
ছবি: রাজীন চৌধুরী
এরাই আমাকে জামায়াত বানিয়েছে: আল মাহমুদ
আপডেট: ১০ জুলাই ২০১৫, ১৩:৫৪
(প্রিয়.কম) ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কবি আল মাহমুদ। তার প্রকৃত নাম মীর আব্দুস শুকুর আল মাহমুদ। তিনি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি। ১১ জুলাই এই কবি ৮৩ বছরে পা দিচ্ছেন। তার ব্যক্তি ও কবি জীবনের নানান চিন্তা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন প্রিয়.কমের সঙ্গে। তার সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন গোলাম রাব্বানী ও দীপান্বিতা ইতি। ছবি তুলেছেন রাজীন চৌধুরী।
অলস দুপুর। রোদের ঘ্রাণ মেখে শরীরে আমরা হাজির হই মগবাজারের গৌমতী আয়েশা ভিলায়। এ বাড়ির এক ফ্লাটে থাকেন কবি আল মাহমুদ। আলো আঁধারের মাঝে কবির ঘুম ঘরেই বসে চলে আড্ডা। বিছানার মাঝখানে মধ্যমণি হয়ে বসেন কবি। কথা চলে আমাদের...
প্রিয়: কেমন আছেন?
আল মাহমুদ: ভালো আছি...
প্রিয়: শুনলাম আজ সন্ধ্যায় একটা দাওয়াতে যাবেন...
আল মাহমুদ: আমার গাড়িও নাই, লোকজনও নাই। তাই ইচ্ছা করলেই কোথাও যেতে পারি না। অনেক দাওয়াত থাকে কিন্তু যাওয়া হয় না।
প্রিয়: এই আশি বছরেও একটা গাড়ি কিনতে পারলেন না।
আল মাহমুদ: আরে ভাই কি বলব আর সে দুঃখের কথা। করতে পারিনি। ছেলে-মেয়েদের কারণে হলো না। শুধু টাকা চায়। দিয়েছি টাকা। কিন্তু তারা তো আর কেউ আমার সঙ্গে থাকল না।
প্রিয়: দেশের প্রধান কবি এবং সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে সরকার কি আপনাকে একটা গাড়ি দিতে পারে না...
আল মাহমুদ: [একটু ভাবলেন চোখ তুলে] সে তো আর আমি জানি না। সরকার তো আমার বশ না।
প্রিয়: শোনা যায় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় থাকতে আপনাকে একটি বাড়ি দিয়েছিলেন উপহার...
আল মাহমুদ: এরশাদ সাহেব আমাকে কোনো বাড়ি-টারি দেয় নাই। বনানীতে আমাকে একটা জমি দিয়েছিল। আমি বাড়ি করেছিলাম সেখানে। বাড়িটা করেছিলাম লোন করে। এদিকে ছেলেমেয়েরা পড়াশোনার জন্য সব বিদেশে গেল। তাদের পড়ালেখার খরচ জোগাড় করতে টাকা লাগে না ভাই? ফোন দিয়েই বলে আব্বা টাকা পাঠাও, আব্বা টাকা পাঠাও। এক কোটি ষাট লাখ টাকায় বাড়িটা বিক্রি করে দিলাম। আমি একটা মানুষ কবি, আমার সোর্স অব ইনকাম কি?

প্রিয়: লেখা...
আল মাহমুদ: এত টাকা কোথায় পাবো, বাড়িটা বিক্রি করে দিলাম। তোমরা কি জানতে চাও বলো?
প্রিয়: আপনি তো আশি পার করে ৮১ বছরে পা দিচ্ছেন। আপনি কি সকালের আকাশ হতে পারবেন না এ বয়সে?
আল মাহমুদ: এই যে কথা আছে না যে, একটা পৃথিবী নষ্ট হয়ে গেছে। আরেকটা পৃথিবীর দাবি। আদায় করতে লাগবে সকালের আকাশের মতো বয়স।
প্রিয়: আপনার কি সকালের আকাশ হবার মতো বয়স নেই?
আল মাহমুদ: না নেই।
প্রিয়: কেন?
