খাদি...এটা শুধু কাপড়েরই নাম নয়, নিজেদের অধিকার নিয়ে সচেতনতার ইতিহাসের এক অন্যতম মাইলফলকের নাম! তখন ইংরেজ শাসনামল। পুরো উপমহাদেশ জুড়ে ইংরেজদের পণ্য। এমন সময়ে শুরু হলো স্বদেশী আন্দোলন। বিদেশী পণ্যকে 'না' বলে নিজেদের পণ্য ব্যবহারে ঐক্যবদ্ধ হলো এই উপমহাদেশের মানুষ। নিজেদের পোশাকের চাহিদা মেটানোর জন্য চরকায় খাদি কাপড় বোনা ও তার ব্যবহার জোরেসোরে শুরু হলো! কার্পাস তুলা থেকে তৈরি হতো সুতা এবং সেই সুতা ব্যবহার করে চরকায় তৈরি হতো খাদি কাপড়।
উপমহাদেশে খাদি কাপড়ের প্রচলন অনেক আগে থেকে থাকলেও এর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মহাত্মা গান্ধীর কথাই বলা হয় প্রথমে! কারণ ১৯২০ সালে তিনিই প্রথম স্বদেশী পণ্যকে প্রতিষ্ঠার উদাহরণ হিসেবে খাদি কাপড়কে নিয়ে আসেন সবার সামনে এবং এর গুরুত্ব তুলে ধরেন। 'স্বরাজ' প্রতিষ্ঠার জন্য স্বদেশী পণ্যকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং খাদি কাপড় হতে পারে এর অন্যতম উদাহরণ- এ চেতনাকেই জাগ্রত করেছিলেন মহাত্মা গান্ধী। এ কারণেই স্বদেশী আন্দোলনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত খাদি কাপড়। ১৯২১ সালে মহাত্মা কুমিল্লার চান্দিনা অঞ্চলে আসেন এবং বিদেশী কাপড় ছেড়ে দেশী কাপড় ব্যবহারে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি নিজে চরকার ব্যবহার সম্পর্কে প্রশিক্ষণও দেন!

বাংলাদেশের ইতিহাসে খাদির প্রচলন অনেক আগে থেকে। মোঘল আমল থেকে এর ব্যবহারের কথা জানা যায়। সেসময় হাতে বোনা, মোটা এই কাপড় প্রজাদের বসন হিসেবে প্রচলিত ছিল। ১৭শ শতাব্দীর দিকে ত্রিপুরা রাজ্যে খাদি কাপড় বোনাকে পেশা হিসেবে নিয়েছিল প্রচুর লোক। বাংলাদেশের মধ্যে কুমিল্লা খাদি কাপড়ের জন্য বিখ্যাত জায়গা। ময়নামতি, চান্দিনা, গৌরিপুরসহ বেশ কিছু জায়গায় খাদি বুননের কাজ চলত। রঙিন খাদি কাপড়ের লুঙ্গি, শাড়ি, গামছা সেসময় ময়নামতিতে তৈরি হতো এবং দুই থেকে পাঁচ টাকার মধ্যে সেগুলো কিনতে পাওয়া যেত।
বাংলাদেশে খাদি কাপড়ের ঐতিহ্যের সঙ্গে সারাজীবন জড়িয়ে থাকবে একটি নাম - শৈলেন্দ্রনাথ গুহ। তিনি সবার কাছে 'খাদিবাবু' নামেই পরিচিত! কুমিল্লার চান্দিনার খাদির ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে তিনি দীর্ঘদিন এর উন্নয়নের পেছনে কাজ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ছেলেরা বাবার রেখে যাওয়া কাজের হাল ধরেন। আর এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে ফ্যাশন হাউসগুলো এই ঐতিহ্যের প্রসার ঘটিয়েছে এবং এর সাথে যোগ করেছে নানান বৈচিত্র্য। খাদি ঐতিহ্য ধরে রাখার পেছনে আরেকটি মানুষের কথা না বললেই নয়, তিনি হলেন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ডিজাইনার এবং মডেল বিবি রাসেল!

১৯৯৪ সালে বাংলাদেশে ফিরে এসে তিনি দেশী ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করেন এবং জামদানী, মসলিন, গামছা ও খাদি কাপড়ের ব্যবহারের ওপর জোর দেন। দেশে ও বিদেশে তাঁর আয়োজিত অনেক ফ্যাশন শো খাদি কাপড়কে নিয়ে আসে ফ্যাশনের জগতে।
একটা সময় ছিল যখন খাদি মানেই ছিল সাদা বা মেটে রঙের কাপড়। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বৈচিত্র্য এসেছে রঙে এবং সেইসাথে পোশাকেও! এক সময় ফ্যাশন জগতে খাদি দিয়ে শুধু পাঞ্জাবি তৈরি করা হতো। কিন্তু বর্তমানে শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, ফতুয়াসহ আরো নানা পোশাক তৈরি হয়। শুধু পোশাক নয়, খাদি কাপড় দিয়ে তৈরি বিছানার চাদর, বালিশের কভার, সোফা ও কুশনের কভার, পর্দা, শীতের চাদরও বেশ জনপ্রিয় এখন!
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী জিনিসগুলোর মধ্য একটি হলো খাদি। এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে হলে স্বদেশী পণ্য ব্যবহারে এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে।