
ছবি সংগৃহীত
ইসলামে তাকওয়ার গুরুত্ব ও মহাত্ম্য
আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০১৪, ০০:৩৭
তাকওয়া পরিচিতি তাকওয়া শব্দের আভিধানিক অর্থ সাবধানতা অবলম্বন করা। ইসলামি পরিভাষায় আল্লাহর শাস্তি ও অসন্তুষ্টির কার্যকারণসমূহ থেকে নিজকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সাবধানতা অবলম্বন করাকেই তাকওয়া বলা হয়। সহজভাবে বলতে গেলে সবক্ষেত্রে আল্লাহর ভয় হৃদয়ে পোষণ করাই তাকওয়া।আল্লাহভীতি বা আল্লাহপ্রীতিই হলো তাকওয়া। কারণ মানুষ ভয় করে তাকে ভালোবাসে যাকে। তাকওয়ার সংজ্ঞা বর্ণনা করতে গিয়ে হজরত আলী [রা.] বলেছেন, মহা-মহীয়ানকে ভয় করা, কোরান অনুযায়ী আমল করা, অল্পে তুষ্ট থাকা এবং মৃত্যুদিনের জন্য প্রস্তুতি নেয়াই তাকওয়া। তাকওয়া সব কল্যাণের আধার, আল কোরানে সর্বাধিক উল্লিখিত একটি মহৎ গুণ। প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য, কাছের অথবা দূরের সকল কল্যাণের মূল হলো তাকওয়া। অনুরূপভাবে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য, কাছের অথবা দূরের সকল অন্যায় ও পাপাচারের বিরুদ্ধে তাকওয়া হলো প্রতিরোধক দুর্গ। ইমান হলো তাকওয়ার প্রথম ধাপ। অর্থাৎ এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস করার মাধ্যমে তাকওয়ার পৃথিবী একজন মবনুষের প্রবেশ ঘটে।যাদের ইমান নেই তারা মুত্তাকিদের দলভুক্ত নয়। কেননা তাকওয়া হলো আল্লাহকে ভয় করার নাম। আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে চেনে না, বিশ্বাস করে না; তার আল্লাহকে ভয় করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তাকওয়ার কারণে আল্লাহর কাছে একজন মুত্তাকি ব্যক্তির মর্যাদা বেড়ে যায়। পবিত্র কোরানে ইরশাদ হয়েছে, নিশ্চয় তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে অধিক সম্মানিত সে, যে তোমাদের মধ্যে অধিক পরহেজগার বা মুত্তাকি। [সুরা হুজুরাত : ১৩]। তাকওয়া অবলম্বনকারী ব্যক্তিদের আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক দ্বিগুণ পুরস্কার দেয়া এবং তার পথচলার জন্য আলোর ব্যবস্থা করাও তাকওয়ার একটি অন্যতম ফলাফল। আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তার রাসুলের প্রতি ইমান আনো, তিনি স্বীয় রহমতে তোমাদের দ্বিগুণ পুরস্কার দেবেন, আর তোমাদের নূর দেবেন যার সাহায্যে তোমরা চলতে পারবে এবং তিনি তোমাদের ক্ষমা করে দেবেন। আর আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। [সুরা হাদিদ : ২৮] তাকওয়া অবলম্বনকারী ব্যক্তি পরকালে নাজাত পেয়ে ধন্য হবেন। আল্লাহ তায়ালা এই মর্মে ইরশাদ করেছেন, আর আল্লাহ মুত্তাকিদের তাদের সাফল্যসহ নাজাত দেবেন। কোনো অমঙ্গল তাদের স্পর্শ করবে না। আর তারা চিন্তিতও হবে না। [সুরা যুমার : ৬১] আল্লাহভীতির একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হজরত ওমর [রা.] তাঁর খেলাফতকালে লোকজনের খোঁজখবর নেওয়ার জন্য রাতের বেলা মদিনা মুনাওয়ারায় টহল দিতেন। এক রাতে তাহাজ্জুদের নামাজান্তে টহল দিচ্ছিলেন তিনি । হঠাৎ লক্ষ করলেন, একটি ঘর থেকে কথাবার্তার শব্দ শোনা যাচ্ছে। সাধারণ অবস্থায় কারো ব্যক্তিগত কথা আড়ি পেতে শোনা জায়েয নয়। কিন্তু দায়িত্বশীল ব্যক্তির জন্য প্রয়োজনের ক্ষেত্রে এর অনুমতি রয়েছে। তো কথাবার্তার ধরন শুনে তাঁর কৌতূহল হল। তিনি ঘরের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালেন এবং শুনতে পেলেন, এক বৃদ্ধা তার মেয়েকে বলছে, ‘বেটি! আজ তো উটের দুধ কম হয়েছে। এত অল্প দুধ বিক্রি করে দিন গুজরান করা কষ্ট হবে। তাই দুধের সাথে একটু পানি মিশিয়ে দাও।’ মেয়ে উত্তরে বলল, ‘মা! আমিরুল মুমিনিন তো দুধের সাথে পানি মেশাতে নিষেধ করেছেন?’ বৃদ্ধা বললেন, ‘আমিরুল মুমিনিন কি এখন আমাদের দেখছেন? তিনি হয়তো নিজ ঘরে ঘুমিয়ে আছেন। তুমি নিশ্চিন্তে পানি মেশাতে পার।’ এবার মেয়ে বলল, ‘মা, আমিরুল মুমিনিন এখানে নেই এবং তার কোনো লোকও নেই। তিনি বা তারা আমাদের দেখছেন না সেকথা ঠিক আছে কিন্তু আল্লাহ তাআলা তো আছেন! তিনি তো সব দেখছেন! তাঁর কাছে আমরা কী জবাব দেব?’ হজরত ওমর [রা.] দেয়ালের ওপাশ থেকে সব কথা শুনতে পাচ্ছিলেন। এতটুকু শুনেই তিনি চলে এলেন এবং পরদিন লোক পাঠিয়ে সে ঘরের খোঁজখবর নিলেন। তারপর বৃদ্ধার কাছে পয়গাম পাঠালেন যে, ‘আপনি সম্মত হলে আপনার মেয়ের সাথে আমার ছেলের বিয়ে দিতে চাই।’ এভাবে তাকওয়ার বদৌলতে মেয়েটি আমিরুল মুমিনিনের পুত্রবধু হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করল। এই বরকতময় ঘরের তৃতীয় পুরুষে জন্মগ্রহণ করলেন খলিফা ওমর বিন আবদুল আজিজ [রাহ.] যাকে পঞ্চম খলিফায়ে রাশেদ বলা হয়। তো মানুষের অন্তরে সর্বক্ষণ এই ধ্যান জাগরুক থাকা যে, আর কেউ দেখুন না দেখুন, জানুক বা না জানুক আল্লাহ তাআলা আমাকে দেখছেন-এর নামই তাকওয়া। একজন মুত্তাকির গুণাবলী মুত্তাকি হওয়ার জন্য, তাকওয়া অবলম্বন করার জন্য একজন মুমিনের মাঝে বেশ কিছু গুণাবলির সম্মিলন জরুরি। তাকওয়া শুধু অন্তরে সীমিত থাকার বিষয় নয়। বরং সত্যিকার তাকওয়াধারীর অন্তর ছাপিয়ে তাকওয়ার সৌরভ তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে, কর্মে ও আমলে ছড়িয়ে পরে। মুত্তাকির গুণাবলীর মধ্যে কয়েকটি হলো- এক. ঈমান বিল গায়েব বা অদৃশ্যের প্রতি ঈমান। দুই. যথার্থরূপে নামাজ আদায়। তিন. আল্লাহর পথে অর্থসম্পদ ব্যয় করা। চার. আল্লাহ যা নাজিল করেছেন তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপণ করা। পাচ. আখিরাতের প্রতি ইয়াকিন বা বিশ্বাস রাখা। এই মর্মে আল্লাহ মহার ইরশাদ করেছেন, আলিফ-লাম-মীম। এটি (আল্লাহর) কিতাব, এতে কোন সন্দেহ নেই, মুত্তাকিদের জন্য হিদায়েত। যারা গায়েবের প্রতি ঈমান আনে,সালাত কায়েম করে এবং আমি তাদেরকে যে রিজিক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে। এবং যারা ঈমান আনে,যা তোমার প্রতি নাজিল করা হয়েছে এবং যা তোমার পূর্বে নাজিল করা হয়েছে তার প্রতি। আর আখিরাতের প্রতি তারা ইয়াকিন রাখে। তারা তাদের রবের পক্ষ থেকে হিদায়াতের উপর রয়েছে এবং তারাই সফলকাম [সূরা আল বাকারা: ১-৫]। আল্লাহ তাআলা যেসব নেক আমল করতে বলেছেন কায়মনোবাক্যে সেসব আমল যথার্থরূপে আদায় করে যান একজন মুত্তাকি ব্যক্তি। অঙ্গীকার পূরণ করা ও কষ্ট দুর্দশায় ধৈর্যধারণ করাও মুত্তাকিদের গুণাবলীর মধ্যে শামিল। ইরশাদ হয়েছে, ভালো কাজ এটা নয় যে,তোমরা তোমাদের চেহারা পূর্ব ও পশ্চিম দিকে ফিরাবে; বরং ভালো কাজ হল যে আল্লাহ, শেষ দিবস, ফেরেশতাগণ, কিতাব ও নবীগণের প্রতি ঈমান আনে এবং সম্পদের প্রতি আসক্তি সত্ত্বেও নিকটাত্মীয়গণকে,ইয়াতিম, অসহায়,মুসাফির ও প্রার্থনাকারীকে এবং বন্দিমুক্তিতে তা প্রদান করে। আর সালাত কায়েম করে, জাকাত দেয় এবং যারা অঙ্গীকার