
ছবি সংগৃহীত
নারী - অপার রহস্য, অপার বিস্ময়
আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, ১২:১৩
সভ্যতার ক্রম বিকাশের ধারার সাথে তাল মিলিয়ে আজ এই রোবটিক্স যুগ পর্যন্ত সমাজের বিবর্তন, বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য এক কথায় নারীর সার্বজনীন উপস্থিতিই প্রমাণ করে। নারী- তুমিই সার্থক কারিগর, তুমিই অনুপ্রেরণা, তুমিই রহস্যের অপার বিস্ময়। দ্রোহের কবি-প্রেমে কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি কথা না লিখে পারছি না নারীর মহিমাকে ব্যাখ্যা করতে, "এ পৃথিবীর যত মহান কীর্তি, অর্ধেক তার গড়িয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।" অন্যপক্ষে নারীর জন্য যুদ্ধ-বিগ্রহ, খুন-ধর্ষণ, হানাহানি-রক্তারক্তিও কম ঘটেনি। পৃথিবী সৃষ্টি থেকে আজ পর্যন্ত আমরা জানি আদম (Adam) ও বিবি হাওয়ার (Eav) 'গন্ধম' ফল খাওয়ার কাহিনী, মিশরের রাণী 'ক্লিওপেট্রার' (Philopator / Cleopatra VII) কাহিনী, 'হেলেন' অব ট্রয়ের জন্য ট্রয় নগরী ধ্বংসের কাহিনী (অনেকেই বলেন ট্রয় নগরী যখন জ্বলছিল তখন ট্রয়ের শাসক 'নিরো' হেলেনের প্রেমের মোহে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন)। আরো জানি, মোগল সাম্রাজ্যের প্রেমিক সম্রাট শাহজাহানের অমর কীর্তি 'তাজমহল' এর কথা। "রোমিও-জুলিয়েট" কিংবা টাইটানিক মুভির "রোজ- জ্যাক" এর মতো কাহিনী বাস্তব জীবনেও কম নেই। যেভাবেই বিবেচনা করা যাক না কেন, বিশ্ব সৃষ্টি থেকে আজ অবদি পুরুষের প্রেম-প্রেরণা, মোহ-ভালবাসা, সুখ-দুঃখ, যন্ত্রণা-হিংস্রতার প্রধান এবং অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে 'নারী'। নারীর সামাজিক অবস্থান, বিবর্তন, শরীরতত্ত্বীয় গঠন রহস্য, শরীর কেন্দ্রিক বিপণন বাণিজ্য বিবেচনায় রেখেই আজকের এই লেখাটি...
নারীর বয়সভিত্তিক ভাবগতি এবং প্রকৃতি
শাব্দিকভাবে, নারী হলো এমন একটা শব্দ যা দ্বারা সকল বয়সের স্ত্রী লিঙ্গকে বোঝানো হয়। অর্থাৎ মেয়ে, কন্যা, জায়া, ভগ্নি, জননী, মহিলা এ রকম অসংখ্য প্রতিশব্দে বোঝানো যায়। যদিও এর দ্বারা নারীর প্রকৃত ধারণা পাওয়া যায় না। একটু খোলাসা করে বললে, একটি বালিকার আচরণ আর একজন ৩০ উর্ধ্ব মহিলার আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গিতে বিস্তর ফারাক থাকবে। বোঝার সুবিধার্থে আমরা বয়সের সীমারেখা ধরে নিচ্ছি। নাবালিকা বলতে সাধারণত সেই সকল নারীকে বোঝায় যাদের বয়স এখনও ১৮ হয়নি, তরুণী বা যুবতী বলতে আমরা সাধারণত বুঝি যে নারীর বয়স ১৮ উর্ধ্ব কিন্তু ৩০ এর কোটা পেরোয়নি, আর ধরেই নিচ্ছি ৩০ উর্ধ্বরা হচ্ছেন মহিলা। সাধারণত বয়োঃসন্ধি কালে নর-নারীর শারীরিক অবকাঠামোগত পরিবর্তন দেখা যায়, যা তাদের নিজেকে আলাদা করে ভাবতে শেখায়। টিনজার অবস্থায় নারী তার সব ধরণের আচরণে আবেগকে প্রাধান্য দেয়, সামান্য অখুশিতে মাত্রাতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখায়। কারো প্রতি অকারণে রেগে যাওয়া, খাবার বন্ধ করে দেয়া, কথা বলা বন্ধ করা, উস্কানি বা অসৌজন্যমূলক কাজ করা, নিজেকে অকারণে কষ্ট দেয়া, এমনকি আত্মহননের মতো কাজ করতে দ্বিধা করে না।
