ছবি সংগৃহীত

কিতাবুল ইমান : প্রবন্ধ নং- ৫৯ : প্রায়োগিক সুন্নত এবং সীরাতের কয়েকটি ঘটনা

মিরাজ রহমান
সাংবাদিক ও লেখক
প্রকাশিত: ০৫ মার্চ ২০১৪, ১৬:০০
আপডেট: ০৫ মার্চ ২০১৪, ১৬:০০

প্রায়োগিক সুন্নত এবং সীরাতের কয়েকটি ঘটনা

প্রায়োগিক সুন্নত এবং সীরাতের কিছু ঘটনায় আমরা পাই যে, যারা শাহাতাদাইন মেনে নিয়েছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের জন্যই ঈমান ও ইসলামের সাক্ষ্য দিয়েছেন। যেমন, ১- সহিহ মুসলিম, মুয়াত্তায়ে ইমাম মালেক, আবু দাউদ ও নাসাঈতে মুয়াবিয়া বিন হাকাম আস সুলামী থেকে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে, যার ভাষ্য হলো, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুয়াবিয়া বিন হাকামের এক কৃতদাসীকে -যাকে সে কাফ্ফারার জন্য আযাদ করতে চাচ্ছিল-জিজ্ঞাসা করলেন, আল্লাহ কোথায়? সে বলল, আকাশে। তিনি বললেন, আমি কে? সে বলল, আপনি আল্লাহর রাসুল। তিনি বললেন, ওকে আযাদ করে দাও।’ [দেখুন মুয়াত্তায়ে ইমাম মালেক পৃ.৪৮৫-৪৮৬; নাইলুল আওতার ৭/২০৮] ২ - আবু দাউদ ও নাসাঈ শারীদ বিন সাউইদ আছ্ছাকাফী থেকে বর্ণনা করেছেন যে, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক কৃতদাসীকে বললেন, ‘তোমার রব কে?’ সে বলল, ‘আল্লাহ।’ তিনি বললেন, ‘আমি কে?’ সে বলল, ‘রাসূলুল্লাহ।’ তিনি বললেন, ‘ওকে আযাদ করে দাও, সে মুমিনা।’ [দেখুন নাইলুল আওতার ৭/২০৮] ৩ - সীরাতগ্রন্থসমূহে আবু বকর সিদ্দীক (রাযি.)-এর ইসলামগ্রহণের ঘটনায় এসেছে যে, তিনি রাসূলুললাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন এবং বললেন, ‘কুরাইশরা আপনার ব্যাপারে যা বলছে, তা কি ঠিক, হে মুহাম্মাদ (সা.)? আপনি নাকি আমাদের ইলাহদের ত্যাগ করে চলেছেন, আমাদের আকল-বুদ্ধি নাকচ করে দিচ্ছেন, আমাদের বাপদাদাদের কাফের বলছেন? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি আল্লাহর রাসুল ও নবি, তিনি আমাকে তাঁর রিসালত পৌঁছিয়ে দেয়ার জন্য প্রেরণ করেছেন। হে আবু বকর, আমি তোমাকে এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার আহবান জানাচ্ছি, যার কোনো শরীক নেই, তুমি তাকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না, সদাসর্বদা তারই আনুগত্য করো।’ তিনি তাঁকে কোরান পড়ে শোনালেন। অতঃপর আবু বকর সিদ্দীক (রাযি.) ইসলামে প্রবেশ করলেন এবং সকল মূর্তি অস্বীকার করলেন, আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাউকে শরীক করা পরিত্যাগ করলেন, ইসলাম যে হক ও সত্য তিনি তার স্বীকারোক্তি দিলেন, তিনি মুমিন ও বিশ্বাসী হয়ে ফিরে এলেন।’ [সীরাতে ইবনে কাছীর ১/৪৩৩ ] আবু বকর সিদ্দীক (রাযি.)-কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে কথার প্রতি ঈমান আনার আহবান জানিয়েছেন তা ছিল প্রকৃত অর্থে শাহাদাতাইন। ৪ - খালেদ বিন সাইদ (রাযি.)-এর ইসলাম গ্রহণের ঘটনায় এসেছে, তিনি আজয়াদ এলাকায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দেখা পেলেন এবং বললেন, ‘হে মুহাম্মাদ, তুমি কিসের প্রতি আহবান কর?’ তিনি বললেন, ‘আমি তোমাকে আহবান করছি এক আল্লাহর প্রতি, যার কোনো শরীক নেই, আর মুহাম্মাদ আল্লাহর বান্দা ও রাসুল।’ খালেদ বললেন, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আপনি আল্লাহর রাসুল।’ তার ইসলাম গ্রহণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুশি হলেন।’ [সীরাতে ইবনে কাছীর ১/৪৪৭] ৫ - আবু যর গিফারী (রাযি.)-এর ইসলাম গ্রহণের ঘটনায় এসেছে, তিনি বলেন, ‘আমি ইসলামের চতুর্থ ব্যক্তি। আমার পূর্বে তিনজন ইসলাম গ্রহণ করেছিল। আর আমি হলাম চতুর্থ। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এলাম এবং বললাম, আস সালামু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসুল। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেহারায় আনন্দের ঝলক দেখতে পেলাম।’ [সীরাতের ইবনে কাছীর ১/৪৪৭ ] এটা হলো তার ইসলাম গ্রহণে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। ইমাম বুখারি আবু যর গিফারী (রাযি.)-এর ইসলাম গ্রহণের বিস্তারিত বর্ণনা উল্লেখ করেছেন। সেখানে আছে যে, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু যর গিফারী (রাযি.)-কে ইসলাম গ্রহণের পর বললেন, ‘তুমি তোমার কাওমের কাছে ফিরে যাও। তাদের দাওয়াত দিতে থাক যতক্ষণ না আমার নির্দেশ আসে।’ তিনি বললেন, ‘যিনি আপনাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন তার কসম, আমি তাদের অবশ্যই উৎসাহিত করব, এবং তা সকলের সামনেই। অতঃপর তিনি মসজিদে গেলেন ও চিৎকার করে ঘোষণা করলেন, أشهد أن لا إله إلا الله وأن محمدا رسول الله এরপর তার কাওম তার প্রতি ধেয়ে এল। তারা তাকে মেরে মেরে একেবারে ধরাশায়ী করে দিল।’ [বুখারি, আস-সহিহ (ফাতহুল বারীসহ) ৭/১২৯; হায়াতুস সাহাবা ১/২৯০] উল্লিখিত হাদিস এ বিষয়টি খুব স্পষ্ট করে দিচ্ছে যে, সাহাবীগণ শাহাদাতাইনের মাধ্যমেই ইসলামে প্রবেশ করতেন। ৬ - তুফাইল বিন আমর আদ্-দুসী (রাযি.)-এর ইসলাম গ্রহণের ঘটনায় এসেছে যে, তিনি দূস এলাকার একজন সম্মানিত ও সর্বমান্য নেতা ছিলেন। তিনি মক্কায় এলে কুরাইশ নেতারা তার সঙ্গে মিলিত হন, তারা তাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দেন। রাসূলুল্লাহর সঙ্গে মিলিত হতে অথবা তাঁর কথা শুনতে তাকে নিষেধ করে দেন। তুফাইল বলেন, ‘আল্লাহর কসম, তারা আমার সঙ্গে লেগেই থাকল যে পর্যন্ত না আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আমি তার কোনো কথাই শুনব না, তার সঙ্গে নিজেও কথা বলব না। এমনকি যখন আমি মসজিদে গেলাম, পাছে তার কোনো কথা আমার কানে প্রবেশ করে ফেলে এই আশঙ্কায় আমি আমার কানে তুলা পুতে নিলাম। আমি তার কথা শুনব না এ ব্যাপারে আমার অন্তর শক্ত করে নিলাম। যখন আমি মসজিদে গেলাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কাবার কাছে নামাজে দাঁড়ানো অবস্থায় পেলাম। আমি নিকটে গিয়ে দাঁড়ালাম। আল্লাহ তাআলা যেন তাঁর কিছু কথা আমাকে শুনিয়ে তবেই ছাড়বেন। তুফাইল (রাযি.) বলেন, অতঃপর আমি সুন্দর কিছু কথা শুনলাম। মনে মনে বললাম, আমার মা সন্তানহারা হোক, আল্লাহর কসম, আমি নিশ্চয় একজন বুদ্ধিমান পুরুষ। ভালোমন্দের পার্থক্য আমি বুঝি। তাহলে এই লোকটির কথা শুনতে আমার সমস্যা কোথায়। যদি সে ভালো কথা বলে, তাহলে তা গ্রহণ করব, আর যদি মন্দ কথা বলে তবে বর্জন করব। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার বাড়ির দিকে রওনা হওয়া পর্যন্ত আমি সেখানে দাঁড়িয়েই থাকলাম। অতঃপর আমি তার অনুসরণ করলাম। তিনি তাঁর বাড়িতে প্রবেশ করার পর আমিও প্রবেশ করলাম। আমি তাঁকে লক্ষ করে বললাম, হে মুহাম্মাদ, আপনার কাওম তো আমাকে এই এই বলল। তারা আমাকে আপনার ব্যাপারে ভয়ভীতি দেখিয়েই চলল যতক্ষণ না আমি আমার কানে তুলা পুতে নিই, যাতে আপনার কোনো কথা শুনতে না হয়। তবে আল্লাহ তাআলা আমাকে আপনার কথা না শুনিয়ে ছাড়লেন না। আমি সুন্দর কথা শুনেছি। অতএব আমাকে আপনার দাওয়াত সম্পর্কে বলুন। তিনি আমাকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন ও কোরান তিলাওয়াত করে শোনালেন। আল্লাহর কসম, আমি এর চেয়ে উত্তম কোনো কথা কখনো শুনিনি। এর চেয়ে সরল ও ইনসাফপূর্ণ কথা কখনো শুনিনি। অতঃপর আমি ইসলাম গ্রহণ করলাম এবং সত্যের সাক্ষ্য দিলাম।’[সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৪০৮ ] সত্যের সাক্ষ্য হলো ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রাসুল, এই সাক্ষ্য দেয়া। ৭ - খালেদ ইবনে ওয়ালীদের (রাযি.) ইসলাম গ্রহণের কাহিনীতে এসেছে, তিনি মদীনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এলেন। মদীনায় এসে ইসলাম গ্রহণ করার জন্য আল ওয়ালীদ বিন ওয়ালীদ তাকে চিঠি লিখে পাঠিয়েছিলেন। খালেদ (রাযি.) বলেন, আমার ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে তিনি আমাকে বললেন, দ্রুত চলো। তোমার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সংবাদ দেয়া হয়েছে। তিনি খুশি হয়েছেন। তিনি এখন তোমাদের অপেক্ষায় আছেন- তখন তার সঙ্গে আমর ইবনুল আস ও উসমান বিন তালহাও ছিলেন। অতঃপর আমরা যথাসম্ভব দ্রুত গেলাম, দূর থেকে তাকে তাকিয়ে দেখলাম। তাঁর সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ানোর পূর্ব পর্যন্ত তিনি মৃদুভাবে হাসতেই থাকলেন। আমি তাঁকে সালাম জানালাম, তিনি হাসিমুখে সালামের উত্তর দিলেন। আমি বললাম, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং আপনি আল্লাহর রাসুল। তিনি বললেন, এসো। এরপর বললেন,‘সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি তোমাকে হিদায়েত দিয়েছেন। আমি জানতাম, তোমার বুদ্ধি আছে, যা তোমাকে ভালো ছাড়া অন্য কিছুতে সোপর্দ করবে না।’ [সীরাতে ইবনে কাছীর ২/৪০৮] আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ-প্রক্রিয়া শাহাদাতাইনের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়, উল্লিখিত হাদিসসমূহ ও ঘটনাপঞ্জি আহলে সুন্নতের ঐকমত্যপূর্ণ এ মূলনীতিটিকেই নির্দেশ করছে। অতএব এ সব টেক্সেটের আলোকে, কোনো ব্যক্তি মুসলমান হয়েছে বলে ততক্ষণ পর্যন্ত বলা যাবে না যতক্ষণ না সে জিহবা ও অন্তর দ্বারা শাহাদাতাইনের স্বীকারোক্তি দেয়। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি শাহাদাতাইনের স্বীকারোক্তি দেবে, তাকে কাফের বলে আখ্যা দেয়া যাবে না, যতক্ষণ না তার দ্বারা এমন বিষয় সংঘটিত হয়, যা উল্লিখিত দু-বিষয়ের অথবা দুটোর যেকোনো একটির স্বীকারোক্তিকে নস্যাৎ করে দেয়। আরেকটি বিষয় হলো, ইসলামে প্রবেশের জন্য শুধু এক বিষয়ে স্বীকারোক্তি দিলে হবে না, বরং দু-বিষয়ে একসঙ্গে স্বীকারোক্তি দিতে হবে। প্রশ্ন হতে পারে, উল্লিখিত কিছু হাদিসে এবং অন্যান্য হাদিসে শুধু এক বিষয়ে স্বীকারোক্তির কথা আছে, অর্থাৎ لا إله إلا الله । এর জবাব, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ দ্বারা দু-বিষয়ের স্বীকারোক্তিই উদ্দেশ্য; কেননা অন্যান্য হাদিস যেখানে শাহাদাতাইন পুরোটা রয়েছে তা উল্লিখিত হাদিসের ব্যাখ্যা হিসেবে গণ্য। [নববী প্রণীত সহিহ মুসলিমের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ১/২১৯] শাহাদাতাইন উচ্চারণ করা এবং অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করা, ইসলাম ও ঈমানে প্রবেশ করা এবং জাহান্নামের স্থায়ী আবাস থেকে নাজাত পাওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়, যদি এর সঙ্গে উভয় বিষয়ের স্বীকারোক্তি অথবা যেকোনো একটির স্বীকারোক্তি নস্যাৎকারী কোনো কিছু সম্পৃক্ত থাকে- এ বিষয়ে আলেমদের মধ্যে কোনো বিতর্ক নেই। অতএব যদি কেউ বলে, আমি স্বীকার করছি, আল্লাহর ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রাসুল, তবে আমি স্বীকার করি না যে জাকাত ও হজ্ব ফরজ; ব্যভিচার, হত্যা, রিবা এবং অন্যান্য ইসলামের বিধানাবলি যা আল-কোরানে এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসে এসেছে এবং যা দ্বীনের স্বতঃসিদ্ধ বিষয় হিসেবেও খ্যাত, আমি এসব মানি না, অথবা যদি বলে, আমি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাত স্বীকার করে নিচ্ছি, তবে আমি মনে করি, তা ছিল বিশেষ জাতি বা বিশেষ প্রজন্ম বা বিশেষ যুগের জন্যে নির্দিষ্ট, অথবা যদি শাহাদাতাইনের স্বীকারোক্তি দেওয়ার পাশাপাশি, এর সঙ্গে নিজস্ব ব্যাখ্যা যুক্ত করে নেয়, যার ফলে আল্লাহ তাআলার গুণাবলি ও নাম বিষয়ক কিছু তাওহিদ বাতিল হয়ে যায়, অথবা শাহাদাতাইনের স্বীকারোক্তি দিল ঠিকই কিন্তু আল-কোরানের কোনো কিছু অস্বীকার করল, হোক তা একটি আয়াত কি একটি শব্দ, তা হলে এ স্বীকারোক্তির আদৌ কোনো মূল্য থাকবে না; কারণ এ ক্ষেত্রে উল্লিখিত স্বীকারোক্তির সঙ্গে-সঙ্গে কুরআনের প্রতি অস্বীকৃতি, রাসূলের প্রতি অস্বীকৃতিও যুক্ত করা হয়েছে। [কাশফুশ্শুবুহাত পৃ. ১৪১-১৪২] অনুরূপভাবে, যদি কোনো ব্যক্তি অন্যকোনো সম্প্রদায়ভুক্ত হয়, তাহলে সে সম্প্রদায়ের আকীদা-বিশ্বাস, নীতি-আদর্শ, শাহাদাতাইন দ্বারা ততক্ষণ পর্যন্ত নাকচ হবে না যতক্ষণ না শাহাদাতাইনের সঙ্গে সে সব আকীদা-বিশ্বাস, নীতি-আদর্শ বর্জন করার