করে তা পূর্ণ করে,যারা ধৈর্যধারণ করে কষ্ট ও দুর্দশায় ও যুদ্ধের সময়ে। তারাই সত্যবাদী এবং তারাই মুত্তাকি [সূরা আল বাকারা: ১৭৭]। মুত্তাকিদের গুণাবলীর মধ্যে একটি হলো, কৃত পাপ ও গুনাহের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া। ইস্তিগফার করা। ইরশাদ হয়েছে, আর তোমরা দ্রুত অগ্রসর হও তোমাদের রবের পক্ষ থেকে মাগফিরাত ও জান্নাতের দিকে,যার পরিধি আসমানসমূহ ও জমিনের সমান, যা মুত্তাকিদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। যারা সুসময়ে ও দুঃসময়ে ব্যয় করে এবং ক্রোধ সংবরণ করে ও মানুষকে ক্ষমা করে। আর আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালবাসেন। আর যারা কোন অশ্লীল কাজ করলে অথবা নিজদের প্রতি জুলম করলে আল্লাহকে স্মরণ করে, অতঃপর তাদের গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আর আল্লাহ ছাড়া কে গুনাহ ক্ষমা করবে? আর তারা যা করেছে, জেনে শুনে তা তারা বার বার করে না। [সূরা আলে ইমরান: ১৩৩-১৩৫]। তাকওয়া অবলম্বনের ফজিলত এক. তাকওয়া অবলম্বনের বহু ফজিলত রয়েছে। এর মাঝে অন্যতম হলো তাকওয়া দ্বারা অন্তর খুলে যায়। ইলম হাসিল হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং আল্লাহ তোমাদেরকে শেখাবেন। [সূরা আল বাকারা:২৮২]। তাই আমরা যদি আল্লাহর পথে চলার ইলমে নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করতে চাই, দীনী ইলমের বিশাল ভাণ্ডার নিজেদের জন্য উন্মুক্ত করতে চাই, তবে তাকওয়া অবলম্বনই হবে আমাদের বড় মাধ্যম। দুই. তাকওয়া অবলম্বনের আরেকটি ফজিলত হলো, যে ব্যক্তি তাকওয়া অবলম্বন করে আল্লাহ তাকে সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের মানদণ্ড দান করেন। পাপ-পূণ্যের মাঝে পার্থক্য করার যোগ্যতা দান করেন। পাশাপাশি তিনি তার গুনাহসমূহও ক্ষমা করে দেন। ইরশাদ হয়েছে, হে মুমিনগণ, যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর তাহলে তিনি তোমাদের জন্য ফুরকান প্রদান করবেন,তোমাদের থেকে তোমাদের পাপসমূহ দূর করবেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল। [সূরা আল-আনফাল : ২৯। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা বান্দার মধ্যে আন্তরিক দৃঢ়তা, বিচক্ষণতা ও সুন্দর হিদায়েত সৃষ্টি করে দেবেন, যার মাধ্যমে সে হক ও বাতিলের পার্থক্য করতে পারবে। তিন. তাকওয়া অবলম্বনের আরেকটি ফজিলত হলো আমল কবুল হওয়া। কেননা যে ব্যক্তির তাকওয়া নেই, সে হয়তো মোটেই আমল করবে না, আর যদি করে তাহলে তা তাকওয়াশূন্য হওয়ার কারণে ইখলাস বিবর্জিত হতে বাধ্য। তাই আল্লাহ তাআলা সে আমল কবুল করবেন না- এটাই স্বাভাবিক। ইরশাদ হয়েছে , আল্লাহ তো কেবল মুত্তাকিদের থেকেই কবুল করেন [সূরা আল মায়েদা : ২৭। চার. তাকওয়া অবলম্বনের আরেকটি বিশেষ ফজিলত হলো তাকওয়ার কারণে আল্লাহর নিকট উক্ত ব্যক্তির মর্যাদা বেড়ে যাওয়া। ইরশাদ হয়েছে, নিশ্চয় তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট অধিক সম্মানিত সে যে তোমাদের মধ্যে অধিক পরহেজগার [সূরা আল হুজুরাত : ১৩]। পাচ. জান্নাত লাভে ধন্য হওয়া তাকওয়ার একটি ফজিলত। ইরশাদ হয়েছে, জান্নাত, আমি যার উত্তরাধিকারী বানাব আমার বান্দাদের মধ্যে তাদেরকে যারা মুত্তাকি [সূরা মারয়াম:৬৩]। আল্লাহ তাআলা আমাদের যথার্থরূপে তাকওয়া অর্জনের তাওফিক দান করুন। আমিন। মাওলানা মিরাজ রহমান