
ছবি সংগৃহীত
ঐতিহ্যবাহী টমটম গাড়ি
আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৩, ০৯:০২
ছোটবেলায় টমটম গাড়ি নিয়ে কমবেশি সবারই খেলা হয়েছে। টমটম গাড়ি বানানো হত মাটির ছোট হাড়ির উপরে শক্ত কাগজ লাগিয়ে। হাড়ির দুই পাশে মাটির দুইটি স্বাস্থ্যবান চাকা থাকত। আর চাকার সাথে সংযুক্ত থাকত দুইটা কাঠি। সুতলি দিয়ে বেঁধে টমটম গাড়ি চালাতে হত। টমটম গাড়ি চালালে চাকার সাথে আটকানো কাঁঠি দুইটা শক্ত কাগজে ক্রমাগত আঘাত করত আর অটোমেটিক টং টং টং টং টং টং শব্দ হত। কি কিছুক্ষনের জন্য শৈশবে ফিরে গেলেন তো! সত্যিকারের ঘোড়ার গাড়িও মূলত টমটম গাড়ি নামেই পরিচিত। দুই বা ততোধিক ঘোড়ার সাহায্যে এই গাড়ি টানা হয়। এই টমটম গাড়ির ইতিহাসটা বেশ পুরনো। টমটম গাড়ির ইতিহাস ইংরেজ শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম ঘোড়ার গাড়ি বা টমটম গাড়ির প্রচলন শুরু হয়। ব্রিটিশদের পৃষ্ঠপোষকতায় ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে কলকাতা থেকে প্রথম ঢাকার রাস্তায় ঘোড়ার গাড়ি নামানোর ব্যবস্থা করা হয়। আর্মেনীয়রা আঠারো ও উনিশ শতকের প্রথমদিকে ঢাকা শহরে বসবাসকারী একটি প্রভাবশালী সম্প্রদায়। সেসময় এরা ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় দোকান খুলেছিল। তার মধ্যে শাঁখারীবাজারের ‘সিরকো অ্যান্ড সন্স’ অন্যতম। এ দোকানে বিভিন্ন ইউরোপীয় জিনিসপত্র বিক্রি হত। ১৮৫৬ সালে সিরকোই প্রথম ঢাকায় ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন করেন যা তখন- ঠিকা গাড়ি নামে পরিচিল ছিল। পরবর্তীকালে ঘোড়ার গাড়ি বা ঠিকা গাড়িই ঢাকা শহরের প্রধান যানবাহনে পরিণত হয়েছিল। আর সে সময় এ দেশের বড় শহর থেকে ধীরে ধীরে মফস্বল শহরেও এর প্রচলন ঘটে। তখন থেকে ইংরেজদের পাশাপাশি দেশীয় জমিদার ও অভিজাত শ্রেণীর লোকজন ঘোড়ার গাড়িকে বাহন হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। বিভিন্ন রকম টমটম গাড়ি গঠন, বৈশিষ্ট্য ও নামের দিক থেকে টমটম গাড়ির অনেক ভিন্নতা দেখা যায়। এই গাড়ি কখনো দুই চাকা আবার কখনো চার চাকাবিশিষ্ট হয়। টমটম গাড়ির চারদিক সাধারণত খোলা হলেও কোথাও কোথাও দুই দিকে রঙিন কাচের জানালাসহ আবৃত আসনবিশিষ্ট গাড়িরও দেখা মেলে। এর চাকাগুলো কাঠের তৈরি হয়ে থাকে এবং আকারে বেশ বড় হয়। ঢাকা শহরেই মূলত ঘোড়াচালিত এই গাড়ি টমটম গাড়ি নামে পরিচিত। কোথাও কোথাও একে টাঙ্গা, জুড়ি গাড়ি কিংবা এক্কা গাড়িও বলে। টমটম গাড়ির চালকরা কোচোয়ান বা সহিস নামে পরিচিত। লোহার ও স্টিলের তৈরি দুই ধরনের ঘোড়ার টমটম রয়েছে পুরান ঢাকায়। এক জোড়া ঘোড়াসহ একটি গাড়ির দাম আড়াই লাখ থেকে চার লাখ টাকা পর্যন্ত। যাত্রী পরিবহন ছাড়াও ঘোড়ার টমটম ব্যবহৃত হয় বিয়ে, পূজা, বিভিন্ন দিবসের শোভাযাত্রায়, সিনেমার শ্যুটিং ইত্যাদি কাজে। এসব কাজে টমটমকে ফুল দিয়ে সুসজ্জিত করে সাজানো হয়। কোচোয়ান ও হেলপারের জন্যও ওইসব অনুষ্ঠানের সময় রয়েছে বিশেষ পোশাক। টমটম গাড়ির খোঁজ আধুনিক যানবাহনের ভিড়ে টমটম গাড়ির নিত্য চলাচল তেমন একটা চোখে না পড়লেও পুরান ঢাকার গুলিস্তান থেকে সদরঘাট পর্যন্ত অল্প কয়েকটি গাড়ি প্রায়ই চলাচল করতে দেখা যায়। তবে রাজশাহী, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, দিনাজপুর, নওগাঁ এবং যশোর অঞ্চলের শহর ও গ্রামে এখনো মাঝেমধ্যে ঘোড়ার গাড়ি দিয়ে মালামাল ও যাত্রী পরিবহন করে। বড় বড় শহরে নিত্যদিনের বাহন হিসেবে টমটম গাড়ির দেখা না মিললেও বরযাত্রাসহ বিশেষ কোনো উৎসব, দিবস বা অনুষ্ঠানে জাঁকজমকভাবে সাজানো সারি সারি টমটম গাড়ি এ যুগেও সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ভাড়া কেমন যাতায়াতের অন্যান্য বাহনের মতো ঘোড়ার গাড়ির ভাড়াও স্থান ও দূরত্বের ওপর ভাড়া নির্ভর করে। ঢাকার ভেতরে ঘুরতে চাইলে ঘণ্টায় ১৫শ টাকা দিতে হয়। আর ঢাকার বাইরে ঘুরতে চাইলে ঘণ্টায় ৫ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হবে। আর সাধারণ যাতায়াতের জন্য গুলিস্তান থেকে সদরঘাট যেতে মাথাপিছু ভাড়া পড়বে ১০ টাকা। বড় বড় শহরে নিত্যদিনের বাহন হিসেবে টমটম গাড়ির দেখা না মিললেও বরযাত্রাসহ বিশেষ কোনো উৎসব, দিবস বা অনুষ্ঠানে জাঁকজমকভাবে সাজানো সারি সারি টমটম গাড়ি এ যুগেও সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তবে আধুনিক যন্ত্রচালিত যানবাহনের ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে অভিজাত বাহন হিসেবে খ্যাত টমটম গাড়ি প্রায় বিলুপ্তির পথে। কালক্রমে যান্ত্রিক সভ্যতার বিকাশের ফলে ঐতিহ্যবাহী এ বাহনটি প্রায় বিস্মৃত হতে বসেছে। হারিয়ে যাচ্ছে ঢাকার ৪০০ বছরের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য এ উপাদান। তবে এখনো গ্রামেগঞ্জে মাঝে মাঝে ঘোড়ার গাড়ি চোখে পড়ে। ঢাকা শহরেও এটি টিকে আছে অনেকটা ঐতিহ্য আর আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে।
- ট্যাগ:
- লাইফ