ঘোষণা না দেওয়া হবে। অতএব যদি কোনো ব্যক্তি তাওহিদে বিশ্বাসী হয় এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহর রাসুল হিসেবে মেনে নেয়, কিন্তু এই ভাবনা নিয়ে যে তাঁর রিসালত ছিল সুনির্দিষ্ট একটি জাতির জন্য, অথবা সুনির্দিষ্ট একটি কালের জন্য, তাহলে এ ব্যক্তি মুসলমান হওয়ার জন্য শাহাদাতাইনের স্বীকারোক্তি যথেষ্ট হবে না। বরং এর সঙ্গে তাকে এ ব্যাপারেও স্বীকারোক্তি দিতে হবে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমস্ত মানুষের প্রতি প্রেরিত হয়েছেন। [দেখুন: নববী প্রণীত সহিহ মুসলিমের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ১/১৪৯; শারহুসসিয়ার আল কাবীর ১/১৫০; ইবনে কদাম, আল মুগনী ৯/২১] এ বিষয়ে আলেমদের কেউ-কেউ একটি সাধারণ নীতির কথা বলেছেন। নীতিটি হলো, শাহাদাতাইনের স্বীকারোক্তি কেবল তখনি একজন মানুষকে মুসলিম খেতাবে ভূষিত হওয়ার যোগ্য করে তোলে, যখন তার এ স্বীকারোক্তি সকল বাতিল আকীদা-বিশ্বাসকে নস্যাৎকারী হিসেবে যথেষ্ট হবে যা সে পূর্ব থেকে ধারণ করে এসেছে। আর যদি এর অন্যথা হয়, তাহলে সে-বাতিল বিশ্বাসগুলো থেকে পবিত্র হওয়ার ঘোষণাও উচ্চারণ করতে হবে; কারণ তা নস্যাৎকারী কোনো বক্তব্য শাহাদাতাইনের আওতায় শামিল হয়নি। [দেখুন শারহুসসিয়ার আল কাবীর ১/১৫০] উল্লেখ্য যে, ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই’ এ ঘোষণা, আল্লাহ সম্পর্কে, তাঁর রুবুবিয়াত ও উলুহিয়াত সম্পর্কে সকল বাতিল আকীদা-ধারণা নস্যাৎ করে দেয়। কেননা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর দাবি হলো আল্লাহ তাআলাকে তাঁর সত্তায়, গুণাবলিতে, নামে ও কর্মে অদ্বিতীয় ইলাহ হিসেবে বিশ্বাস করা এবং যা-কিছু তার সঙ্গে যুক্ত হতে পারে না, তা থেকে তাঁকে পবিত্র করা। অতএব যে ব্যক্তি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ উচ্চারণ করে, সে আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে সকল বাতিল আকীদার প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে। আর দ্বিতীয় সাক্ষ্যটি -অর্থাৎ ‘মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর রাসুল’- মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অবস্থান বিষয়ক অধিকাংশ বাতিল আকীদা নস্যাৎ করে দেয় এবং তিনি যেসব অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে সংবাদ দিয়েছেন, তার সবগুলোর প্রতি স্বীকারোক্তি জ্ঞাপন করে। তবে এ স্বীকারেক্তি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অবস্থান বিষয়ক কিছু বাতিল আকীদাকে নস্যাৎ করে না। যেমন তাঁর রিসালতকে বিশেষ জাতি বা বিশেষ যুগের জন্য সুনির্দিষ্ট মনে করা। যারা এরূপ মনে করে তাদের শাহাদাতাইনের স্বীকারোক্তির পাশাপাশি এ বিষয়েও স্বীকারোক্তি জ্ঞাপন করতে হবে যে, তাঁর রিসালত হলো ব্যাপক, অর্থাৎ সকল জাতির জন্য এবং তাঁর প্রেরিত হওয়ার সময় থেকে কেয়ামত পর্যন্তের জন্য। যারা শুরু থেকেই ঈমানহারা তথা কাফের, ইতোপূর্বে যারা আল্লাহর