ছবি সংগৃহীত

বিপর্যয়ের মুখে সামুদ্রিক প্রবাল প্রাচীর

জুলকারনাইন মেহেদী
লেখক
প্রকাশিত: ১৬ আগস্ট ২০১৩, ১০:২৯
আপডেট: ১৬ আগস্ট ২০১৩, ১০:২৯

সমুদ্রের তলদেশে প্রবাল পাথরের যে স্তর আছে তাকে সমুদ্র তলদেশের সবচেয়ে উৎপাদনশীল এলাকা বলা হয়। কারণ প্রতিটি প্রবাল পাথরের গায়ে অতি ক্ষুদ্র শৈবাল জন্মায়। এই শৈবাল সমুদ্রের তলদেশে আসা সূর্যের আলো থেকে শক্তিগ্রহণ করে ও খাদ্য উৎপাদন করে এর উপর নির্ভর করেই সমুদ্রের ঐ স্থানের অন্যান্য প্রাণীরা বেঁচে থাকে। এ এক জটিল খাদ্য চক্র বা খাদ্য জাল যাতে এক প্রাণী আরেক প্রাণীর উপর খাবারের জন্য নির্ভরশীল। আর জটিল এই খাদ্য চক্রে সমুদ্রের প্রবাল পাথরের স্তর এক গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু জেনে অবাক হবেন, এই প্রবাল স্তর পৃথিবীর সমুদ্রতলের মাত্র ১ শতাংশ জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। কিন্তু এর থেকে প্রায় ২৫% সামুদ্রিক প্রাণী তাদের জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সংগ্রহ করে। শুধু সামুদ্রিক প্রাণীই নয়, এই প্রবাল প্রাচীর একই সাথে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকার উৎস। সমুদ্র উপকূলবর্তী অনেক গ্রাম রয়েছে যাদের অধিবাসীদের গভীর সমুদ্রে গিয়ে মাছ ধরার মতো সরঞ্জাম নেই। তাদের খাবারের একমাত্র উৎস এই সামুদ্রিক প্রবাল পাথরের স্তর বা প্রবাল প্রাচীর। এছাড়াও এই প্রবাল প্রাচীর স্থানীয় মানুষদেরকে ঘূর্নিঝড় বা জলোচ্ছ্বাস থেকে নিরাপদ রাখে। আশঙ্কার বিষয় হলো , পৃথিবী ব্যপী এই প্রবাল প্রাচীরের আয়তন উল্লেখ্যযোগ্য হারে কমে যাচ্ছে। একদিকে প্রাচীরের কাছাকাছি বসবাসকারী মানুষের অতিরিক্ত মাছ ও প্রবাল আহরণ করা, আরেকদিকে সমুদ্রে বিভিন্ন বিশাল বিশাল মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত আন্তর্জাতিক জাহাজের ক্রমাগত চলাচল বেশিরভাগ প্রবাল প্রাচীরকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। এছাড়া পৃথিবীর জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত সমস্যা তো আছেই। এই অবস্থায় এই প্রবাল প্রাচীরগুলোকে রক্ষা করা এখন সময়ের দাবী। গবেষকরা দেখেছেন, এক সময়ে সবুজে সবুজে পরিপূর্ণ এই প্রবাল প্রাচীরগুলো দিন দিন কংক্রিটের রাস্তার মত হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ প্রবালের উপরে শৈবাল জন্মানোর পরিমাণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। এরকম হতে থাকলে সমুদ্র তলদেশের বিভিন্ন প্রাণীর সাথে সাথে এই প্রবাল প্রাচীর এলাকার মানুষের জীবনও হুমকির মুখে পড়বে । ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত সামুদ্রিক প্রবাল প্রাচীরের ক্ষয় খুব বেশি হয় নি। কিন্তু এরপর থেকে এটি ভয়াবহভাবে বেড়ে যায়। ২০০৫ সালে অবস্থা মারাত্মক আকার ধারণ করে যখন আটলান্টিক ও ক্যারিবিয়ান সমুদ্র থেকে আসা উষ্ণ সমুদ্র স্রোত এই প্রবাল প্রাচীরগুলোতে আছড়ে পড়ে ব্যপক ক্ষতিসাধন করে। ২০১০ সাল পর্যন্ত এই ক্ষয় ক্রমবর্ধমান। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন,এভাবে চলতে থাকলে পুরো পৃথিবী থেকে ২০৫০ সালের মাঝে প্রবাল প্রাচীর বিলুপ্ত হয়ে যাবে। অতএব , নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও গবেষকরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন কিভাবে এই সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব। গবেষণা বলছে , সমুদ্রের যেসব স্থানে অম্ল বা এসিডের পরিমাণ বেশি সেসব স্থানে প্রবাল প্রাচীরের ক্ষয় বেশি হয়। এ তথ্য থেকে অনেকে প্রস্তাব করেছেন প্রবাল প্রাচীর এলাকায় সমুদ্রের পানিতে চুনের পানি মেশানো যেতে পারে। চুনের পানি বা লাইম এর বাইকার্বোনেট পানির অম্ল ভাব কমিয়ে দিতে সাহায্য করবে। কিন্তু এটা করতে হলে প্রতি বছর আমাদের ৯০০০ মিলিয়ন টন লাইম সমুদ্রের পানিতে ঢালতে হবে যেখানে সারা পৃথিবীরে এর বার্ষিক বাণিজ্যিক উৎপাদন মাত্র ৩০০ মিলিয়ন টন। শেষ উপায় হিসেবে থাকে কৃত্রিম ভাবে প্রবালের বংশবৃদ্ধি করা। এটাকে অনেকটা প্রবাল চাষ করাও বলা যেতে পারে। বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন এরকম প্রবাল উৎপাদন করতে যা বিভিন্ন বিরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিয়ে পারবে। এটা করার পরের ধাপ হলো,প্রবাল গুলোকে সমুদ্রের তলদেশে স্থাপন করা । এবং সব শেষ এগুলোর বৃদ্ধি যেন ঠিক থাকে সেই ব্যবস্থা করা। একটা চমকপ্রদ বিষয় হচ্ছে , প্রবালকে বিদ্যুতের সংস্পর্শে আনা হলে আর বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়। মালদ্বীপের অনেক গুলো দ্বীপের একটি ভ্যাবিনফারু দ্বীপে সমুদ্রের নিচে প্রবাল প্রাচীরে কাছাকাছি এক বিশাল লোহার আবরণ স্থাপন করা হয়েছে , যার নাম দেয়া হয়েছে লোটাস। এই লোহার কাঠামোতে এক বিশেষ ধরণের তার স্থাপন করা হয়েছে যা থেকে অতি নিম্ন মাত্রার বিদ্যুৎ সমুদ্রের পানিতে প্রবাহিত হয় ফলে পানি থেকে ক্যালসিয়াম কার্বনেট এসে ঐ লোহার কাঠামোতে এসে জমা হয় এবং নিচের প্রবালগুলোকে রক্ষা করে । বিজ্ঞানীরা আশা করছেন এই পদ্ধতিতে হয়তো সমুদ্রের বিলুপ্ত হবার পথে থাকা প্রবাল প্রাচীর গুলোকে রক্ষা করা সম্ভব হবে ।