আল মাহমুদ : বয়স হয়েছে না। বয়স তো শরীরে চিহ্ন রেখে যায়।
প্রিয়: আপনি কি নিজেকে ওল্ড ভাবেন?
আল মাহমুদ: সত্যি কথা বলতে কি একসময় সেটা অনুভব করি নাই। সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়িয়েছি। পৃথিবীর সবগুলো বড় শহরের ফুটপাত দিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি। প্যারিস, নিউইয়র্ক, লন্ডন সব বড় শহর।
প্রিয়: পর্যটক হয়ে ঘুরেছেন...
আল মাহমুদ : হ্যাঁ, ঘুরেছি, খেয়েছি, সেখানকার কবিদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছি।
প্রিয়: আপনার মনের বয়স কত ফিল করেন?
আল মাহমুদ: [হাসলেন] মনের বয়স তো হিসাব করা যায় না।
প্রিয়: মনের তো বয়স বাড়ে না।
আল মাহমুদ : না, বাড়বে না কেন, মনের বয়সও বাড়ে। কারণ কোনো কোনো ঘটনায় মন কষ্ট পায়, ধাক্কা খায়। এক একটা বছর পার হয় আর শরীরে ধাক্কা দিয়ে যায়।
প্রিয়: ধাক্কাটা কি শরীরে লাগে না মনে...
আল মাহমুদ : মাঝে-মধ্যে লাগে, মাঝে-মধ্যে লাগে না।
প্রিয়: আপনি তো ৮০ পার করে ৮১-তে পা দিচ্ছেন...
আল মাহমুদ: আপনার বাড়ি কই?
প্রিয়: হবিগঞ্জ, আপনার পাশের জেলা...
আল মাহমুদ: হুম, হবিগঞ্জ আমার দাদুর বাড়ি। আমার দাদু জমিদার ছিল। একটু অত্যাচারীও ছিল। যাই হোক। সব জমিদারই অত্যাচারী ছিল। আমার দাদা ছিলেন আব্দুল ওহাব মোল্লা। মোল্লা হলো আমাদের উপাধি। হ্যাঁ বলেন, আপনারা কিসের জন্য এসেছেন...
প্রিয়: আপনার সঙ্গে গল্প করতেই এসেছি...আপনার কথা শুনতে এসেছি।
আল মাহমুদ: আপনার বাড়ি কোথায় রে ভাই...
প্রিয়: হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ, গিয়েছেন নিশ্চয়ই। আমাদের একটা বড় রেল জংশন আছে...পাশেই খোয়াই নদী, সুতাং নদ।
আল মাহমুদ : আমি যাইনি, যেতেও পারি হয়তো...মনে নেই।
প্রিয়: আপনি কি এখন নিয়মিত লিখতে পারেন... যতটুকু জানি আপনার চোখে সমস্যা আছে। দেখতে পারেন না ঠিক মতো।
আল মাহমুদ: নিজ হাতে এখন আর আমি লিখতে পারি না। আমার একটা নাতনি আছে, যখন টেলিফোন করি সে আসে। আমি বলি, সে লিখে দেয়। ও আবার ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্রী। বাংলা ভাষা ভালো জানে না। আগের মতো কাগজে-কলমে লিখে যে কাটাকুটি করতাম সেটা পারি না। সেটা করতে হলে একজন লেখককে নিঃসঙ্গ থাকতে হয়। কিন্তু সেই নিঃসঙ্গ থাকা আমার হয় না। যতদিন আমার বউ ছিল, সে খুব সহযোগিতা করত। লেখাপড়া বেশি জানত না কিন্তু খুব ভালো মনের মানুষ ছিল। গ্রামের মেয়ে ছিল, আমার আব্বা পছন্দ করে বিয়ে করিয়েছিলেন। আমার বাবার বন্ধুর মেয়ে। আমার পাঁচ ছেলে তিন মেয়ের পুরো সংসারটা সে একা সামলিয়েছে। এখন মনে হয় যে মানুষটা হঠাৎ মরে গেল।
প্রিয়: তিনি মারা যাবার পর আপনার কি নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছিল...
