ছবি সংগৃহীত
বাঙ্গালী নারীরা রূপচর্চা নিয়ে সচেতন, শরীর নিয়ে নয় : আনুজা সাইডেল
আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০১৫, ১৩:০০
(প্রিয়.কম) আনুজা সাইডেল- পড়াশুনা করেছেন ফিনল্যান্ড ও জার্মানীতে। শিক্ষার্থী থাকা অবস্থাতেই তিনি মেয়েদের অন্তর্বাস নিয়ে কাজ করার কথা ভেবেছিলেন। দেশে তখন মেয়েদের আন্ডার গার্মেন্টেস বিক্রি হতো ঠিকই, তবে সেই সব দোকানে থাকতো পুরুষ সেলসম্যান। এমন পরিস্থিতি থেকেই তিনি চিন্তা করেন, যদি মেয়েদের অন্তর্বাসের দোকানগুলোয় মেয়ে কর্মী রাখা হয় তাহলে সবাই নিঃসঙ্কোচে কেনাকাটা করতে পারবে। সেই ভাবনা থেকেই শুরু।
দেশে এসে গড়ে তোলেন ‘সুইট ড্রিমস’। ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হতে শুরু করে এই প্রতিষ্ঠান। এক থেকে দুই- দুই থেকে তিন- এভাবেই এগিয়ে যেতে থাকে দেশের প্রথম মেয়েদের আন্ডার গার্মেন্টসের প্রতিষ্ঠান ‘সুইট ড্রিমস’। মাঝে তার ব্যবসায়িক পার্টনার আলাদা হয়ে চলে যান। কিন্তু কোন বাধাই দমাতে পারেনি আনুজা সাইডেলকে। আজ মেয়েদের অন্তর্বাসের সবচেয়ে বড় ও নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান সুইট ড্রিমস। প্রথম থেকে এই পর্যন্ত আসতে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি তাকে। এই ব্যবসায় তার যাত্রাপথ নিয়ে তিনি কথা বলেছেন প্রিয়.কমের সঙ্গে।
প্রিয়.কম: এই ব্যবসা যখন শুরু করলেন, তখন কি ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন?
আনুজা: আমরা যখন এই ব্যবসা শুরু করি তখন মানুষ বিষয়টাকে একটু অন্যভাবে দেখতো। ও মেয়েদের আন্ডার গার্মেন্টস? এই রকম নাক সিঁটকানো একটা ভাব কাজ করতো। এরকম কিছু বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে আমাদের পরতে হয়েছিলো। তবে প্রথম থেকেই আমরা নারীদের কাছ থেকে ভাল সাড়া পাই।
প্রিয়.কম: এই ব্যবসায় তখন কি ধরনের অবস্থা ছিল?
আনুজা: তখন শুধুমাত্র নারীদের আলাদাভাবে আন্ডার গার্মেন্টস এর কোন দোকান ছিল না। আমরাই প্রথম এই ধরনের ব্যবসায় আসি। সব কর্মী নিয়োগ দেই নারী। এতে নারীরা সহজেই দোকানে আসতে পারতো। কারণ এদেশে এখনো মেয়েরা ব্রা, পেন্টি বা নাইটির মত অন্তর্বাস কিনতে এসে লজ্জা পায়।
প্রিয়.কম: ‘সুইট ড্রিমস’ শুরু করেন কবে?
আনুজা: ২০০৩ সালে।
প্রিয়.কম: আপনার দোকানে কি ধরনের পন্য বিক্রি করেন? পন্যগুলো কোন দেশের?
আনুজা: মেয়েদের ব্রা, পেন্টি, ফ্যাশনেবল নাইটি, ম্যাক্সি, ওয়েট লসের বেল্টসহ অনেক কিছু। আর বেশিরভাগ পন্যই আমরা চায়না, থাইল্যান্ড, ইন্ডিয়া, মালয়েশিয়া, জার্মানী থেকে আনি।
প্রিয়.কম: এই ব্যবসায় আপনি কি মনে করে আসেন?
আনুজা: আমি যখন বাইরে পড়াশুনা করি, তখনই ভাবি যে দেশে যদি এই ধরনের একটি ব্যবসা শুরু করা যায় তাহলে ভালো চলবে। কারণ নারীরা পুরুষদের কাছ থেকে তাদের প্রযোজনীয় এসব গোপন পোশাক কিনতে লজ্জাবোধ করেন। তাই ভেবেছি যদি নারী সেলসম্যান রাখা হয় তাহলে ভাল সাড়া পাওয়া যাবে। আসলে আমাদের ধর্মীয় কারণেই নারীরা অন্তর্বাস কিনতে লজ্জাবোধ করেন। এসব ভেবেই এই ব্যবসায় আসা।
প্রিয়.কম: কোন ধরনের নারীরা আপনোদের ক্রেতা?
আনুজা: সব ধরনের নারীরাই আমাদের এখানে আসে। যারা স্পোর্টস করেন তারাও এখান থেকে তাদের প্রয়োজনীয় পন্য কেনেন। এছাড়া টিনএজ, ইয়াংগ্রুপ, মিডএজ, বিভিন্ন বডি শেপের নারীরা আসেন। সবাই আমাদের ক্রেতা।
প্রিয়.কম: আপনারা কি শুধু অন্তর্বাস বিক্রি করেন? না অন্য কোন পন্যও এখানে পাওয়া যায়?
আনুজা: না, আমরা শুধু মাত্র আন্ডারগার্মেন্টসই সেল করি। কিন্তু তার সাথে নারীদের হাইজিন এবং বডি অ্যাওয়ারনেস সম্পর্কে পরামর্শ দেই। আমরা শুধু বিক্রেতা নই, কিছু সামাজিক দায়িত্বও পালন করি। কিছু পরামর্শ দিয়ে থাকি।
প্রিয়.কম: যেমন?
আনুজা: যেমন, কোন ফিগারের সাথে কি ধরনের আন্ডার গার্মেন্টস পড়তে হবে। বাচ্চাদের যখন বুকের দুধ খাওয়ায়- তারপর ব্রা ধুতে হয়, ব্রেস্ট ধুতে হয়। এসব বিষয়ে আমাদের নারীরা সচেতন না। তাদের সচেতন করি। কোন পার্টিতে কোন আন্ডারগার্মেন্স্টস পড়লে বডিতে ফুটে উঠবে। আসলে আমাদের বাঙ্গালী নারীরা শুধু উপরের বা চেহারার সৌন্দর্য নিয়ে যত সচেতন। বডি নিয়ে ততটা নয়। আমি তাদের ইয়োগা করতে বলি। আমি নিজেও ইয়োগা করি। রিসেন্ট থাইল্যান্ড থেকে শিখে এসেছি।
প্রিয়.কম: আপনাদের পণ্যের মান কেমন? বিদেশে তো এই ধরনের দোকান অনেক। তাদের পন্যের সঙ্গে আপনাদের পন্যের পার্থক্য কোথায়?
আনুজা: আমাদের পন্য আন্তর্জাতিক। আমরা বিদেশ থেকেই সব নিয়ে আসি। শ্রীলংকার পন্য সবচেয়ে ভাল। শ্রীলংকান ব্রা এখানে পাওয়া যায় ৪২০০ টাকায়। এগুলো অনেক সফ্ট। এছাড়া জার্মানী ব্র্যান্ডের ব্রাগুলোও অনেক ভাল মানের সেগুলো ৪৫০০ টাকায় পাওয়া যায়। এগুলো ৪বছরও পরতে পারে। কিন্তু কমদামী ব্রা বেশিদিন পরতে পারবে না। এরপর ইন্ডিয়ান আছে, চাইনিজ আছে সেগুলো কম দামের। তারপরও ৫০০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে।
প্রিয়.কম: এতো দাম! সাধারণ ঘরের নারীরা তো কিনতে পারার কথা নয়। শুধুমাত্র উচ্চবিত্তদের জন্যই আপনাদের পন্য?
আনুজা: না, এমন নয়। সাধারণ ঘরের নারীদের জন্যও রয়েছে আমাদের পণ্য। সে ক্ষেত্রে ২০০ টাকা দামের দেশীয় পন্য তারা কিনতে পারে। আর শরীরের সুরক্ষায় দামী ব্রা কিনতে চাইলে দেখে, শুনে, বুঝে কিনতে পারে।
প্রিয়.কম: সাধারণ পণ্যের বাইরে আর কি ধরনের বিশেষ পন্য পাওয়া যায়?
আনুজা: এখানে মাতৃকালীন ব্রা পাওয়া যায়। যাকে ব্রেস্ট ফিডিং বা নার্সিং ব্রা বলে। মেটারনিটি ব্রাও বলে। যার উপরদিকে একটা লুপ থাকে। এতে বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াতে মায়েদেরকে কোন সমস্যায় পড়তে হয়না। এগুলোর দামও বেশি না। মাত্র ৫০০টাকা। আরেক ধরনের ব্রা পাওয়া যায়, ছোট টিনএজ মেয়েদের জন্য। এগুলো পড়লে মেয়েদের ব্রেস্ট ঝুলে পরার সম্ভাবনা থাকেনা। সাধারনত যেসব মায়েরা সাবধান তারা মেয়েদের ব্রেস্ট যাতে ঝুলে না পড়ে তারাই এই ধরনের পন্য মেয়েদের কিনে দেন। এছাড়া সেট পেন্টি পাওয়া যায় যা অনেক ফ্যাশেনেবল।
প্রিয়.কম: আপনাদের সবচেয়ে দামী পন্যের ক্রেতা সাধারণত কারা?
আনুজা: আমাদের বেশকিছু কাস্টোমার আছে বোরকা পড়ে আসে। হাত-মোজা, পা-মোজা পড়ে আসে। সম্ভবত ইরানী বা পাকিস্তানী হবে। তারাই সবচেয়ে দামী পন্যগুলো সচরাচর কিনে নেন। তারাই সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ সচেতন, দেশীয় নারীরা না।
প্রিয়.কম: কোন নাইটিগুলো সবচেয়ে বেশি চলে?
