ছবি সংগৃহীত

মারাত্মক সেই প্রাচীন বিষ -হেমলক

Md. Rezaul Karim
লেখক
প্রকাশিত: ০৮ মার্চ ২০১৪, ০৫:৫৫
আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৪, ০৫:৫৫

হেমলক বিষে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে আলোচিত মৃত্যুর ঘটনাটি ঘটে খ্রিস্টপূর্ব ৩৯৯ সালে। মহান শিক্ষক ও গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসকে প্রহসনের বিচারে দেয়া হয় মৃত্যুদন্ড! রায়ে বলা হয়, মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হবে হেমলক বিষ পান করিয়ে। মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার দিন, সক্রেটিসের হাতে তুলে দেয়া হয় এক পেয়ালা হেমলক বিষ। সক্রেটিসকে বলা হয়, পেয়ালার বিষ পুরোটুকু পান করতে হবে। এক ফোঁটা বিষও যাতে পেয়ালার বাইরে না পড়ে। সক্রেটিস ধীরস্থিরভাবে এক চুমুকে সবটুকু বিষ পান করেন। এবার সক্রেটিসকে নির্দেশ দেয়া হল, রুমের ভেতরে হাঁটাহাঁটি করার জন্য, যাতে করে বিষ সমস্ত শরীরে ভালোভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

সক্রেটিস কিছুক্ষণ পায়চারি করলেন। তার পা দুটি অবশ হয়ে আসতে লাগলো। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো। সারা দেহ অবশ হয়ে কিছু সময়ের মাঝেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। মানুষের মাঝে থেকে পতন হল এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের! মহান সক্রেটিসকে যে হেমলক বিষ পান করানো হয়েছিল সেটি ছিল হেমলক গাছের রস। গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম Conium maculatum. আইরিশরা এই গাছকে ডাকে Devil’s bread নামে, মানে ‘শয়তানের পাউরুটি’! হেমলক দ্বিবর্ষজীবী গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। ঝোপ জাতীয় উদ্ভিদ। পাঁচ থেকে আট ফুট লম্বা হয়। ছোট ছোট সাদা রঙ্গের ফুল হয়। ভেজা, স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় জন্মে। নালার কাছে, নদীর ধারে এদেরকে বেশী দেখা যায়। ইউরোপ, পশ্চিম এশিয়া, উত্তর আমেরিকা, উত্তর আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড-এ হেমলক বেশী জন্মে। হেমলক গাছ পুরোটাই বিষাক্ত। পাতা, ফুল, ফল, কান্ড, শিকড়- সবটা জুড়েই কোনিইন (Coniine) নামক বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান ছড়িয়ে আছে। কোনিইন হচ্ছে বিষাক্ত অ্যালকালয়েড। এর রাসায়নিক সংকেত C8H17N. কোনিইন নিউরোটক্সিন জাতীয় বিষ। এটি আক্রান্ত প্রাণীর দেহের স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণ করে। কোনিইন মূলত প্রাণীদেহের ‘নিউরো-মাসকুলার জাংশন’-কে ব্লক করে দেয়। যে সব তন্তু স্নায়ুর সাথে পেশীর সংযোগ স্থাপন করে সেগুলোকে নিউরো-মাসকুলার জাংশন বলে। নিউরো-মাসকুলার জাংশন ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় স্নায়ুর সাথে পেশীর সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে, পেশীকোষ প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়। শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে যেসব পেশী যুক্ত সেগুলোও প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হওয়ায় আক্রান্ত প্রাণীর শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। হৃদপিন্ড ও মস্তিষ্কে প্রয়োজনীয় পরিমাণ অক্সিজেন সরবরাহ না হওয়ায় আক্রান্ত প্রাণী দ্রুত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। হেমলক উদ্ভিদ মানুষসহ অন্য যে কোন প্রাণীর জীবনের জন্য হুমকি। বিশেষ করে তৃণভোজী প্রাণী ও বীজ ভক্ষণকারী পাখিরা হেমলকের বিষে আক্রান্ত হয়ে অনেক সময়ই মারা যায়। হেমলকের ছয় থেকে আটটি পাতায় যে পরিমান বিষ আছে তা কোন মানুষের দেহে প্রবেশ করানো হলে মৃত্যু অনিবার্য! হেমলকের রস পান করে মহান দার্শনিক সক্রেটিসের মৃত্যু পৃথিবীব্যাপী হেমলক বিষকে পরিচিত করে তুলেছে। শেক্সপিয়ার তার কিং লেয়ার, হ্যামলেট ও ম্যাকবেথ নাটকে হেমলক বিষের কথা উল্লেখ করেছেন। সারা পৃথিবীজুড়ে অনেক টিভি সিরিয়াল ও সিনেমার কাহিনীতে হেমলক বিষ ব্যবহার করা হয়েছে। কলকাতার পরিচালক শ্রীজিৎ ব্যানার্জি ২০১২ সালে ‘হেমলক সোসাইটি’ নামে একটি সিনেমা নির্মাণ করেন। ইংরেজ কবি জন কিটস তার ‘Ode to a Nightingale’ কবিতায় হেমলকের কথা উল্লেখ করেছেন- "My heart aches, and a drowsy numbness pains My sense, as though of hemlock I had drunk"