নারীবাদ : চিন্তন ধারা সমূহ - স্কুল অব থট (School of Thought)
নারীকেন্দ্রিক চিন্তাধারার বেশ কয়েকটি চিন্তন (Thought) রয়েছে l নারীর অধিকার নিয়ে প্রথম সোরগোল তৈরী হয় ১৭৯২ সাল বা তারও কিছু আগে, যখন মেরী ওলষ্টোনকাফ্ট (Mary Wollstonecraft) তার "নারীর অধিকার কেন্দ্রিক যৌক্তিকতা ( A Vindication of the Rights of Woman)" আর্টিকেলটি প্রকাশ করেন l নারীবাদী চিন্তাধারার পদ্ধতি গুলো, ডিসিপ্লিন আকারে সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেন ইলেন সোল্টার (Elaine Showalter) l এগুলোর মধ্যে প্রধান হলো: সাধারণভাবে প্রচলিত ধারণা, ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি, শরীরতত্ত্বীয় গঠন, বিবর্তনবাদ, চিন্তনজগত, মনোজগত, মনোবিশ্লেষণ, লিঙ্গভেদ, জ্ঞান ও শিক্ষণ প্রক্রিয়া, সর্বশেষ স্ত্রীবাদী ভাবনা l এছাড়াও রয়েছে সমন্বয়বাদী এবং মানবতাবাদী চিন্তাধারা lসামাজিক অবস্থান এবং ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি
সামাজিকভাবে আমাদের প্রচলিত ধারণা হলো নারী হলো কোমল তুলতুলে ধরণের কেউ, যারা খুবই মমতাময়ী l যার মধ্যে স্নেহ, প্রেম, আবেগ, রোমান্স, ভালবাসা টাই-টুম্বর ভাবে পরিপূর্ণ l যারা সহজে কঠোর, সহিংস, হিংস্র বা প্রতিশোধপরায়ণ হয় না l তারা স্নেহময়ী মা, মায়াময়ী বোন, প্রেমময়ী প্রেয়সী, প্রিয়তমা সঙ্গিনী, যারা নিজেদের সুখ - আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে নিজেদেরকে বিলীয়ে দিতে ব্যতিব্যস্ত l এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে তারা নিজেদেরকে সমাজে পুরুষের চেয়ে দুর্বলভাবে উপস্থাপন করে l শিল্প, সাহিত্য, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র, নাটক - নাটিকা, গল্প, উপন্যাস, গান, কবিতায় এই নারীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ l ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নারীকে পুরুষের সহধর্মিণী, সহযোগী এবং পরিপূরক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে l যদিও বা পূরানে সীতার সতীত্ব প্রমাণের অগ্নিপরীক্ষা কিংবা দ্রুপদীর বস্ত্র হরণের মতো অসামঞ্জস্যপূর্ণ ঘটনার উল্লেখ রয়েছে l মধ্যযুগীয় সমাজ ব্যবস্থায় সতীদাহ প্রথা কিংবা বিধবাকে গয়া অথবা কাশিতে নির্বাস দেবার কুসংস্কার ভারতবর্ষে চালু ছিল l ইসলামে নারীকে রক্ষণশীল ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, পর্দাপ্রথা বা হিজাবের মাধ্যমে নারীকে পরপুরুষ এবং দৃষ্টি কামলোভী নিকৃষ্ট পুরুষের হাত থেকে রক্ষার কথা বলা হয়েছে l ইহুদী বা খৃষ্টধর্মেও ইসলাম ধর্মের মতো নারীর বাধ্যবাধকতা রয়েছে, যদিও বা পুজিবাদী এবং ভোগবাদী সমাজ কাঠামোর জন্য সর্বত্রই এসকল বিধি বিধান অগ্রাহ্য করা হচ্ছে l বৌদ্ধধর্মে নারীকে সামাজিকভাবে উত্তরাধিকারিণী হিসাবে বলা হলেও তাদেরকে পুরুষের সেবাসঙ্গী বা বিনোদনসঙ্গী হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে l সর্বোপরি, সকল ধর্মেই নারীকে পরম শ্রদ্ধেয়, পরম পূজনীয় মাতৃরূপে উপস্থাপন করা হয়েছে, বলা হয়েছে "মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহশত / জান্নাত / স্বর্গ্য নিহিত রয়েছে l
শরীরতত্ত্বীয় গঠন রহস্য এবং বিবর্তন
একটি নারী জন্মানোর সময়ই তার সমস্ত তথ্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করে l তার শারীরিক গঠন স্লিম হবে না মোটা নাদুসনুদুস হবে, নজরকাড়া সুন্দরী না সাধারণ টাইপের হবে, তার গ্ল্যামার ক্ষণস্থায়ী না চিরস্থায়ী হবে, তা নির্ভর করে তার বংশগতির ধারায় পাওয়া 'জিন' এর উপর l জিন হচ্ছে মানুষের জীবকোষের অভ্যন্তরে ক্রোমোজোমে থাকা এক ধরণের অম্লধর্মী যৌগিক পদার্থ, যা জীবকোষের মৌলিক উপাদান ডি.এন.এ (DNA) ডি অক্সি রাইবো নিউক্লিয় এসিড l জিন আমাদের বংশগতির ধারক ও বাহক l পিতা-মাতার শারীরিক ও মানসিক ভাল-মন্দ তাদের সন্তানের মধ্যে প্রকাশ পাওয়ার মূলে রয়েছে এই জিন l চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় চার ধরণের জৈব ক্ষার - অ্যাডেনিন, গুয়েনিন, সাইটোসিন এবং থাইনিন দিয়ে ডি.এন.এ তৈরি হয় l সত্যি বলতে ডি.এন.এ অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরমাণুর সমন্বয়ে তৈরি একটি অণু l উপরের জৈব ক্ষারগুলো যে কোন একটির সাথে পাঁচটি কার্বনযুক্ত শর্করা অণু এবং একটি ফসফেট বা ফসফরিক এসিড অণু মিলে যে বৃহত্তর যৌগ অণু তৈরি করে, তাকে বলে নিউক্লিওটাইড l এই নিউক্লিওটাইডে সুসজ্জিত আকারে থাকে আমাদের জন্মের, বেড়ে উঠার, বিকশিত হওয়ার সমস্ত তথ্যাদি l এই সকল রাসায়নিক উপাদান নারী - পুরুষ উভয়ের দেহেই ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় বিদ্যমান থাকে l তারপরও প্রকৃতিগতভাবে নারীকে 'বায়োলজিক্যালি' আলাদা করা যায় সন্তান ধারণ ও তৎসংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়ার জন্য l নারী সাবালিকা হওয়ার পর থেকে প্রতিমাসে তার শরীর সন্তান ধারণের জন্য সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করে, আর সন্তান ধারণে ব্যর্থ হলে তা রজক্ষরণের মাধ্যমে শরীর থেকে বের হয়ে যায়, যা সাধারণ ভাষায় 'মাসিক' (Menstruation) নামে পরিচিত l মতান্তরে অনেক