ছবি সংগৃহীত

জাতিসংঘ অধিবেশন: ভেটো পদ্ধতি বাতিল কেন জরুরি?

Fahmida Urni
লেখক
প্রকাশিত: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫, ১১:২৪
আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫, ১১:২৪

(প্রিয়.কম) বৃহস্পতিবার ২৪শে সেপ্টেম্বর বসতে যাচ্ছে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন। এবারের অধিবেশনে পৃথিবীর ভবিষ্যত নির্ধারণমূলক দুটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। এরমধ্যে প্রথমটি ‘২০১৫-পরবর্তী আলোচ্যসূচি’। এর আওতায়, প্রথমত ২০১৫ সালে ‘মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল’ এর মেয়াদ শেষকে সামনে রেখে বৈশ্বিক উন্নয়ন এজেন্ডা নিয়ে আলোচনা করা হবে। আর দ্বিতীয় যে ইস্যুটি নিয়ে আলোচনা হবে তাহল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কার। আর এ সংস্কারে আরও চারটি বিষয়ের পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে ভেটো ব্যবস্থা বাতিলের প্রস্তাব। আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার মত গুরুদায়িত্ব রয়েছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কাঁধে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এ দায়িত্বটি পালনে মারাত্মকভাবে ব্যর্থ হচ্ছে পরিষদ। বর্তমান বিশ্বে যুদ্ধ-সংঘাতের আধিক্যই বলে দেয় নিরাপত্তা পরিষদের স্থবির ভূমিকার কথা। আর নিরাপত্তা পরিষদের এ ধরনের নিষ্ক্রিয় ভূমিকার ক্ষেত্রে যে ব্যবস্থাটিকে প্রধান অন্তরায় বলে বিবেচনা করা হয়ে থাকে সেটি হল ভেটো পদ্ধতি। কেন এ ভেটো ব্যবস্থা বাতিল করা প্রয়োজন? তা নিয়ে কাউন্টার কারেন্টসে একটি নিবন্ধ লিখেছেন জাতিসংঘের সাবেক উপদেষ্টা আবদুল মুহিত চৌধুরী। তার মতে, ৫টি স্থায়ী দেশকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করে করা এ অগণতান্ত্রিক ভেটো ব্যবস্থা বিভিন্ন আলোচনা এবং সমঝোতার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা তৈরি করে। মুহিত চৌধুরীর সেই নিবন্ধের আলোকে ভেটো পদ্ধতির সঙ্কট, সীমাবদ্ধতা এবং তা বাতিলের প্রয়োজনীয়তা প্রিয় পাঠকের জন্য তুলে ধরা হল। ভেটো কী? ভেটো শব্দটি ল্যাটিন ভাষা থেকে এসেছে, যার অর্থ হচ্ছে আমি মানি না। অবশ্যম্ভাবী শব্দ হিসেবে ভেটো শব্দটি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ব্যাপকভাবে পরিচিত ও এটি বৈশ্বিকভাবে বিরাট প্রভাব বিস্তার করে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া এবং ফ্রান্স - এই পাঁচটি দেশ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য। তারা প্রত্যেকেই ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকারী। ভেটো ক্ষমতা ব্যবহারের মাধ্যমে যে-কোন একটি দেশ নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত যে-কোন ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আইন প্রণয়ন অনুমোদনে বাধা প্রদান করতে পারে। নিবন্ধে নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কার প্রচেষ্টা এবং বার বার তা ব্যর্থ হওয়ার প্রসঙ্গটি তুলে ধরেন মুহিত। তিনি জানান, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কার করতে ২০ বছরেরও বেশি সময় আগে প্রচেষ্টা শুরু হয়। ১৯৯৩ সালে সেসময়কার সাধারণ পরিষদের প্রেসিডেন্ট স্যামুয়েল ইনসানালি একটি ‘ওপেন-এনডেড ওয়ার্কিং গ্রুপ’ নামে একটি গ্রুপ গঠন করেন। ২০০৫ সালে তারই উত্তরসূরী জ্যান এলিয়াসন (বর্তমানে জাতিসংঘের উপমহাসচিব) এ সংস্কার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আন্ত:সরকার আলোচনা (আইজিএন)-কে একটি প্রক্রিয়া হিসেবে বাছাই করেন। ২০০৮ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ৬২/৫৫৭ সিদ্ধান্তটি গৃহীত