(প্রিয়.কম) আজ মহান স্বাধীনতা দিবস। বাঙ্গালি জাতির জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ দিন, অহঙ্কারের দিন, মাথা উঁচু করে পৃথিবীকে নিজেদের স্বাধীনতা সম্পর্কে জানিয়ে দেয়ার দিন। বর্বর পাকিস্তানী শোষকের নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা, কারো দানে পাওয়া নয়। পরম পাওয়া এই স্বাধীনতা নিয়ে গর্ব করার অধিকারতো এই জাতিরই। একটা রক্তক্ষয়ী যু্দ্ধের ভেতর দিয়ে জন্ম আমাদের বাংলাদেশের। পূর্বসূরীদের গৌরবময় অতীতকে স্মরণ করিয়ে দিতেই মহান স্বাধীনতা আমাদের কাছে বারবার ফিরে আসে। সেই সময়ের বীরযুবাদের কথা বলে, প্রকৃত যোদ্ধাদের কথা বলে, যারা যুদ্ধের কলাকৌশল না জেনেও শুধু আবেগতাড়িত হয়ে নিজের মায়ের সম্মান, দেশের সম্মান রক্ষার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো ভয়ঙ্কর পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বুলেটের বিরুদ্ধে। আর সেইসব দুঃসাহসী যোদ্ধাদের পুরোটা সময় নিজের কন্ঠ দিয়ে, মনন দিয়ে, সুরের মূর্ছনা, আর বারুদের চেয়েও শক্তিশালী গীতের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত করে গেছেন আমাদের কন্ঠযোদ্ধারা তাদের কথাও বলে।

যাঁরা পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে সসস্ত্র যুদ্ধ করেছেন, তাদের কথা ভিন্ন, তাদের অবদান জাতি স্মরণ করবে জীবনভর। কিন্তু যাঁরা সম্মুখ সমরে অস্ত্র সজ্জিত হয়ে যুদ্ধে শরিক হননি, অথচ নিজের মনন,সৃষ্টিশীলতা আর মেধার সমস্তটাই খরচ করেছেন একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আশায় তাঁদের মধ্যে স্বাধীন বেতার কেন্দ্রের কন্ঠযোদ্ধারা অনন্য, অসাধারণ তাদের কন্ঠ নৈপুন্য, জাদুকরি তাঁদের সুরের ঝঙ্কারে সম্মোহিত করেছেন পুরো জাতিকে। নানা কারণেই ৭১ সালে 'স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র' বাঙ্গালি জাতির কাছে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠে। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের পরই মূলত পাকিস্তানি শোষকদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার সংগ্রাম জারি হয়ে যায়, ২৫ মার্চ মধ্য রাত থেকে অপারেশন ‘সার্চ লাইট’নামে নিরীহ বাঙ্গালির উপর বর্বর গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী। এরপর থেকে সম্মুখ সমরে চলে যুদ্ধ। পর্যাপ্ত যুদ্ধাস্ত্র নেই, শুধু মাত্র দেশের প্রতি ভালোবাসা আর মহান এক নেতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে গুটা একটা জাতি মাথা তুলে দাঁড়ায় আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে। আর দেশের প্রতি আন্তরিক এই জাতিকে পুরোটা সময় অনুপ্রানিত করেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কন্ঠযোদ্ধারা আর তাদের সম্মোহিত করে দেয়া গান।
