন। এ ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। সিলেটে স্থানীয়ভাবে বরকে 'দামান' আর কনেকে 'কইন্যা' বলা হয়। সহজে যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্ব পাওয়া বিবাহযোগ্য যুবকদের বলা হয় লন্ডনি দামান আর তরুণীদের বলা হয় লন্ডনি কইন্যা। এই লন্ডনি দামান ও কইন্যা নিয়ে সিলেটে ঘটেছে নানা অঘটন। অনেকেই এমন প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে হারিয়েছেন অর্থ, সম্পদ এমনকি সম্মানও। এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দৈনিক যুগান্তর। যুগান্তর প্রতিবেদনে জানা গেছে, লন্ডনি কইন্যা হিসেবে বিয়ের পর বাসরঘরে গিয়ে দেখা গেছে কাক্ষিত সেই কন্যা নেই। আবার বর যুক্তরাজ্যের সিটিজেন বলে বিয়ে ঠিক করার পর বিয়ের আসর থেকে প্রতারণার অভিযোগে বর গ্রেফতার হয়েছেন- এমন ঘটনা ঘটছে অহরহ। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের রেকর্ড থেকে এ ধরনের প্রতারণার বেশ কয়েকটি ঘটনা জানা গেছে। কিছু প্রতারণার চিত্র প্রতিবেদনে একটি ঘটনার উল্লেখ থেকে জানা গেছে, সিলেটের বিয়ানীবাজারের চরিয়া গ্রামের খোরশেদ হন্য হয়ে খুঁজছিলেন লন্ডনি কন্যা। তার উদ্দেশ্য ছিল বিয়ের পর লন্ডনে পাড়ি জমানো। লন্ডনি কইন্যা পাওয়ার জন্য তিনি অনেক টাকা-পয়সাও দেদারসে খরচ করেন। অবশেষে তিনি এক সুন্দরী তরুণীর সন্ধান পান। যিনি যুক্তরাজ্যের নাগরিক। নাম তার চাঁদনী। খোরশেদের সঙ্গে চাঁদনীর বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু অঘটন ঘটে বিয়ের দিন। বিয়ের আসরে বসে বর পক্ষের মুরব্বিরা তরুণীর পাসপোর্ট দেখতে চাইলে ঘটে বিপত্তি। বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। প্রতারণার দায়ে বিয়ের আসর থেকে কথিত লন্ডনি কন্যা চাঁদনী, তার বান্ধবী রেনু বেগম ও কনে পক্ষের অভিভাবক সোহেলকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তারা সবাই বিয়ানীবাজার উপজেলার পাতন গ্রামের বাসিন্দা। প্রতিবেদনে আরেকটি ঘটনার উল্লেখ থেকে জানা গেছে, পুলিশের খাতা থেকে আরেকটি ঘটনার সন্ধান পাওয়া গেছে। সেটি ছিল মৌলভীবাজারের শেরপুরে। লন্ডনি কইন্যার সন্ধানে স্থানীয় ঘটক পাখি ভাইকে ৮ লাখ টাকা দিয়েছিলেন হবিগঞ্জের বাহুবলের ব্যবসায়ী আবদুস সালাম। ঘটকের দাবি মেটাতে তিনি বসতভিটাও বিক্রি করেন। তারও উদ্দেশ্য ছিল একটাই- লন্ডনি কইন্যাকে বিয়ে করে যুক্তরাজ্যে স্থায়ী বসবাসের অনুমতি পাওয়া। অথবা যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্ব পাওয়া। পাত্রের কাছ থেকে ৮ লাখ টাকা নিয়ে ঘটক পাখি ভাই জেসমিন নামে এক কথিত লন্ডনি তরুণীর সঙ্গে সালামের বিয়ে ঠিক করেন। বিয়ের কথাবার্তা পাকাপাকি হওয়ার পর কনে দেখার ব্যবস্থাও করেন এই ঘটক। কনে দেখে চোখ জুড়িয়ে যায় সালামের। তিনি নগদ ১০ হাজার টাকা ও সোনার আংটি পরিয়ে দেন কনেকে। কিন্তু বাসরঘরে গিয়ে সালাম হতবাক। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে তার। তিনি দেখতে পান বাসরঘরে যিনি শয্যাসঙ্গী হওয়ার অপেক্ষায় বসে আছেন, তিনি তার বিবাহিত স্ত্রী জেসমিন নন। বাসরঘরে বসে আছেন অপরিচিত আরেক তরুণী। এ ব্যাপারে বাহুবল থানায় মামলা করেন আবদুস সালাম। আসামি করেন ঘটক পাখি ভাই ছাড়াও তার সহযোগী দুদু মিয়া, আলী আজগর ও আলতাফ আলীকে। এছাড়া পুলিশের রেকর্ড থেকে জানা যায়, লন্ডনে যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে শেলী নামের কথিত যুক্তরাজ্যের নাগরিক এক যুবতীকে বিয়ে করেন সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার ইদ্রিস আলী। তিনি মঙ্গলগিরি গ্রামের মৃত ফজর আলীর ছেলে। কনে জগন্নাথপুর উপজেলার ফাতেমা আক্তার শেলী। তার পিতা হাসান ফাতেমাপুর গ্রামের লুৎফুর রহমান। লন্ডনি কইন্যা পরিচয়ে শেলীর এর আগেও একবার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু সে কথা ইদ্রিস আলীর কাছে গোপন রাখে শেলীর পরিবার। লন্ডনি কইন্যা হিসেবে শেলীর সঙ্গে ইদ্রিসের দ্বিতীয় দফা বিয়ে দিয়ে ১৩ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় শেলীর পরিবারের লোকজন। এই অভিযোগে জগন্নাথপুর থানায় মামলা হলে ভুয়া লন্ডনি কন্যা শেলীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পুলিশের খাতা থেকে আরেকটি ঘটনার কৌতূহলোদ্দীপক বর্ণনা পাওয়া যায়। শুধু প্রবাসী কন্যা নয়, প্রবাসী বর নিয়েও প্রতারণা ঘটনার কথা জানা গেল এবার। ঘটনাটি ঘটেছে ছাতকে। লন্ডন প্রবাসী শ্যালক মোহাম্মদ আলীর বিয়ের কথা বলে কনে খোঁজ করছিলেন ইসলাম উদ্দিন। পাত্রী খোঁজার নামে এবাড়ি-ওবাড়ি দাওয়াত খেয়েও বেড়িয়েছেন দীর্ঘদিন। কল্যাণপুর গ্রামের আফতাব উদ্দিনও খুঁজছিলেন লন্ডন প্রবাসী পাত্র। ইসলাম উদ্দিন ও আফতাব উদ্দীনের চাওয়া মিলে যায়। তাই উভয়েই বিয়ে দেয়ার জন্য রাজি হন। এই সুযোগে কনে পক্ষের কাছ থেকে অগ্রিম ৫ লাখ টাকা নেন ইসলাম উদ্দিন। টাকা নিয়ে বিয়ের তারিখও ঠিক করে যান ইসলাম। তারিখ অনুযায়ী বিয়ে বাসর প্রস্তুত করা হয়। কিন্তু বরের দেখা আর নেই। একই উপজেলার নোয়াগাঁওয়ে বর পক্ষের কাছে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা যায়, তারা এই বিয়ের খবরের কিছুই জানতেন না। সবই হচ্ছে দুলাভাই ইসলাম উদ্দিনের কারসাজি। লন্ডনি বর পরিচয়ে প্রতারণার আরেকটি ঘটনা ঘটেছে সিলেটের কানাইঘাটে। কানাইঘাটের মৃত মইন উদ্দিনের ছেলে আবদুল কুদ্দুছ নিজেকে যুক্তরাজ্যের নাগরিক বলে পরিচয় দিয়ে বেড়াতেন। ছাতকের গোয়ালগাঁওয়ের মনি বেগমের পরিবারে তিনি নিজেকে লন্ডনি বর হিসেবে পরিচয় দেন। এক পর্যায়ে বিয়ের প্রস্তাব দেন মনিকে। লন্ডনি বর শুনে তারাও রাজি হয়ে যান। পরে সিলেট নগরীর দরগাহ গেটে এক ভুয়া কাজীর কাছে বিয়ে পড়ানো হয় মনির। এতে দেনমোহর ধরা হয় ১০ লাখ টাকা। এই কারসাজিতে কুদ্দুছের সঙ্গে ছিল গিয়াস ও আমির নামের দুজন। বিয়ের ঠিক ৭ দিনের মাথায় কুদ্দুছের আসল পরিচয় বেরিয়ে আসে। শ্বশুরবাড়ি ও গ্রামের লোকজন কুদ্দুছকে ধরে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করে। পুলিশে সোপর্দের পর তার বিরুদ্ধে আরও প্রতারণার অভিযোগ উঠে আসে। অভিযোগ পাওয়া যায়, বিদেশ পাঠানোর নামে কুদ্দুছ টাকা লুটে নিয়েছেন ছাতকের আবদুল মান্নান, রজব আলী, ইমরান আহমদ ও সিলেটের ডালিমের কাছ থেকে। পুলিশ পাত্রীপক্ষকে জানায়, কুদ্দুছ আসলে বিয়ের ঘটকালি করেন এবং আদম ব্যবসায়ী। প্রশাসনের বক্তব্য এবং সাবধানতা লন্ডনি বর-কনের নামের প্রতারণার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) রহমতুল্লাহ বলেন, সিলেটের অনেক মানুষ লন্ডন প্রবাসী। তাই লন্ডনি পরিচয় দিয়ে প্রতারণার ঘটনা ঘটছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে প্রতারিত হওয়ার পরও অনেকে এ বিষয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ নিয়ে আসে না। পুলিশ নিজের উদ্যোগের এ ধরনের বেশ কয়েকটি ঘটনা আমলে নিয়ে তদন্ত করছে। এ ধরনের প্রতারণার ঘটনা যাতে কম ঘটে এজন্য পুলিশের পক্ষ থেকে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।