আল মাহমুদ: হ্যাঁ, শূন্যতা পূরণ হয় কি? পূরণ হয় না। আর সে যদি হয় নিজের স্ত্রী তাহলে তো হয় না। বিয়ে করতে পারে মানুষ একটার পর একটা। প্রিয়: আপনি আর বিয়ে করলেন না কেন?
আল মাহমুদ: আমার ইচ্ছেই করেনি।
প্রিয়: আপনার লেখালেখির অনুপ্রেরণা কি আপনার স্ত্রী ছিলেন...
আল মাহমুদ: বললাম তো, সে ছিল গ্রামের মেয়ে। এসব সে বুঝত না। সে আমার সাহিত্য তৈরিতে কোনো সহযোগিতা করতে পারত না। কিন্তু আমি তাকে ভালোবাসতাম খুবই। দেখতে ভালো ছিল। লম্বা চওড়া ছিল। গায়ের রং টকটকা ফর্সা ছিল। মনে হতো যে ইউরোপিয়ান। বলে না যে দুধের মতো সাদা নারী ওই রকম আর কি। তবে ফ্যাশন-ট্যাশন পছন্দ করত না। গ্রামের মেয়েদের মতো শাড়ি পরে থাকত। আমি মাঝে-মধ্যে জোর করে বের করে নিয়ে যেতাম বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। কিন্তু সেখানে সে কারো সঙ্গে কোনো কথা বলত না।
প্রিয়: উনি বেঁচে থাকতে আপনার জন্মদিনে কী করতেন...
আল মাহমুদ: তখন তো জন্মদিন তেমন কোনো উৎসাহের সঙ্গে পালন হতো না। তবে হতো আমাদের বাসায়। আমার স্ত্রী নানারকম মজার সব রান্না তৈরি করতেন। আমরা পরিবারের সদস্যরা মিলে সেই খাবার খেতাম আনন্দ নিয়ে। দু’একজন কাছের বন্ধুদের দাওয়াত দেওয়া হতো। এই ছিল তখনকার জন্মদিনের আয়োজন।
প্রিয়: এমনিতে আপনার কবিতা, গল্প আর উপন্যাসে যে নারী চরিত্র পাওয়া যায়। তাতে দেখা যায়, আপনি নারী চরিত্রের প্রতি একটু বেশিই দুর্বল ছিলেন, মানে বেশি যত্নবান ছিলেন...
আল মাহমুদ: আমার একটা ছোট উপন্যাস আছে যার নাম অর্ধেক মানবী। যার অর্ধেক শরীর মানুষের আর অর্ধেক শরীর অসার। সে চলতে পারত না, হাঁটতে পারত না। কিন্তু তার অর্ধেক শরীর ছিল খুবই সুন্দর। তার যে পেইন, তার যৌনক্ষুধা সবমিলিয়ে লেখাটা তৈরি করেছি। একজন বিদেশি কবি এই ছোট উপন্যাসটাকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন।
প্রিয়: পেশাগত জীবনে তো আপনি একজন সংবাদকর্মী ছিলেন। তো আপনার লেখালেখির ক্ষেত্রে কি সংবাদপত্রের জীবন কোনো ধরনের প্রভাব ফেলেছে।
আল মাহমুদ: না, আমার লেখালেখির ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেনি। এটার কারণ হলো—আমি তো জন্ম থেকেই সংবাদপত্রের মানুষ।

প্রিয়: মানে বুঝিনি...
আল মাহমুদ: আমার আব্বা সংবাদপত্রের ম্যানেজার ছিলেন। আমার মা গৃহবধূ ছিলেন। লেখাপড়া তিনি বেশি জানতেন না। কিন্তু অত্যন্ত সুন্দরী ছিলেন দেখতে। আমাকে অনেকেই জিজ্ঞেস করেন আপনার মা দেখতে কেমন ছিলেন। আমি তখন বলি যে, আমার মাকে দেখলে ফেরেশতাও লজ্জিত হয়েছে। তিনি এত সুন্দরী ছিলেন।
প্রিয়: আপনি কি একাকিত্ব ফিল করেন...