মনোবিদ মনে করেন, মাসিকের ভিন্ন ভিন্ন সপ্তাহে নারীর আচরণে 'অম্ল - মধুর' পার্থক্য বিরাজ করে, কখনও কখনও খুবই ক্রেজি মারমুখী, কখনও কখনও ঝড় শেষে শান্ত প্রকৃতির মতো, আবার কখনও প্রেমময়ী স্নেহময়ী কাক্ষিত নারী l সাধারনত টিনইজার সময় থেকে যুবতী কাল পর্যন্ত তাদের মধ্য এ জাতীয় আবেগতাড়িত ব্যবহার বেশী পরিলক্ষিত হয়, যা নারীকে করেছে আরো রহস্যময়ী l যদি মাসিকের সাধারণ নিয়মের কোন ব্যত্যয় ঘটে তা হলে তাকে নারীত্বের অস্বাভাবিকতা বলে ধরে নেয়া হয়, আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে যা খুবই মামুলি ঘটনা l সন্তান ধারণ ও জন্মের পর তাকে প্রকৃতিগতভাবে বাঁচিয়ে রাখতে নারীর বুকে থাকা অসমান্তরাল দুটি নমনীয় গ্রন্থি দিয়ে জীবনরস নিঃসৃত হয়, যা তার সন্তানের খাদ্য হিসাবে বিবেচিত হয় l নারী জীবনের অপর গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যটি হলো তার রজনিবৃত্তি বা মেনোপেজ (Menopause) , অর্থাৎ এমন এক সময় আসে যখন নারী আর সন্তান ধারণ করতে পারেন না l সাধারণত সেই সময়টা আসে ৪৫ থেকে ৫০ বছর বয়সে, যদিও এই বিষয়টি নারীর বেড়ে উঠা, খাদ্যাভ্যাস এবং পরিবেশের উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল l এসময় নারীর জৈবিক উদ্দামতা, উত্তেজনা, পুরুষের সাথে মিলিত হবার বাসনা একেবারেই কমে যায় l রজনিবৃত্তি যা প্রকৃতিগতভাবে নারীর জীবন থেকে কেড়ে নেয় জৈব আনন্দ উল্লাস, হঠাৎ করেই নারী অকাল বার্ধ্যকে পৌছায় l এ সময় নারীর জীবন নিবেদিত থাকে সংসার, সন্তানের লালন পালন এবং পরিবারের প্রতি ভালবাসায় l নারীর মাতৃত্ব বা প্রজনন প্রক্রিয়ার জন্যই নারী সম্পূর্ণরূপে পুরুষ থেকে আলাদা এবং বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী l আর এটাই নারী জীবনের অপার রহস্য, অপার বিস্ময় l নারীর তুলনায় একজন পুরুষ আরো দীর্ঘদিন জৈবিকভাবে সক্রিয় থাকে, পুরুষ সাধারণত ৭০/৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত পূর্ণ সক্ষম থাকে l প্রকৃতিগতভাবে নারীর যৌবনও আসে তাড়াতাড়ি, সাধারণত ১৫ বছর বা তার পূর্বেই নারী সন্তান ধারণ করতে পারে কিন্তু প্রজনন স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনায় রেখে ১৮ বছরের নিচে সন্তান ধারণকে নিরুৎসাহিত করা হয় l আবার ৩৫ উর্ধ্ব নারীর সন্তান ধারণে নানাবিধ জটিলতা দেখা দিতে পারে, তাই ২০ - ৩০ বছরই নারীর সন্তান ধারণের উপযুক্ত সময় l আবার ৩০ উর্ধ্ব অবিবাহিতা নারীর বা বিলম্বে বিয়ে হওয়া নারীর স্তন ক্যান্সারসহ অন্যান্য মেয়েলি রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায় l এসকল কারণে ৩৫ উর্ধ্ব নারীর মধ্যে স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয় l যার ফলশ্রুতিতে তাদের মনোজগতে বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করে, আবার অনেকের মধ্যে মানসিক ভারসাম্যহীনতাও দেখা দেয় l