অকতুভয় মুক্তিযোদ্ধারা যখন শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে শুধুমাত্র দেশীয় অস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে মানসিকভাবে আহত হন, একটু ঝিমিয়ে পড়েন তখন কন্ঠযোদ্ধারা বলে উঠেন ‘জ্বলে পুড়ে মরে ছাড়খার তবু মাথা নোয়াবার নয়’; এমন সাহসী উচ্চারণের কথা শুনে ফের চাঙ্গা হন সত্যিকারের বীরেরা। আবার তাঁরা শত্রুর মোকাবেলা করেন দৃঢ় চেতনায়।
সেইসময়ে যুদ্ধের ময়দানে আমাদের বীরসেনাদের এমনসব গানের মাধ্যমে উজ্জীবিত করছেন, চাঙ্গা করেছেন, শত্রুর বিরুদ্ধে মোকাবেলা করার শক্তি যুগিয়েছেন যেসব কন্ঠযোদ্ধারা তাদের মধ্যে সমর দাস, আবদুল জব্বার, আপেল মাহমুদ, রথীন্দ্রনাথ রায়, অরুন গোস্বামী, মান্না হক, মাধুরী চ্যটার্জী, এম চান্দ, ইয়ার মোহাম্মদ, প্রবাল চৌধুরী, উমা খান, নমিতা ঘোষ, স্বপ্না রায়, জয়ন্তী লালা, অজিত রায়, সুবল দাশ, লাকি আখন্দ, বুলবুল মহালনবীশ,ফকির আলমগীর, তিমির নন্দী, মিতালী মূখার্জী, মলয় গাঙ্গুলী, রফিকুল আলমের মতোন তুখোড় কন্ঠযোদ্ধারা।

এপ্রিল মাস থেকে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ হয়ে উঠে বাঙ্গালি জাতির কাছে স্বাধীনতার একটি মূখপাত্র। স্বাধীনতাকামী সমগ্র বাঙ্গালি জাতি স্বত্ত্বার যোগাযোগের এক অঘোষিত ও প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠে রেডিও। দিশাহীন মানুষ যখন ইথারে শুনে ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ তখন স্বস্তি পায়, আশা খুঁজে পায়। শত্রুর মোকাবেলা করতে উদ্যম খুঁজে পায় সংগ্রামী ছাত্র-জনতা। কিংবা ভরাট গলায় যখন ভাঙ্গা রেডিওতে বেজে উঠে ‘রক্তের প্রতিশোধ রক্তেই নিবো আমরা’, তখন অশিতিপর বৃদ্ধ কিংবা একেবারে নওজোয়ানও প্রতিশোধ স্পৃহায় গর্জে উঠে শত্রুর বিরুদ্ধে। নতুন দেশের কল্পনা করে, শোষণ আর বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে যে তরুন গেছে যুদ্ধের ময়দানে সে যখন শুনে ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল…রক্ত লাল…রক্ত লাল’ তখন সে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছুতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বন্দুকের ট্রিগার। যে তরুন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা মার্কসিজম বা মাও সে তুঙ আওড়ানো কোনো আঁতেল বা তাত্ত্বিক সার্বভৌম রাষ্ট্র কায়েমের জন্য যুদ্ধে এসে নির্লিপ্ত হয়ে বসে আছে, আর যুদ্ধে আসার দার্শনিক উত্তর খুঁজছে, সেও যখন ইথারে ভেসে আসা আপেল মাহমুদের বজ্রকন্ঠে ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি, মোরা একটি দেশের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি’ গানটি শুনেন তখন সমস্ত দ্বান্দ্বিক অবস্থান দূর করে প্রকৃতঅর্থেই একজন সাচ্চা যোদ্ধা বনে গেছেন। শত্রুর বিরুদ্ধে কোনো অপারেশনে ব্যর্থ হয়ে মগ্নচিত্তে হয়তো কোনো যোদ্ধা স্বাধীন বাংলার বেতারে শুনছিলেন ‘দিয়েছি তো শান্তি আরও দেবো স্বস্তি, দিয়েছি তো সম্ভ্রম আরো দেবো অস্থি, প্রয়োজন হলে দেবো এক নদী রক্ত’, তখন সাময়িক পরাস্ত হওয়ার গ্লানি ঝেরে ফেলে হয়তো সেই যোদ্ধাই পৃথিবীর কোনো টগবগিয়ে ত্যাজস্বী ঘোরার মতো আঁছরে পড়েছেন শত্রুপক্ষের ঘাঁটিতে।