দ্বীনে দাখেল হয়নি তাদের ইসলাম গ্রহণের পদ্ধতি কি, তা আমরা ওপরের পৃষ্ঠাগুলোয় আলোচনা করলাম। আর যে ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণের পর মুরতাদ হয়েছে, ঈমানের যে বিষয়গুলো অস্বীকার করার কারণে সে মুরতাদ হয়েছে, তা মেনে নেওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে মুসলমান হিসেবে গণ্য করা হবে না। এর সঙ্গে শাহাদাতাইনের স্বীকারোক্তিও তাকে নতুনভাবে দিতে হবে। অতএব যদি তাওহিদ অস্বীকার করা অথবা রিসালত অস্বীকার করার কারণে মুরতাদ হয়ে থাকে, তবে এ দুটোর স্বীকারোক্তি দেওয়াই পুনরায় ইসলামে ফিরে আসার জন্য যথেষ্ট হবে। পক্ষান্তরে, যদি অন্যকিছু অস্বীকার করার কারণে মুরতাদ হয়ে থাকে, তাহলে নতুনভাবে শাহাদাতাইনের স্বীকারোক্তির পাশাপাশি যে বিষয়টি সে অস্বীকার করেছে তারও স্বীকারোক্তি দিতে হবে। [ইবনে কুদামা, আল মুগনী ৯/২১; হাশিয়ায়ে ইবনে আবেদীন:৩/৩৯৭ ] উদাহরণত যদি কেউ জাকাত ফরজ হওয়াকে অস্বীকার করে, অথবা সুদ ও ব্যভিচার হারাম হওয়াকে অস্বীকার করে, তবে সে ততক্ষণ পর্যন্ত নতুনভাবে মুসলমান হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে সাক্ষ্য দেবে যে আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর রাসুল এবং যা ফরজ হওয়া অথবা হারাম হওয়া অস্বীকার করেছে, তা ফরজ হওয়া অথবা হারাম হওয়া স্বীকার করে নেবে। শাহাদাতাইনের মৌখিক স্বীকারোক্তি দিলেই একজন মানুষ মুসলমান হিসেবে গণ্য হবে, আলেমদের কেউ এ ব্যাপারে দ্বিমত করেননি, ঈমানের হাকিকত অধ্যায়ে এ ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। তবে মৌখিক স্বীকারোক্তি দাতাকে মুসলমান হিসেবে গণ্য করার বিষয়টি একটি ইহলৌকিক ব্যাপার। অর্থাৎ তা পার্থিব হুকুএ আহকাম আরোপিত হওয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত। পরকালীন মুক্তি ও চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামে অবস্থান করা থেকে নাজাতের জন্য মৌখিক স্বীকারোক্তির সঙ্গে অন্তরের স্বীকৃতিও অবশ্য প্রয়োজন। অতএব যে ব্যক্তি, উল্লিখিত শর্তগুলো বাস্তবায়নপূর্বক শাহাদাতাইনের মৌখিক স্বীকারোক্তি দেবে, ইহকালীন জীবনে ইসলামের দাবি অনুযায়ী আমল করবে, তাকে মুসলমান হিসেবে গণ্য করা হবে, যদিও সে অন্তরে মুনাফেক থাকে। কারণ বাহ্য অবস্থার ওপর ভিত্তি করেই ইহকালীন হুকুএ আহকাম আরোপ করার নির্দেশ আমাদের দেওয়া হয়েছে। আর অন্তরের বিষয়টি আল্লাহর জন্য ছেড়ে দিতে বলা হয়েছে। কারণ একমাত্র আল্লাহর তাআলাই অন্তর্জামী, অন্য কারও পক্ষে অন্তরের সংবাদ জানা সম্ভবপর নয়। উসামা (রযি.) একব্যক্তির বাহ্যিক স্বীকারোক্তি গ্রহণ না করে, এই ভেবে তাকে হত্যা করে ফেলেন যে, লোকটি অন্তর থেকে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলেনি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার এ আমলকে নাকচ করে দিয়েছেন, বিষয়টি ওপরে আলোচিত হয়েছে। মূল : ড. মুহাম্মাদ নাঈম ইয়াসিন বাংলা অনুবাদ : ড. মাওলানা শামসুল হক সিদ্দিক