আনুজা: চায়না, থাইল্যান্ডের নাইটিগুলো সবচেয়ে বেশি চলে।
প্রিয়.কম: নাইটির দাম কেমন?
আনুজা: থাইল্যান্ডের নাইটিগুলোর দাম সবচেয়ে বেশি। ২৭০০ টাকা। এছাড়া চায়না ৮০০ টাকা ও ইন্ডিয়ানগুলো ১৪০০ টাকা।
প্রিয়.কম: এই ধরনের ব্যবসার অবস্থা কেমন বলে আপনি মনে করেন? নতুনদের কি এই ব্যবসায় আসার সুযোগ এখনও আছে? আসলে কি পদক্ষেপ নিয়ে আসবে? প্রতিবন্ধকতাগুলো কি?
আনুজা: এই ব্যবসায় এখানো নতুনরা আসতে পারে। আসলে ভালও করতে পারবে। তবে প্রচারনার প্রয়োজন আছে। আরো অনেক ব্র্যান্ডের ব্রা, পেন্টি আছে, সেগুলোকে নিয়ে আসতে হবে। ব্রা, পেন্টির যে আলাদা ব্যবসা আছে তাই অনেকের ধারনা নেই। মানুষ দৃষ্টিকটুভাবে এই বিজনেসটাকে দেখে তাই এই ব্যবসায় নিজেকে জড়াতে চায়না।
প্রিয়.কম: আপনাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি?
আনুজা: অনেক তো বিদেশি পন্য বিক্রি করলাম, এবার একটি নিজস্ব ব্র্যান্ড গড়ে তুলতে চাই। একটি ফ্যাক্টরি খোলার ইচ্ছা আছে। আমরা ব্যাংকের সঙ্গে আলাপও করেছিলাম। তারা সেরকমভাবে সাড়া দিচ্ছে না। সবকিছু মিলে গেলে দেশের প্রথম আন্তর্জাতিক মানের আন্ডার গার্মেন্টস ফ্যক্টরি খুলবো। এছাড়া অনলাইনে শপ খোলার ইচ্ছাও আছে।
প্রিয়.কম: আপনাদের বিলবোর্ড নিয়ে কি সমস্যা হয়েছিলো শুনেছিলাম?
আনুজা: হ্যা, আমরা বেইলী রোডে একটি বিলবোর্ড দিয়েছিলাম। সেখানে অশ্লিল কিছু না থাকার পরও স্থানীয় এক প্রভাবশালীর কারণে বিলবোর্ডটি খুলে ফেলতে হয়। তাই এখানে এই ধরনের ব্যবসা সত্যিই বিব্রতকর। তারপরও আমরা করে যাচ্ছি। এটা অনেক বছর আগের ঘটনাও না। মাত্র মাস ছয়েকের।
প্রিয়.কম: কি ঘটেছিলো সেখানে?
আনুজা: তার মেয়েরা নাকি সেখান থেকে স্কুলে যায়, তারা বিলবোর্ডটা দেখতে পেলে খারাপ হয়ে যাবে। বা বাবামায়েদের নাকি বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পরতে হয়েছে। এইসব কারণ দেখিয়ে বিলবোর্ডটি খুলে ফেলতে বলা হয় একদিনের নোটিশে। আমরা খুলে ফেলি। সেটি ছিল একটি পেন্টির বিজ্ঞাপন। তাই বলবো প্রচারনার ক্ষেত্রে এদেশে সব ধরনের ছবি প্রকাশ করা যায় না। অথচ প্রচারনাটাও যেকোন ব্যবসার জন্য অনেক ভাইটাল। অথচ অন্যান্য অনেক ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপনে শাড়ি থেকে শুরু করে অনেক পন্যেকে এমনভাবে এক্সপোজ করা হয় যা দেখতে বাজে লাগে। আর আমাদের ক্ষেত্রে শুধু আন্ডার গার্মেন্টস এর ছবি দেখলেই 'সব নষ্ট হয়ে গেলো রে' রব ওঠে।
প্রিয়.কম: আর কি ধরনের সমস্যায় আপনাদের পড়তে হয়েছিলো?
আনুজা: প্রথম যখন আমরা এই ব্যবসায় নামি, তখন অনেক মার্কেটও আমাদের জায়গা দিতে চাচ্ছিলো না। এটা ২০১০ সালের ঘটনা।
প্রিয়.কম: নতুন যারা এই ব্যবসায় আসতে চায়, কিরকম পূঁজি নিয়ে আসতে হবে।
আনুজা: মিনিমাম ৩০ লাখ টাকা নিয়ে আসা উচিৎ।
প্রিয়.কম: আপনাকে ধন্যবাদ।
আনুজা: আপনাকে ও প্রিয়.কমকেও ধন্যবাদ।
- ট্যাগ:
- ফ্যাশন
- আনুজা সাইডেল
- সুইট ড্রিমস