ছবি সংগৃহীত

বাদশাহ-মাশরাফি এবং রাতের অস্টিন

debbrata
লেখক
প্রকাশিত: ২৭ মার্চ ২০১৫, ০৬:২৬
আপডেট: ২৭ মার্চ ২০১৫, ০৬:২৬

গভীর রাতের ঢাকাকে এই আমাদের চেনাজানা শহর বলে মনে হয় না। আবছায়া আলো, অচেনা নির্জনতা মিলিয়ে যেন কোনো এক মায়াবী জগৎ বলে বিভ্রম হয়। এই বিভ্রমে পড়ে কতো মানুষ হারিয়ে যায়! হাতির ঝিলে ঢুকতেই বাদশাহ ভাই বললেন, ‘চলো একটা চক্কর দিয়ে তারপর বের হই।’ আস্তে আস্তে ছুটছে বাদশাহ ভাইয়ের বিলাসবহুল গাড়ি; সবগুলো জানালার কাচ নামানো, হু হু করে ঢুকছে বাতাস; বাতাসে তির তির করে কাঁপছে বাদশাহ ভাইয়ের মাথার চুল। স্টিয়ারিং ধরে বসে থাকা ভঙ্গি দেখে মনে হয় কোনো তেইশ বছর বয়সী যুবকের সঙ্গী হয়েছি। মাঝে মাঝেই গাড়ির গতিটা একটু বাড়িয়ে যৌবনের জানান দিচ্ছেন। ‘যুবক’ বাদশাহ ভাইকে কথাটা বলতেই তীব্র প্রতিবাদ করে উঠলেন, ‘ওহ নো। আমাকে আর যুবক বলো না। আই’এম অ্যাট সিক্সটি ফাইভ নাউ। আমি বুড়ো হয়ে গেছি।’ কোনো আপত্তিতে কাজ হলো না। বাদশাহ ভাই নিজেকে ‘বুড়ো’ বলে প্রমান করার চেষ্টা চালিয়েই গেলেন। শুধু একটা ব্যাপার শুধরে দিলেন, ‘আমি বুড়ো হয়েছি বটে, ঈর্ষাকাতর হইনি। সে অর্থে আমাকে ক্ল্যাসিক বুড়ো বলতে পারো না। আমি তোমাদের, যুবকদের দেখে ঈর্ষা করি না, আমার ভালো লাগে। বরং আমার মনে হয়, আমি এখনও সবই পারি। সে অর্থে আমি বুড়ো নই।’ হ্যা, তিনি বুড়ো নন; তিনি চির যুবক। তিনি জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাহ। কারো কারো মতে বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ফাস্ট বোলারদের একজন, জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাহ। দ্য অ্যংরি ইয়ংম্যান জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাহ। বাদশাহ ভাইয়ের নাম না শোনাটা আমাদের ক্রিকেটভক্তদের জন্য কোনো মনীষির নাম নাম শোনার মতো অপরাধ। ছোটবেলা থেকে বাদশাহ ভাইয়ের নাম, বাদশাহ ভাইয়ের গল্প শুনেছি। কলার উচু করে রানআপে যাওয়া বাদশাহ, ‘খোমার কাছ থেকে’ বল পাঠিয়ে দেওয়া বাদশাহ। কিন্তু ঘটনাচক্রে বাদশাহ ভাইয়ের সঙ্গে গতকালকের আগে কখনো আলাপের সুযোগ হয়নি। দু চার বার দুর থেকে দেখেছি, কথা হয়নি। গতরাতে একটা অনুষ্ঠানে পরিচয় হলো। ফেরার সময় যার যার পথ ধরবো, এমন সময়ে তিনি নিজেই এগিয়ে এসে বললেন, ‘দেবু, বাসা কোথায়?’ উত্তর দিলেই গটমট করে বললেন, ‘ওকে, কাম উইথ মি। আমি তোমাকে পৌছে দেব।’ ভেবেছিলাম, ওনার ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে এসেছে। ওমা! এই বয়সে বাদশাহ ভাই নিজেই ঝা চকচেকে একটা গাড়ি ড্রাইভ করা শুরু করলেন। একটু যে ভয় পাইনি, সেটা বলা ঠিক হবে না। বাদশাহ ভাই বুঝতে পারলেন। স্টিয়ারিং ছেড়ে পকেটে হাত পুড়ে প্যাকেট বের করতে করতে বললেন, ‘ভয় পাচ্ছো? আই’ম ড্রাইভিং ফ্রম সিক্সটি ফোর। স্টিল আমি অন্য কারো ড্রাইভিংয়ে কমফোর্ট ফিল করি না।’ ভয়টা একটু কমলো। সেটা বলার আগেই মুখটা তার একটু বিকৃত হয়ে গেল। নাকটা বাকা করে বললেন, ‘অবশ্য এইসব খেলনা গাড়ি চালাতাম না। আই ইউসড টু ড্রাইভ আ মিনি অস্টিন। আহ। দ্যাট ওয়াস আ কার!’ হঠাৎ মনে হল, ইংল্যান্ডের কোনো এক কাউন্টির রাস্তা ধরে একটা অস্টিনে করেই ছুটে চলেছি। ড্রাইভিং সিটে বসা বুঝি ডব্লু জি গ্রেসের জেন্টেলমেন দলের কোনো এক সদস্য। পুরো পরিবেশটা থেকে সে কালের ব্রিটিশ ক্রিকেট ঠিকরে বের হচ্ছে। আমি ঢেকি। এমন স্বর্গেও একটু ধান বানতে ইচ্ছে হলো। একটু চাপা স্বরে বললাম, ‘বাদশাহ ভাই, বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা পেস বোলার কে? বাদশাহ, নাকি মাশরাফি?’ ‘ওহ। আই ডোন্ট নো। আই ডোন্ট নো। বাট আই ওয়াস নট আ জেনুইন ফাস্ট বোলার। অ্যাটলিস্ট এই মরা উইকেটে গতির ঝড় তোলার ইচ্ছে আমার ছিলো না। হ্যা, ইংল্যান্ডে অনেক জোরে বল করেছিলাম। তবে জানি না, কে বেস্ট।’ ‘তারপরও লোকেরা তো জানতে চায়।’ ‘কী জানতে চায়? কে সেরা?’ ‘হ্যা’। ‘সেরা কী শুধু বোলিং দিয়ে হয় নাকি? সেরা হয় অনেক কিছু মিলিয়ে। আর সে সেরা মাশরাফি।’ ‘কেন?’ ঘ্যাচ করে ব্রেক কষলেন বাদশাহ ভাই; সামনে একটা ট্রাক। আমার দিকে একটু রাগত্ব একটা দৃষ্টি হেনে বললেন, ‘মাশরাফি ইস আ বর্ন লিডার, বর্ন ফাইটার। তুমি কল্পনা করতে পারো, একজন উন্ডেড সোলাজার একটা পুরো সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছে যুদ্ধে! তাও আমার সামনে দাড়িয়ে! হি হ্যাস সেভেন বুলেটস ইন হিজ দু লেগ। কী অবিশ্বাস্য।’ আমি তাও থামি না, ‘তাহলে মাশরাফিকে আপনি উন্ডেড সোলজার হিসেবেই এগিয়ে রাখছেন।’ ‘ওহ নো। তুমি বুঝতে পারোনি। মাশরাফি তার জীবনে কখনো পুরোটা দিয়ে খেলতে পারলো না। তাতেই সে সর্বকালের সেরাদের একজন। যদি পুরোটা দিত, বাকীদের নামই তো শুনতে না। সে সেরা। কোনো সন্দেহ ছাড়াই সেরা।’ ‘নেতা মাশরাফির কথা বলছিলেন?’ ‘ইয়েস। আমার মতে বেস্ট এভার ক্যাপ্টেন বাংলাদেশ গট। তুমি দেখেছ, প্রতিটা খেলোয়াড় কেমন মাশরাফি ভাই, মাশরাফি ভাই করে। এটা কী এমনি হয়? আমরা তো কতো ক্যাপ্টেন দেখলাম। এরকম ক্যাপ্টেন দেখিনি। পুরো দল যেন ওর সন্তান। আমি মুগ্ধ ছেলেটার ব্যাপারে। আমার সঙ্গে তুলনা করো না।’ প্রায় আমার বাসার কাছে চলে এসেছি। আরেকটা প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছিল, ‘বাদশাহ ভাই, ক্রিকেট কী এগিয়েছে?’ ‘অবশ্যই। হেটাররা অনেক কিছু বলবে। বুড়োরা বলবে, তারা সেরা ছিল। কিন্তু বাস্তবতা হল, এখনকার ক্রিকেট অনেক এগিয়েছে। দেখ, স্কিলফুল ক্রিকেটার যুগে যুগে আসে-যায়। কিন্তু এরা আধুনিক ক্রিকেট খেলে, সর্বোচ্চ পর্যায়ে লড়াই করে। বাংলাদেশ এগোচ্ছে দেবু, এগোচ্ছে।’ নেমে পড়লাম। আমার অস্টিনযাত্রা শেষ। বাদশাহ ভাই পেছন থেকে ডাক দিলেন, ‘দেবু, আমি সবসময় তারুন্যের পক্ষে। আমি বিশ্বাস করি, তরুনরা সবসময় এগিয়ে থাকে। তাই তরুনদের পক্ষে কথা বলি। আমি সেকেলে বুড়ো নই।’ শেষ বেলায় বাদশাহ ভাইকে আরেকবার চটানোর জন্য বললাম, ‘বাদশাহ ভাই, আপনার বয়স তেইশ।’ গাড়ি আবার ছুটতে শুরু করলো। রাস্তার পাশে দাড়িয়েই তরুন বাদশাহ ভাইয়ের হাসিটা শুনতে পেলাম। বাদশাহ ভাই তার অস্টিন নিয়ে ছুটছেন কোনো কাউন্টি ক্লাবের দিকে।