আল মাহমুদ: ভাই, এখন আর একাকিত্ব ফিল করি না। কারণ আমি সবসময়ই ব্যস্ত থাকি। মানুষ আসতেই থাকে। তো আমাদের একটা পারিবারিক নিয়ম হলো যদি কেউ আসে তার সঙ্গে আমরা কথা বলি। আমার দশটা কাজ থাকলেও আমি তার সঙ্গে কথা বলি। এটা আমাদের পারিবারিক কালচারের মধ্যে আছে।
প্রিয়: আপনার প্রেমের গল্প জানতে চাই...
আল মাহমুদ: আরে শোনো ভাই, প্রেম জিনিসটা যে কি সেটা শিখতে হয়। হৃদয়ের সকল আকুতি এক করে হোয়াট ইজ লাভ শিখতে হয়।
প্রিয়: তার মানে আপনাকেও শিখতে হয়েছে।
আল মাহমুদ: নিশ্চয়ই শিখতে হয়েছে। হোমার পড়লেই প্রেম শেখা হয়ে যায়।
প্রিয়: সাহিত্যে যৌনতাকে আপনি কীভাবে দেখতে চান...
আল মাহমুদ: শুধু সাহিত্য নয়, যৌনতা সকল ক্ষেত্রেই রয়েছে। এটা অতি প্রাচীন একটা রীতি। প্রেম বা যৌনতা মানুষকে যেমন ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে, তেমনি আবার প্রেম তাজমহলও গড়ে। সাম্রাজ্য ধ্বংস করতে পারে, রাষ্ট্র ধ্বংস করতে পারে।

প্রিয়: আপনি এক জীবনে কয়টি প্রেম করেছেন?
আল মাহমুদ: [একটু চুপ থেকে ভাবলেন। তারপর বললেন] সে কাহিনি তো ভাই বলতে পারব না। আমার তো বই পত্র আছে। সেগুলো খুঁজলেই আমার প্রেমের ইতিহাস পাওয়া যাবে। আচ্ছা, আপনারা কোথায় কাজ করছেন।
প্রিয়: প্রিয়.কম-এ আছি। এটা একটা অনলাইন সংবাদমাধ্যম।
আল মাহমুদ: প্রিয়.কম... আচ্ছা অনলাইন পত্রিকা। অনলাইন পত্রিকার সিস্টেমটা কি...
প্রিয়: আপনার মোবাইলে বা কম্পিউটারে যদি ইন্টারনেট সংযোগ থাকে তাহলে আপনি যে কোনো অনলাইন পত্রিকা ঘরে বসেই দেখতে পারবেন, পড়তে পারবেন। আপনার কি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে?
আল মাহমুদ: না, আমি বিষয়টি সম্পর্কে খুব বেশি জানি না।
প্রিয়: রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ অনেক কবির নামেই ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে...
আল মাহমুদ : আমার নামেও তাহলে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে। আমার ভক্তরা হয়তো করেছে।
প্রিয়: এর মাঝে তো আপনার সঙ্গে একটি মেয়ের ছবি দিয়ে কিছু লোক দুষ্টুমি করেছে ফেসবুকে...
আল মাহমুদ: হ্যাঁ, শুনেছি আমি বিষয়টি। এটা দুষ্টামি না, বোকামি করেছে তারা। যে মেয়েটাকে নিয়ে এ কাজটি করেছে সে মেয়েটি এত ইনোসেন্ট। বিষয়টি শুনেই আমার লজ্জা লেগেছে।
প্রিয়: এবারের জন্মদিনের পরিকল্পনা কি আপনার?
আল মাহমুদ: আমি তো বাসাতেই এবারের জন্মদিনটা পালন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার কিছু ভক্তরা প্রেসক্লাবে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে সেখানে আমাকে যেতে হবে। কিন্তু আমি তো গরিব মানুষ ভাই। ওরাই টাকা জোগাড় করে অনুষ্ঠান করছে। কি আর করার যেতে হবে।

প্রিয়: আপনার রাজনৈতিক দর্শন সম্পর্কে জানতে চাই...