লিঙ্গভেদ এবং বৈষম্য
নারীবাদী চিন্তাধারায় সবসময়ই দাবি করা হয়, লিঙ্গভেদে মানুষের যে পার্থক্য তা জিনগত নয়, এটা বরং মানুষ সৃষ্ট সমাজ বা সংস্কৃতির পরিণাম l সব বিষয়েই নারী পুরুষের সমান অধিকার রয়েছে l সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, আইনের সুষ্ঠ প্রয়োগ, উপযুক্ত শিক্ষায় সন্তানদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার মাধ্যমে লিঙ্গ বৈষম্য দুর করা সম্ভব l আমাদের দেশে এখন নারী শ্রমিকরা বিভিন্ন পেশায় লিঙ্গ বৈষম্যের কারণে কম বেতন পান l পুরুষ হয়তবা বাহি্যক শারীরিক শক্তিতে কিছুটা এগিয়ে আছে, কিন্তু ব্যাথা - হতাশা সহ্য করার ক্ষমতা নারীর বেশী l তাছাড়া পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেবার ক্ষমতা নারীরই অনেক বেশী l আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় একজন নারী বিয়ের পর স্বামীর পরিবারে এসে কিছুদিনের মধ্যে মিলেমিশে সেই পরিবারের একজন হয়ে উঠছেন l যদিও পশ্চাৎপদ সমাজ ব্যবস্থায় এখনো নারী কম শক্তিশালী ভোগের পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয় l কিছুদিন আগেও আফগানিস্তানে নারীকে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত করার পায়তারা করা হয়েছে, পরিবারের পুরুষ ছাড়া বাইরে বের হতে দেয়া হতো না, পরিবারের কোন সিদ্ধান্তে তাদের মতামতকে অগ্রাহ্য করা হতো l পাকিস্তানের কোন কোন অঞ্চলেও আফগানিস্তানের মতো অবস্থা বিরাজ করছে l সৌদি আরব সহ গোটা আরব জাহানে নারীকে বিভিন্ন ভাবে অবদমিত এবং নিয়ন্ত্রিত করে রাখা হচ্ছে l মাত্র কিছুদিন পূর্বে সৌদি নারীরা গাড়ি চালানোর অনুমতি পেয়েছে l সার্বিক বিবেচনায়, সুশিক্ষার অভাব এবং রক্ষণশীল চিন্তাভাবনাই এর পেছনে কাজ করছে l সম্ভবত নেপোলিয়ন বলেছিলেন - আমাকে একজন সুশিক্ষত মা দাও, আমি তোমাদের উন্নত জাতি উপহার দেব l
কাম উত্তেজনা এবং রসায়ন
নারীর কাম উত্তেজনার আধার যেমন সুন্দর স্বাস্থবান পুরুষ, তেমনি পুরুষের আকর্ষণ হচ্ছে নারীর সৌন্দর্য্যমন্ডিত অবয়ব l আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে "মণিকা - ক্লিনটন" কেলেংকারির কথা l কাম উত্তেজনা আর এর রসায়নে পৃথিবীর পরাশক্তি আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মজে ছিলেন সুন্দরী লাস্যময়ী তন্বী তরুণী মণিকার আকর্ষণে l বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, নারীর প্রতি পুরুষের প্রেমানুভূতি, নারীর রূপের প্রশস্তির পেছনে রয়েছে 'হরমোন' নামের একটি রাসায়নিক উপাদান l টেষ্টোটেরন এবং এষ্ট্রোজেন নামক দু'ধরণের হরমোনের ক্ষরণের কারণে একজন নারী কতটা নরম তুলতুলে