হয়। এর আওতায়, নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের ন্যায়সঙ্গত প্রতিনিধিত্ব প্রশ্নে আন্তঃসরকার আলোচনার বিষয়টি ত্বরান্বিত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে তখন থেকে আজ পর্যন্ত কোন কিছুই পরিবর্তিত হয়নি বলে উল্লেখ করেন মুহিত। f তিনি জানান, উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির মধ্যে ছিল সদস্যদেশগুলোর প্রতিনিধির কাছে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের সাবেক প্রেসিডেন্ট স্যাম কুটেসারর পাঠানো বার্তা। চলতি বছরের জুলাইয়ে বার্তাটি পাঠানো হয়। সে বার্তায় নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কার বিষয়ে আলোচনার অংশ হিসেবে ৫টি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অবস্থান জানতে চাওয়া হয়। সে ৫টি ক্ষেত্র হল- ১. একটি বিস্তৃত নিরাপত্তা পরিষদের আকার এবং এর কার্য পদ্ধতি ২. সদস্যের ধরন ৩. আঞ্চলিক প্রতিনিধিত্ব ৪. ভেটোর প্রশ্ন ৫. নিরাপত্তা পরিষদ এবং সাধারণ পরিষদের মধ্যকার সম্পর্ক ভেটোর সংস্কারের বিরুদ্ধে ভেটো! নিবন্ধে বলা হয়, ৫টি ক্ষেত্রে সংস্কার আনার কথা বলা হলেও এরমধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ভেটো। আর সে প্রশ্নে এ সংস্কার উদ্যোগটির বিরোধিতা করেছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের তিনটি স্থায়ী সদস্য-যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং চীন। এমনকি আলোচনার জন্য রূপরেখা তৈরি করার ক্ষেত্রে অংশ নেয়ার ব্যাপারেও অস্বীকৃতি জানালো তারা। আর একটি বিষয়ে এ দেশগুলোর অবস্থান একই। আর তাহল তারা সবাই নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো ব্যবস্থায় কোন ধরনের পরিবর্তন আনার বিরোধী। আর এরমধ্য দিয়েই ইঙ্গিত পাওয়া যায়, জাতিসংঘের বর্তমান অসম ক্ষমতা কাঠামোর মধ্যে ভোটো কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে! মূলত ভেটো ব্যবস্থা বজায় থাকলে অন্যান্য সংস্কার আনার বিষয়টি অর্কাকরই থেকে যাবে। ভেটোর প্রকৃতি বোঝাটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। কেন এ ভেটো ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অন্তরায়, কিভাবে এটি বিলোপ করা যাবে এবং এর জন্য কি কি পদক্ষেপ নিতে হবে- সে বিষয়গুলোও খুবই জরুরি। d ভেটোর সংবিধিবদ্ধ ভিত্তি এবং এর বিলোপ কেন দরকার মুহিত জানান, জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী মূলত ‘ভেটো’ শব্দটির কোন অস্তিত্বই নেই। সনদের ২৭(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নন প্রসিডিউরাল ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে পরিষদের স্থায়ী সদস্যসহনয়টি দেশের সম্মতিসূচক ভোটের প্রয়োজন। কেন ভেটো পদ্ধতি বাতিল করা প্রয়োজন? ভেটো পদ্ধতি কেন বাতিল করা প্রয়োজন সে প্রশ্নে তিনটি কারণের কথা উল্লেখ করেছেন মুহিত। সে কারণগুলো হল- ১. এটি একটি সেকেলে এবং অগণতান্ত্রিক অধিকার ২. সময়মত এবং নিষ্পত্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে এটি বাধা তৈরি করে ৩. আলোচনা এবং সমঝোতার ক্ষেত্রে এটি সীমাবদ্ধতা তৈরি করে। কারণগুলোর ব্যাখ্যাও দিয়েছেন মুহিত। g সময়াতীত এবং অগণতান্ত্রিক অধিকার মুহিত বলেন, ল্যাটিন ভেটো শব্দের মানে হল ‘আমি নিষেধ করি’। এছাড়া এটি ঐতিহাসিকভাবে ইউরোপীয় রাজতন্ত্রের একটি পদ্ধতি যেখানে কোন বিলকে আইনে পরিণত করতে রাজকীয় সম্মতির প্রয়োজন হত। আর তাই আজকের দুনিয়ায় বিশেষ করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দুনিয়ায় ভেটো পদ্ধতিকে সেকেলে বলে উল্লেখ করেছেন মুহিত। এছাড়া এ ভেটো পদ্ধতির আওতায় রাষ্ট্রগুলোর সার্বভৌমত্ব নীতির সমতা প্রতিষ্ঠিত হয় না