এইসব ছুঁয়ে যাওয়া একেকটা গান বাঙ্গালির মানসপটে গেঁথে আছে। যার ভিতরে নূন্যতম দেশাত্মবোধ আছে তাকে এই সময়ে এসেও এই গানগুলি উদ্দীপনা যোগায়, এক ধরণের স্পৃহা তৈরি করে দেয় মনের ভেতরে। মুক্তিযুদ্ধের পরের প্রজন্মও সেইসব জ্বালা ধরা সময়ের গানকে অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সাঙ্গ করে রাজপথে নামছে।

গানের সুর আর কথা যে গ্রেনেডের চেয়েও শক্তিশালী হতে পারে, তা ওই সময়ের গানে খুব ভালোই আঁচ পাওয়া যায়। যদিও প্রায় প্রত্যেকটি গানেরই গীত রচনা করেছেন সেই সময়ের মুক্তিকামী কবি সাহিত্যিকগণ, যাঁদের রয়েছে সমকালীন সমাজকে পড়ে ফেলতে পারার বিশেষ দক্ষতা। কোনো গানের কথায় বিন্দুমাত্র অতিশয়োক্তি নেই, বরং গানের কথাগুলো প্রতিবাদী উচ্চারণ হওয়া সত্ত্বেও গানের সুরে আছে এক ধরণের বিশেষ মাদকতা। গানের মাধ্যমে নিজেদের যোদ্ধাদেরকে মানসিকভাবকে যেমন উদ্দীপ্ত করার প্রয়াস ছিলো, তেমনি শত্রুপক্ষের জন্যও ছিলো চরম হৃঙ্কার। যেমন ‘জনতার সংগ্রাম চলবেই, আমাদের সংগ্রাম চলবেই’ বা ‘আমাদের চোখে চোখে লেলিহান অগ্নি, সকল বিরোধ বিধ্বংসী’ অথবা ‘ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে, মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমর রঙ্গে’ গানগুলো যেমন মুক্তিযোদ্ধাদের স্পৃহা যুগিয়েছে ঠিক তেমনি বর্বর পাকিস্তানি হানাদার ও এদেশীয় দোসরদের জন্যও ছিলো চরম ধমকিস্বরূপ।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রত্যেকটা গান মনস্তাত্বিকভাবেতো বটেই, বরং সেই সময়ের বঙ্গ সন্তানদের বাস্তবিক অর্থেই আলোড়িত করেছে। গানগুলির মধ্যে যে শুধু যুদ্ধে মনোনিবেশ করতে অনুপ্রানিত করার প্রয়াস ছিলো, তা কিন্তু না; বরং বাঙ্গালির এমন সংকটময় সময়ে যাতে সাম্প্রদায়িকতা মাথাচারা দিয়ে না উঠতে পারে সেই দিকটিও নজর রেখেছেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ও কলাকুশলীরা। বারবার গানের মাধ্যমে বাংলার জনগণকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা। ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার মুসলিম, বাংলার খ্রিস্টান আমরা সবাই বাঙালি’-এসব গান স্বাধীনতাকামী প্রত্যেকটি মানুষকে আলোড়িত করেছে, উৎসাহ যুগিয়েছে।

৭১ থেকে আমরা আজ কতো দূর চলে এসেছি, আদর্শের জায়গা থেকে কতো বিভাজন আমাদের মধ্যে। তবু যারা এখনো বিকিয়ে যায়নি, আস্থা আছে আমাদের স্বাধীনতায়, তাদের মানসপটে আজো সেইসব অকতুভয় কন্ঠ আর কন্ঠযোদ্ধারা আছেন অম্লান। বছর গড়িয়ে ফের আসছে আরেকটি স্বাধীনতা উদযাপনের দিন, উদযাপনলগ্নে তৎকালীন সময়ে সমগ্র বাংলার মুক্তিকামী যোদ্ধা ও জনতাকে গানের মধ্য দিয়ে উদ্দীপ্ত করা মহান কন্ঠযোদ্ধাদের জানাই পরম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। আর শতো শতো বছর জিইয়ে থাক্ বাঙ্গালি জাতির সেইসব জ্বালাময়ী জাগরণের গান।
লেখক: মিতুল আহমেদ