ছবি সংগৃহীত

ঐতিহ্যে-সংস্কৃতিতে বাদ্যযন্ত্র

nusrat jahan champ
লেখক
প্রকাশিত: ০৩ এপ্রিল ২০১৩, ০৪:৫৪
আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০১৩, ০৪:৫৪

কণ্ঠসঙ্গীত বা গান এবং যন্ত্রসঙ্গীত বা তান শিল্পকলার অত্যন্ত শৃঙ্খলিত ও সুনিয়ন্ত্রিত বিষয়। এলোমেলো কথা-সুরে যেমন গান হতে পারে না, তেমনি বাদ্যযন্ত্রে বিচ্ছিন্ন আঘাতে তানের সৃষ্টি হতে পারে না। সুরের ছন্দসুষমায় ইন্দ্রীয় ও হৃদয়কে আচ্ছন্ন করাই সঙ্গীতের তথা গান ও তানের উদ্দেশ্য। কণ্ঠসঙ্গীত ও যন্ত্রসঙ্গীত সঙ্গীতকলার দুটি অঙ্গ, তবে তারা পরস্পর নির্ভরশীল নয়। অর্থাত্‍, বাদ্যযন্ত্র ছাড়া গান বা কণ্ঠ ছাড়া তান সৃষ্টি করা যাবে না তা নয়। গানের কথা ও সুর কণ্ঠ ও যন্ত্র দিয়ে আলাদাভাবে ফুটিয়ে তোলা যায়। তবে এই দুইয়ের সংমিশ্রণে সুর পূর্ণাঙ্গতা লাভ করে, সুরের মাধুর্য বৃদ্ধি পায়। বাদ্যযন্ত্র শুধু সুর সৃষ্টি করে না, তালও সৃষ্টি করে! এ কারণেই নৃত্যকলায় বাদ্যের তালসঙ্গত অপরিহার্য। নৃত্য যাতে বেতাল হয়ে না যায় বা গতিহারা না হয়, সেজন্য বাদ্যযন্ত্রের সুষম সঙ্গতের প্রয়োজন হয়। সঙ্গীতে ও নৃত্যে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারের ব্যাপকতা ও প্রাধান্য থাকলেও ধর্মকর্ম, উত্‍সব-অনুষ্ঠান, শোভাযাত্রা, যুদ্ধযাত্রা ইত্যাদিতেও বাদ্যযন্ত্রের সরব উপস্থিতি দেখা যায়। ভারতীয় সঙ্গীতশাস্ত্রে চার বাদ্যযন্ত্রকে চার শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। যেমন - ১. তত - তার যোগে যে বাদ্য বাজে : একতারা, দোতারা, বীণা, সেতার ইত্যাদি। ২. শুষির - ফুঁ দিয়ে যে বাদ্য বাজে : বাঁশি, শঙ্খ, সানাই ইত্যাদি। ৩. ঘন - ধাতু দিয়ে তৈরি বাদ্যযন্ত্র, আঘাত দিয়ে বাজানো হয় : কাঁসর, করতাল, মন্দিরা, ঘণ্টা ইত্যাদি। ৪. আনদ্ধ - চর্মাচ্ছাদিত বাদ্যযন্ত্র, আঘাত দিয়ে বাজানো হয় : ঢাক, ঢোল, তবলা, খোল, মাদল, ডুগডুগি ইত্যাদি। পাশ্চাত্য পণ্ডিতরা আবার বাদ্যযন্ত্রকে তিন ভাগে ভাগ করেন। যেমন - ১. String Instrument - সুতা বা তার যোগে ধ্বনিত বাদ্য : বেহালা, গিটার, পিয়ানো ইত্যাদি। ২. Wind Instrument - ফুঁ বা বাতাসের সাহায্যে যে বাদ্যযন্ত্র বাজানো হয় : হারমোনিয়াম, একর্ডিয়ান, ট্রাম্পেট, মাউথ অর্গান ইত্যাদি। ৩. Instrument of Percussion - আঘাত দিয়ে যে বাদ্য বাজে : ড্রাম, বেল, গং ইত্যাদি। বাদ্যযন্ত্র শুধু সঙ্গীত আর নৃত্যে নয়, বরং ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির নানা দিকের সাথে জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে। কোনো কোনো সম্প্রদায়ের ধর্মাচরণ ও সামাজিক অনুষ্ঠানে বাদ্যধ্বনি অপরিহার্য বলে গণ্য করা হয়। যেমন - হিন্দুমন্দিরে আরতির সময় সময় ঘণ্টাধ্বনি করা হয়, বৌদ্ধমন্দির বা গির্জাতেও ঘণ্টা দিয়ে প্রার্থনার লগ্ন সূচনা করা হয়। খোল-মন্দিরা-করতাল ছাড়া বৈষ্ণবদের কীর্তনের আসর বসে না, কীর্তন তাদের ধর্মসাধনার অঙ্গ। আবার, ঢাক-ঢোল-কাঁসর ছাড়া হিন্দুদের পূজামণ্ডপ জমে না, ঢাকে বাড়ি দিয়েই দুর্গাপূজার উদ্বোধন করা হয়। হিন্দুধর্মে সঙ্গীতকে 'দেবদত্ত' বলে মনে করা হয়। তাই নানা সামাজিক অনুষ্ঠানেও রয়েছে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার। যেমন - বিয়ে বা শিশুর জন্ম। শবযাত্রা ও শোভাযাত্রাতেও