উল্লেখ করে একে অগণতান্ত্রিক পদ্ধতি বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো পদ্ধতির মধ্য দিয়ে পরিষদের ৫ সদস্য যে সবচেয়ে ক্ষমতাধর সে বিষয়টিও প্রতিষ্ঠা পায় বলে উল্লেখ করেন মুহিত। তার মতে, যদিও আদতে ফ্রান্স আর যুক্তরাজ্যকে এখন আর পরাশক্তি বিবেচনা করা হয় না তারপরও সেই সত্যটিই বজায় রয়েছে। সময়মত এবং নিষ্পত্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে বাধা মুহিতের মতে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রকৃতি এবং সংঘাতময় পরিস্থিতির বিবেচনায় এ ভেটো পদ্ধতি সঙ্কটের নিষ্পত্তিকে বিলম্বিত করে। কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে একজনের ভেটোর কারণে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া যায় না। ভেটোর ব্যবহার কিংবা এটি ব্যবহারের হুমকি অমার্জনীয় বিলম্ব তৈরি করে। অনেকসময় এটি সংঘাতকে আরও বাড়িয়ে দেয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি। দৃষ্টান্ত হিসেবে এখানে মুহিত সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের প্রসঙ্গটি তুলেছেন। তার দাবি, সিরিয়ায় তৈরি হওয়া বর্তমান মানবিক সঙ্কট হল রাশিয়া, চীন এবং নিরাপত্তা পরিষদের বাকি স্থায়ী সদস্যদের মধ্যকার অচলাবস্থার ফলাফল। ভেটোর বীজ জাতিসংঘের পূর্বরূপ লীগ অব নেশনস-এর মধ্যেও ছিল বলে উল্লেখ করেন মুহিত। তার মতে সেটি ছিল আরও কষ্টকর কাঠামো যেখানে স্থায়ী এবং অস্থায়ী সব সদস্যই ভেটো দিতে পারত। আর এ ভেটো পদ্ধতির কারণেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঠেকাতে লীগ অব নেশনস-এ ব্যর্থ হয়েছিল বলে মনে করেন মুহিত। ভেটো পদ্ধতিকে বাদ না দিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যপদের ব্যাপ্তি বাড়ানো হলে পরিস্থিতি একই থাকবে বলে মনে করেন তিনি। f আলোচনা ও সমঝোতায় সীমাবদ্ধতা মুহিতের মতে, সংঘাত সমাধানের জন্য আলোচনায় সমঝোতা ও আদান-প্রদানের বিষয়টি জরুরি। আর এ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি ভেটোর মাধ্যমে দুর্বল হয়ে পড়ে বলে দাবি করেন তিনি। মুহিত জানান, স্নায়ু যুদ্ধের সময়, সোভিয়েত ইউনিয়ন আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একে অপরের বিরুদ্ধে ভেটো দেয়ার প্রবণতার কারণে এক ধরনের অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল। আর বর্তমানে স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের চেয়েও বেশি সংঘাত হচ্ছে উল্লেখ করে মুহিত বলেন, বর্তমানে ভেটোকে কেন্দ্র করে সেই ধরনের অচলাবস্থা চলছে যুক্তরাষ্ট্র আর চীনের মধ্যে। মুহিত চৌধুরীর মতে, ভেটোর বিলুপ্তি খুবই জরুরি। এটি সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সার্বভৌম সমতা নিশ্চিত করবে। এর মধ্য দিয়ে স্থায়ী ও অস্থায়ী সদ্স্যদের মধ্যকার ব্যবধান কমবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। মুহিত জানান, ভেটো পদ্ধতি বাতিলের ব্যাপারে আফ্রিকা গ্রুপ, এল সিক্সটি নাইনের অনেকগুলো সদস্য রাষ্ট্র, মালয়েশিয়া এবং ইউক্রেনের সমর্থন রয়েছে। ভেটো পদ্ধতি বাতিলের প্রশ্নে যদি সমর্থন আরও বাড়ে তবে এ দাবি আরও জোরালো হয়ে উঠবে। মুহিতের মতে, আফ্রিকান গ্রুপ এবং এল সিক্সটি নাইনের পাশাপাশি যদি জি ফোরভুক্ত দেশগুলোও নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো বাতিলের দাবি তোলে তবে সে দাবি আরও জোরালো হবে। বিশ্বের বাকি দেশগুলো এবং সুশীল সমাজও এ ব্যাপারে আওয়াজ তুলতে পারেন বলেও সুপারিশ করেন তিনি। আর তখন হয়তো ভেটোর করাল গ্রাসের শিকার ছোট ছোট দেশগুলো পাবে তাদের অধিকার। ফিরে আসবে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা। সূত্র: কাউন্টার কারেন্টস