আল মাহমুদ: হ্যাঁ, সেটা অবশ্য আছে। আমি কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে ধর্মে বিশ্বাস করি। যদিও আমি আনুষ্ঠানিকভাবে সেটা করি না। আমি কিছু চাইলেই আল্লাহর কাছে চাই। লোকে বলে আল্লাহকে ডাকলে আল্লাহ কি শুনতে পায়? কিন্তু আমার কেন যেন মনে হয় তিনি কথা বলেন।
প্রিয়: এটা তো আপনার ধর্মীয় বিশ্বাস। প্রত্যেকেরই তার ধর্মের প্রতি বিশ্বাস রয়েছে। জানতে চাচ্ছিলাম আপনার রাজনৈতিক অবস্থানের জায়গা। একটা বির্তক তো অনেক পুরাতন। সেটা হলো আপনি নাকি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামকে সমর্থন করেন...
আল মাহমুদ: দেখেন, আমি কোনো দিন এবং অতীতেও জামায়াতপন্হি ছিলাম না। এরাই আমাকে জামায়াত বানিয়েছে। এবং যারা বানিয়েছে, তারা তো দৈত্য বানিয়েছে। এখন দৈত্য তারা সামাল দিতে পারে না। জামাতি কাউকে আমি চিনতামই না। কিন্তু আমার যারা ক্ষতি করতে চেয়েছিল, তারা এটা করেছিল। আর আপনাকে আমার বলতে কোনো দ্বিধা নাই, তারা কিন্তু নাই। আমি কিন্তু আছি। কারণ আমি তো সাহিত্য করি। আমি কবিতা লিখি, গল্প উপন্যাস লিখি, আমাকে তো গুলি করে মারা যায় না। গুলি করে মারলেও আমি সাহিত্যে থাকব। না মারলেও থাকব।
প্রিয়: কবিদের মধ্যে একধরনের রাজনৈতিক চর্চা সবসময় দেখা যায়। সরকারি দলের সমর্থনে যে কবিরা থাকবেন, তারা একধরনের সুযোগ সুবিধা পান, আর কোনো রাজনৈতিক পরিচয় না থাকলে তার কোনো মূল্যায়নই হয় না। কবিদের রাজনীতি নিয়ে আপনার চিন্তা কী?
আল মাহমুদ: এসব রাজনীতি। আমি একজন কবি, আমি রাজনৈতিক নেতা নই। আমি সোজা-সরল মানুষ। আপনি যদি আমাকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসেন, আমিও আপনাকে হৃদয় দিয়েই ভালোবাসব। আপনার সঙ্গে আমার বিনিময় হবে।
প্রিয়: আপনকে তো মাঝে-মধ্যে অভিনয়ে এবং বিজ্ঞাপন চিত্রের মডেল হিসেবে দেখা যায়...
আল মাহমুদ: এগুলো আগে করেছি। আমি এখনো করব। আমি গরিব মানুষ, তাই না? তাই যে আমাকে পয়সা দিবে, আমি তার নাটকে বিজ্ঞাপনে কাজ করব।
প্রিয়: আপনি কি সত্যিই গরিব...
আল মাহমুদ: আমার তো কেউ নাই। ছেলেমেয়েরা যারা আছে, সবাই কাছে থাকে না। আমি বর্তমানে থাকি আমার বড় ছেলের বাসায়। সে একটা ছোট চাকরি করে। এক ছেলে বিল্ডিং তৈরি করে। সে আমাকে খুব চেষ্টা করেছিল তার কাছে নিয়ে যেতে কিন্তু আমার যেতে মন চায়নি।
প্রিয়: মৃত্যু নিয়ে আপনার ভাবনা কী?
আল মাহমুদ: আমি তো ভাই মরণ নিয়া চিন্তা করি না। তবে মৃত্যু অবধারিত। জন্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা কবে...কেউ অমর নাই। তুমি যখন জন্মগ্রহণ করেছ তোমাকে মরতেই হবে, সেটা যুদ্ধে হোক, বিপ্লবে হোক আর অসুখ-বিসুখে হোক। মৃত্যু এক অন্ধকার গহ্বর। কিছুই জানো না তুমি। কারণ কেউ তো আর মৃত্যুর গুহা থেকে বের হয়ে আসেনি। সবাই অমর হতে চায়।

প্রিয়: আপনিও নিশ্চয়ই চেয়েছেন অমর হতে...