নানান বাদ্য বাজানো হয়। মুসলমানদের মহরমের মিছিলে ঢোল, কাড়া, কাঁসর ইত্যাদি বাজানো হয়। অতীতে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই যুদ্ধক্ষেত্রে ঢাক-ঢোল, কাড়া-নাকাড়া, শিঙ্গা, দামামা ইত্যাদি ব্যবহৃত হতো। লোকসমাজে ব্যবসায়বৃত্তিতেও বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। যেমন - সাপুড়ে বীণ বা তুবড়ি বাজিয়ে সাপের খেলা দেখায়, ডুগডুগি বাজিয়ে বানর ও ভাল্লুকের খেলা দেখিয়ে অনেকে জীবিকা অর্জন করে, অনেক ফেরিওয়ালা ঘণ্টা বাজিয়ে বা ঘুঙুর পায়ে ফেরি করে, খঞ্জনি বাজিয়ে ভিখারীদের ভিক্ষা করতে দেখা যায়। বাদ্যযন্ত্রকে কেন্দ্র করে নানা সংস্কারও লোকসমাজে প্রচলিত আছে। বিশেষ করে আদিবাসী সমাজে এর দেখা মেলে বেশি। বাদ্যযন্ত্র শুধু পূজা বা উপাসনার অঙ্গ হিসেবে নয়, দেবতাজ্ঞানেও কোথাও কোথাও এর পূজা করার রীতি আছে! পলিনেশিয়ানরা 'ড্রাম' কে তাদের দেবতা Tane-এর ঐশীশক্তির প্রতিভূ বলে মনে করে ও পূজা করে। বাতুম আদিবাসী ড্রামকে রাজশক্তির প্রতীক বলে মনে করে। ডাচগিনির নিগ্রোরা ড্রামের আত্মা আছে বলে বিশ্বাস করে। অরকানোস জাতির লোকরা মনে করে ড্রামের রোগ নিরাময় ক্ষমতা রয়েছে। মালয়বাসীরা মনে করে ড্রামাদি বাজিয়ে দেবতা বা আত্মাকে আহবান করা যায়। পূজা ছাড়া মন্দিরে রক্ষিত ঢাক, বাঁশি বাজালে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। লোকসমাজে ব্যবসায়বৃত্তিতেও বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। যেমন - সাপুড়ে বীণ বা তুবড়ি বাজিয়ে সাপের খেলা দেখায়, ডুগডুগি বাজিয়ে বানর ও ভাল্লুকের খেলা দেখিয়ে অনেকে জীবিকা অর্জন করে, অনেক ফেরিওয়ালা ঘণ্টা বাজিয়ে বা ঘুঙুর পায়ে ফেরি করে, খঞ্জনি বাজিয়ে ভিখারীদের ভিক্ষা করতে দেখা যায়। বাদ্যযন্ত্রকে কেন্দ্র করে নানা সংস্কারও লোকসমাজে প্রচলিত আছে। বিশেষ করে আদিবাসী সমাজে এর দেখা মেলে বেশি। বাদ্যযন্ত্র শুধু পূজা বা উপাসনার অঙ্গ হিসেবে নয়, দেবতাজ্ঞানেও কোথাও কোথাও এর পূজা করার রীতি আছে! পলিনেশিয়ানরা 'ড্রাম' কে তাদের দেবতা Tane-এর ঐশীশক্তির প্রতিভূ বলে মনে করে ও পূজা করে। বাতুম আদিবাসী ড্রামকে রাজশক্তির প্রতীক বলে মনে করে। ডাচগিনির নিগ্রোরা ড্রামের আত্মা আছে বলে বিশ্বাস করে। অরকানোস জাতির লোকরা মনে করে ড্রামের রোগ নিরাময় ক্ষমতা রয়েছে। মালয়বাসীরা মনে করে ড্রামাদি বাজিয়ে দেবতা বা আত্মাকে আহবান করা যায়। পূজা ছাড়া মন্দিরে রক্ষিত ঢাক, বাঁশি বাজালে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। বাংলাদেশের লোকসমাজেও কোনো কোনো বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারে শুভাশুভ জড়িত রয়েছে। শঙ্খ ও সানাই মাঙ্গলিক বাদ্য। রাতের বেলায় বাঁশির সুর অমঙ্গলজনক। গৃহপ্রাঙ্গণে রাতে বাঁশি বাজালে সাপ বা ইঁদুরের উপদ্রব বাড়ে। শিল্প ও সংস্কৃতি চর্চায়, ধর্ম ও সমাজে এমনকি ব্যবহারিক কর্মক্ষেত্রেও রয়েছে বাদ্যযন্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার। শিল্পকলার এই সুকুমারচর্চা মানুষের জীবনে ও লোকসমাজের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। তাই বলা যায়, বাদ্যযন্ত্র জাতিতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব ও শিল্পতত্ত্ব নিরূপনের একটি মূল্যবান মাধ্যম।