হবে নাকি পুরুষালি বৈশিষ্ট্যের হবে, তা নির্ভর করে l মূলত এষ্ট্রোজেন হরমোনের মাত্রার কারণে নারীর শারীরিক অবকাঠামো আদর্শ আকর্ষণীয়া হয়ে উঠে l অনেক সময় নারীর বাহি্যক গঠনে পুরুষের মতো লোম দেখা যায়, যা টেষ্টোটেরন হরমোনের আধিক্যের কারণে ঘটে l আবার এ দু'টো হরমোনের তারতম্যের কারণে নারী পুরুষে রূপান্তরিত হচ্ছে কিংবা পুরুষ নারীতে l নারীর কাম উত্তেজনার পেছনেও রয়েছে হরমোনের সরাসরি ভূমিকা l গ্রীক শব্দ "হরমাও" থেকেই হরমোন শব্দটির উৎপত্তি l "হরমাও" শব্দের অর্থ হলো 'আমি উত্তেজনা সৃষ্টি করি'; সেজন্যেই বলা হয় হরমোন হচ্ছে উত্তজনা তৈরির রাসায়নিক উপাদান l হরমোন হচ্ছে অন্তক্ষরা গ্রন্থির নির্যাস এক ধরণের উত্তেজক রস, এক বিশেষ ধরণের প্রোটিন l দেহে বিভিন্ন ধরণের হরমোন নিঃসরণ ঘটে যা আমাদের জীবদেহের জন্ম থেকে মৃত্য পর্যন্ত নানা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জন্য দায়ী l নারী পুরুষের প্রেম - ভালবাসা, কাম - তৃষ্ণা, এবং মানবিক - শারীরিক তীব্র অনুভূতির পেছনে যে সব রাসায়নিক উপাদান গুলো কাজ করে, তারমধ্যে রয়েছে -- ডোপামিন, নোরপিনেফ্রিন, কোনিলেথিলমিন (পিইএ), এম্পিটামিনস, অ্যানড্ররফিন, অক্সিটসিন ইত্যাদি l তবে অ্যানড্ররফিন ও অক্সিটসিন শরীরে যতবেশী নিঃসুত হবে ততোবেশী নারী - পুরুষ পরস্পরের প্রতি তীব্র আকর্ষন অনুভব করবে l এ জাতীয় রাসায়নিক উপাদান নারীর মস্তিস্কের নিউরো-ট্রান্সমিটার গুলোকে কামাবেগের প্রতি সক্রিয় করে তুলে l কামাবেগে নারীর শরীরে যে লক্ষণ গুলো সুস্পষ্ট হয়, মোটামুটি ভাবে সেগুলো হলো - পেশী টান টান হওয়া, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, রক্তচাপের পরিবর্তন, বুক শক্ত হয়ে যাওয়া, ঠোঁট স্ফীত হয়ে যাওয়া, বিশেষ স্থানের টিস্যুর আয়তন বৃদ্ধি ও রসক্ষরণ, এবং নারীর চোখে মুখে আর্দ্রভাব বিরাজ করা l যে দৃষ্টিকোণ থেকেই ব্যাখ্যা করি না কেন, একজন পূর্ণ যৌবনা নারীর সংস্পর্শে যেমন একজন পুরুষের প্রতিক্রিয়া হয় তেমনি নারীটিরও হয়, এটা স্বাভাবিক প্রাকৃতিক সাড়া l কারণ আমরা জৈব প্রাণী, আর এটা বায়ো-কেমিক্যাল প্রতিক্রিয়া, বিজ্ঞান তেমনটিই বলে l এছাড়া নারী তার মনোজগতে এবং কল্পনায় তার পুরুষ সঙ্গীর কথা ভেবেই নিজ শরীরে কাম রসায়ন সৃষ্টি করতে পারে l একই ভাবে পুরুষও সেই অবস্থা সৃষ্টি করতে পারে এবং ক্ষরণের মাধ্যমে কাম রসায়নের ইতি ঘটায় l পার্থক্য এটুকুই নারী তার মনোদৈহিক রসায়ন সৃষ্টিতে সামগ্রিকভাবে সম্পৃক্ত থাকে আর একই সময়ে বেশ কবার চরম সুখানুভূতি লাভ করে, যা পুরুষের পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার l নারীবাদী চিন্তাধারায় পুরুষশাসিত সমাজে নারীর কামাবেগ পুরুষ দ্বারা প্রণীত নিয়মাবলী দিয়ে নিয়ন্ত্রিত, যা ছিনিয়ে নিয়েছে