আল মাহমুদ: সবাই অমর হতেই চেয়েছে। কেউ পিরামিড বানিয়েছে, কেউ তাজমহল বানিয়েছে।
প্রিয়: এখন আপনার সময় কাটে কীভাবে?
আল মাহমুদ: শারীরিক অবস্থা ভাই খুব একটা ভালো না। আগে তো ঘুরে বেড়াইতাম, এখন তো কারো সাহয্য না হলে বের হতে পারি না।
প্রিয়: আপনার আর কবি শামসুর রাহমান সম্পর্কে নানা ধরনের গসিপ শোনা যায়। আপনাদের সম্পর্ক নাকি ভালো ছিল না...
আল মাহমুদ: শামসুর রাহমান হঠাৎ আসতেন আমাদের বাসায়। এসে চুপচাপ একা এক জায়গায় বসে থাকতেন। আমার ওয়াইফকে নাম ধরে ডেকে বলতেন যে, নাদিরা আমাকে চা দাও। শামসুর রাহমানের সঙ্গে যে আমার এই সম্পর্ক ছিল ,এটা তো কেউ ভাই বলে না। আমরা তো আর মারামারি কাটাকাটি দাঙ্গা-হাঙ্গামা করি না। কবিতা লিখি। আমার ভাগ্যটাই খারাপ। সবাই আমার দুর্নাম করেছে।
প্রিয়: কবি হিসেবে শামসুর রাহমানকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন...
আল মাহমুদ: সে কবি হিসেবে গ্রেট। মানুষ হিসেবেও ভালো। সব মানুষেরই একটা খারাপ দিক থাকে। তারও হয়তো ছিল। কিন্তু সেটা আমার জানা নেই।
প্রিয়: সৈয়দ শামসুল হক সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
আল মাহমুদ: ওনার লেখা আমার পড়া হয়নি। ওনার সম্পর্কে আমি খুব একটা জানি না। তার সঙ্গে আমার মেলামেশাও কম হয়েছে। তবে তার ওয়াইফ আনোয়ারা সৈয়দ হককে আমি জানতাম তার বিয়ের আগে থেকেই। এই মহিলা এক অসাধারণ মানুষ। তিনি মানসিক রোগীদের ডাক্তার ছিলেন। আমি তাকে শ্রদ্ধা করি।
প্রিয়: আপনি তো ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন...
আল মাহমুদ: ছিলাম শুধু না, এর জন্য আমি জেলও খেটেছি। পালিয়ে বেড়িয়েছি। লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় এসে ভিক্ষুকের জীবন-যাপন করতে হয়েছে। সেখানে আস্তে আস্তে দাঁড়িয়েছি নিজের প্রতিভার জন্য। আমি একজন দরবেশ মানুষ।
প্রিয়: আপনি কী নিজেকে দরবেশ মনে করেন?
আল মাহমুদ: জীবনের দিক থেকে তো তাই। আমার তো কোনো লোভ নাই। লোভ-লালসা আমি নিজের ইচ্ছায় ছেড়েছি। না হলে আমি অনেক ধনী হতে পারতাম।
প্রিয়: আরও কত বছর বাঁচতে চান?
আল মাহমুদ: বাঁচতে তো চাই দীর্ঘদিন। কিন্তু শারীরিক অবস্থা তো ভালো না।
প্রিয়: আশি বছর কি খুব বেশি বয়স...
আল মাহমুদ: একবারেই ফেলে দেবার মতো না। আশি বছরে মানুষ বুড়ো হয়।

প্রিয়: আপনাকে যদি আমরা আশি বছরের তরুণ বলি তাহলে কি ভুল হবে?
আল মাহমুদ: না, আপনারা বলুন অসুবিধা কি? কিন্তু আশি তো আর সোজা কথা না। হেঁটে পার হতেও সময় লাগে। আশি বছর না, আশি দিন হাঁটেন।
প্রিয়: তরুণ কবিদের সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?
