শঙ্খশিল্প অত্যন্ত প্রাচীন একটি লোকশিল্প। পণ্ডিতদের মতে, প্রায় দু হাজার বছর আগে দক্ষিণ ভারতে শঙ্খশিল্পের উদ্ভব ঘটে । হিন্দু ধর্মের বিয়ে থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যাবতীয় কাজকর্ম শঙ্খ দিয়ে আবৃত । পূজা-অর্চনার কাজে গঙ্গাজল পাওয়া না গেলে শঙ্খধোয়া জল ব্যবহার করা হয় - হিন্দুশাস্ত্রে শঙ্খ এতটাই গুরুত্বপূর্ণ!
শঙ্খ অলংকারের ইতিহাসেও অতি প্রাচীন স্মৃতি বহন করে। শাঁখা সিঁদুর সনাতন হিন্দু ধর্মের চিহ্ন। হিন্দু সধবা মেয়ের জন্য হাতের শাঁখা অপরিহার্য। বিয়ের সময় গায়ে হলুদের দিন ধান-দূর্বা ও সিঁদুর দিয়ে একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শঙ্খের বালা নবপরিণীতাকে পরানো হয়। স্বামীর মৃত্যুতে এ শাঁখা ভেঙ্গে ফেলা হয় ।
যারা শঙ্খের জিনিস তৈরি করে তাদের শঙ্খকার বা শাঁখারি বলে। শঙ্খ ও শঙ্খ দিয়ে তৈরি জিনিস ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যে এদের জীবিকা সীমাবদ্ধ। শঙ্খ সামুদ্রিক শামুক গোত্রের প্রাণী। দক্ষিণ ভারতের উড়িষ্যা,পুরী,কর্নাটকের সমুদ্রসৈকত এলাকায় জীবন্ত শামুক ধরা হয়। তারপর সেদ্ধ করে এর নরম শরীরটা ফেলে দিয়ে রোদে শুকিয়ে নেয়া হয়। এরপর বিভিন্ন জায়গায় কাঁচামাল হিসেবে পাঠানো হয়। এর মধ্যে শঙ্খধ্বনি দেয়ার জন্য বিশেষ প্রজাতির শামুক ধরা হয়, যা হিন্দু ধর্মের নানা পূজা-অর্চনায় ব্যবহার করা হয়।

শাঁখা বা শঙ্খের অলংকার তৈরির জন্য বিশেষ কয়েকটি প্রজাতির শঙ্খ ব্যবহৃত হয়। এ প্রজাতিগুলো হলো - তিতপুটী, রামেশ্বরী, ঝাঁজি, দোয়ানী, মতি-সালামাত, গারবেশী, কাচ্চাম্বর, ধলা, জাডকি, কেলাকর, জামাইপাটী, এলপাকারপাটী, গড়বাকী, সুরতী, খগা ইত্যাদি। একটি বড় শঙ্খে ৮/১০ টি শাঁখা তৈরি হয় । শঙ্খের ছোট ছোট টুকরা দিয়ে কানের দুল ,মালা ,আংটি ,ক্লিপ ,খোপার কাঁটা ,ব্রেসলেট ,সেফটিপিন, বোতাম, পুঁতি ইত্যাদি তৈরি করা হয়।
শাঁখের গুঁড়া গুটি বসন্তের দাগ ওঠানোর জন্য পাউডার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। হাতের শাঁখার নানা ধরনের নাম পাওয়া যায়। যেমন - টালী, লাইনসোড, চিত্তরঞ্জন, পানবোট, সোনা বাঁধানো, সতীলক্ষ্মী, হাঁইসাদার, দানাদার, ভেড়াশঙ্খ, লতাবালা, ধানছড়ি, চৌমুক্ষি, জয়শঙ্খ, পাথুরহাটা, গোলাপফুল, মুড়িদার, আঙ্গুরপাতা, বেণী, নাগরী বালা ইত্যাদি ।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শঙ্খশিল্পের কেন্দ্র রয়েছে । পুরান ঢাকার শাঁখারি বাজার শঙ্খশিল্পের প্রধান কেন্দ্র । এছাড়া বরিশাল , ঝালকাঠি , খুলনা , গৌরনদী , চট্টগ্রাম , টাঙ্গাইল , রংপুরসহ আরো বেশ কিছু অঞ্চলে শঙ্খশিল্পীদের কর্মকান্ড পরিচালিত হয় । একজোড়া শাঁখার দাম নির্ভর করে এর গঠনশৈলীর ওপর । যত সূক্ষ্ম কাজ , তত দাম বেশি । শাঁখার দাম শুরু হয় প্রতি জোড়া ২০০ টাকা থেকে ২৫০০০ টাকা পর্যন্ত ! সৌন্দর্য বৃদ্ধি এবং মজবুত করার জন্য শাঁখা সোনা বা রূপা দিয়ে বাঁধানো হয় । সোনা ও রূপা ছাড়াও মূল্যবান পাথরও শাঁখায় সংযোজন করা যায়

শঙ্খশিল্প উদ্ভবের কারণ হিসেবে বেশ কিছু পৌরাণিক কাহিনী পাওয়া যায় । তবে শাঁখা কেন সধবা হিন্দু নারীর আবশ্যক অলংকার হলো সে কাহিনীটি বেশ চমত্কার -
একবার দেবসভায় এক বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ওই অনুষ্ঠানে শিব-পার্বতীও আমন্ত্রিত হন । কিন্তু অনুষ্ঠানে যোগ পরার মতো কোনো অলংকার তার ছিল না । তিনি পড়লেন মহাসংকটে । স্বর্গলোকের সকল দেবীর দেহে যেখানে অলংকার শোভা পাবে, সেখানে তিনি নিরাভরণ বেশে যান কেমন করে? বিব্রত শিব বিশ্বকর্মার কাছে সহায়তা চাইলেন ।
কিন্তু বিশ্বকর্মা শিবকে জানালেন যে, পৃথিবীর সব রত্ন আগেই আহৃত হয়েছে এবং সেসব রত্নের অলংকার পরেই দেবীরা স্বর্গলোকের অনুষ্ঠানে যাবেন । একমাত্র সিন্ধুতলের শঙ্খই অবশিষ্ট আছে, যা দিয়ে তিনি পার্বতীর জন্য উত্কৃষ্ট অলংকার তৈরি করে দিতে পারবেন । অগত্যা শিব তাতেই রাজি হলেন । পার্বতী যখন শঙ্খ-অলংকার পরে দেবসভায় গেলেন , তখন শঙ্খের উজ্জ্বল শুভ্র আলোয় দেবীদের রাশি রাশি মণিমাণিক্য ম্লান হয়ে গেল । তখন থেকেই বিবাহিতা হিন্দু নারীর শ্রেষ্ঠ অলংকার হলো একজোড়া শাঁখা ।