নারীর দেহের অধিকার l নারী একাধারে নিয়ন্ত্রিত এবং অবদমিত l যৌন আকাংক্ষা একটি দুর্দমনীয় প্রাকৃতিক ঘটনা যা প্রতিটি উন্নত প্রাণীর প্রবৃত্তি, যার শেষ পরিণতি হচ্ছে বংশগতির দ্বারা রক্ষা করা l বৈজ্ঞানিক গবেষণায় জানা গেছে, নারী যৌন কর্মকান্ডে প্রাকৃতিকভাবে সহনশীল এবং ধৈর্যশীল l ফ্রয়েড এর মতো আধুনিক মনোবিদ বলেছেন, নারী কাম রসায়নে অক্রিয় ( Passive) আর পুরুষ সক্রিয় (Active) এটি ভুল ব্যাখ্যা l মূলত এটা উভয়ের পারস্পারিক সহযোগিতাপূর্ণ একটি সুখানুভব, হয়ত সাড়ার দিক থেকে নারী ধীরলয় l সুসান ব্রোডো (Susan Brodo) মতে নারীর শারীরিক প্রস্ততির আগে মানসিক আবেগ অপরিহার্য lমানবতাবাদী, সমন্বয়বাদী এবং বিবর্তনবাদী ভাবনা
সভ্যতা বিকাশের পূর্বে, মানুষ যখন গুহায় বাস করত তখন বন্য প্রাণীর আক্রমণ এবং নিজেদের খাদ্য সংগ্রহে নারী - পুরুষ নির্বিশেষে সমানে সমান অংশিধারী হিসেবেই জীবন যাপন করত l নিউইয়র্ক টাইমসের বিজ্ঞান বিভাগের লেখিকা ছিলেন নাটালি এঞ্জিয়ার (Natalie Angier), সে তার "উইমেন : এন ইন্টিমেট জিওগ্রাফী (Woman : An Intimate Geography) বইয়ে লিখেছেন - ঐতিহাসিকভাবেই নারী পুরুষের সমকক্ষ এবংক্ষেত্র বিশেষে পুরুষের চেয়ে সম্ভবণাময় l ইতিহাস বলে, নব্য প্রস্তরযুগে শিকারী মানুষ সম্পর্কে যে পুরুষ কেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা ছিল তা পূর্ণ সত্য নয়, সত্যটি হলো সেখানে নারীর অংশীদারি ছিল সমানে সমান l আধুনিক যুগের স্বাধীন নারীর মতো, প্রাগৈতিহাসিক কালেও নারী ছিলো স্বাধীন, নারীর বন্দীদশার শুরু মধ্যযুগে l নারীর মধ্যে যে মৌলিক পার্থক্য আমরা দেখি তা সৃষ্টির বৈচিত্র্য, তার রহস্যের অপার বিস্ময় l বিবর্তনবাদীদের মতে নারী পুরুষের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে l তাতো রয়েছেই, পুরুষের গর্ভ থেকে তো আর সন্তান জন্ম নিতে পারে না l নারীবাদীরা চান মধ্যযুগে নারীর প্রতি যে বৈষম্য হয়েছে তা থেকে বেরিয়ে আসতে l তারা এখন সবক্ষেত্রেই নারীকে পুরুষে সমপর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করার পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছে l পুরুষের পাশাপাশি নারীকে তার নিজ অবস্থান থেকে বিকশিত হতে হবে, এ ক্ষেত্রে পুরুষ তার সহায়ক শক্তি হবে, এটাই মানতাবাদী ভাবনা l নারী পুরুষের ভিন্ন ব্যক্তিত্ব, ভিন্ন স্বত্তা, ভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও শারীরিক গঠন সত্ত্বেও উভয়ের সমান অংশগ্রহনে আজকের যুগের প্রতিটি কর্মকান্ড পরিচালিত হব, এটাই সমন্বয়বাদী ভাবনা l তাই ন্যায়সংগত ও ন্যায্যতার বিবেচনায় প্রত্যেকের অধিকার নিশ্চিত হবে মানবিক মূল্যবোধের আলোকে, সেটাই হউক নারী অধিকারের প্রত্যাশা lনারীর শরীর কেন্দ্রিক বিপণন বাণিজ্য