আল মাহমুদ: এখন আর তরুণ কবিদের লেখা পড়তে পারি না। আগে তো আজিজ মার্কেটে যেতাম লিটলম্যাগ কিনে আনতাম, পড়তাম। কিন্তু এখন আর পারি না। অনেক তরুণরাই আমার কাছে আসে। আইসা অদ্ভুত সব প্রশ্ন করে।
প্রিয়: আপনার পরবর্তী জেনারেশনের কবিদের সম্পর্কে বলুন?
আল মাহমুদ: নাম তো বলতে পারব না। নাম বলাটা ঠিকও হবে না। অনেকের কবিতাই আমার কাছে ভালো লাগে। তবে আমাদের কবিতায় যে প্রেম ছিল, ভালোবাসা ছিল, বিচ্ছেদ ছিল—আজকালের কবিতায় সেটা খুঁজে পাই না।
প্রিয়: সেটা কি সময়ের কারণে না লাইফ স্টাইলের কারণে...
আল মাহমুদ: আরে ভাই, চোখ তো নষ্ট হইয়া গেছে। অনুভূতি ভোতা হয়, হয় না? মানুষ তো, নানারকম অসুবিধা আছে। দেখেন, কবিরা অন্ধ হয়েও লেখে। হোমার অন্ধ ছিল তাতে কী হয়েছে। পৃথিবীর কবিতা তো আর অন্ধ না।
[আমরা আরও কথা বলতে থাকি কবির সঙ্গে। নানান প্রসঙ্গে। সময় বয়ে যায় নীরবে...]

এক নজরে আল মাহমুদ
জন্ম: ১১ জুলাই, ১৯৩৬, মোল্লাবাড়ি, মৌড়াইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া। পিতা: আব্দুর রব মীর। মা: রৌশন আরা বেগম। স্ত্রী: সৈয়দা নাদিরা বেগম। পুত্র-কন্যা: পাঁচ পুত্র, তিন কন্যা। পেশা: অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি।
উল্লেখযোগ্য গ্রন্হ
কবিতা: লোক লোকান্তর, কালের কলস, সোনালী কাবিন, মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো, প্রহরান্তরের পাশ ফেরা, আরব্য রজনীর রাজহাঁস, মিথ্যেবাদী রাখাল, আমি দূরগামী, বখতিয়ারের ঘোড়া, দ্বিতীয় ভাঙন, নদীর ভেতরে নদী, উড়াল কাব্য, বিরামপুরের যাত্রী, না কোন শূন্যতা মানি না প্রভৃতি।
ছোটগল্প: পান কৌড়ির রক্ত, সৌরভের কাছে পরাজিত, গন্ধবনিক, ময়ূরীর মুখ প্রভৃতি।
উপন্যাস: কাবিলের বোন, উপমহাদেশ, পুরুষ সুন্দর, চেহারার চতুরঙ্গ, আগুনের মেয়ে, নিশিন্দা নারী প্রভৃতি।
শিশুতোষ: পাখির কাছে ফুলের কাছে।
প্রবন্ধ: কবির আত্মবিশ্বাস, কবির সৃজন বেদন, আল মাহমুদের প্রবন্ধ সমগ্র।
ভ্রমণ: কবিতার জন্য বহুদূর, কবিতার জন্য সাত সমুদ্র প্রভৃতি৷ এ ছাড়াও প্রকাশিত হয়েছে আল মাহমুদ রচনাবলী।
পুরস্কার
বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৮), জয়বাংলা পুরস্কার (১৯৭২), হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৪), জীবনানন্দ দাশ স্মৃতি পুরষ্কার (১৯৭৪), সুফী মোতাহের হোসেন সাহিত্য স্বর্ণপদক (১৯৭৬), ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৬), একুশে পদক (১৯৮৭),নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৯০), সমান্তরাল (ভারত) কর্তৃক ভানুসিংহ সম্মাননা পদক-২০০৪ প্রভৃতি।
- ট্যাগ:
- সাহিত্য
- কবি আল মাহমুদ
- সাহিত্য