ছবি সংগৃহীত
আমি অপরাধী!
আপডেট: ১৮ জুলাই ২০১৪, ০৭:১৭
খুব অপরাধ বোধ হচ্ছে। নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। মনে হচ্ছে ঠিক হল না। অন্য কিছু হতে পারতো। ঠিক কিছু হতে পারতো। আমি অপরাধী। কেন? কেন অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে? আমার বিবেক বলছে আমি অপরাধী। অপরাধ করিনি, অপরাধ ঠেকাতেও পারিনি। তাই আমি অপরাধী। ঘটনাটা বলি। আজ ধানমণ্ডি সাতাশ গিয়েছিলাম, ব্যাংকে কিছু কাজ ছিল। কাজ শেষে রাপা প্লাজার সামনে আসলাম, উদ্দেশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ক্লাস আছে। তবে রাস্তার মাথায় এসে বুঝলাম মিরপুর রোডের এই রাস্তা ধরে এগুলে আমি ক্লাস ধরতে পারবো না। আমার তিনটায় ক্লাস, বাজে তখন দুইটা। তাই উল্টো পথে হাঁটা দিলাম। শঙ্কর থেকে বাস ধরবো। ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকা, তুলনামূলক জ্যাম কম পরবে। তাই ধানমণ্ডি সাতাশ ধরে হাঁটা দিলাম। বাঁধ সাধলো বৃষ্টি। মুষলধারায় বৃষ্টি শুরু হল। আমি দৌড়ে এক বাড়ির নিচ তলায় দাঁড়ালাম। খুব সম্ভবত ওটা ইবাইস বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। আমার সাথে দাঁড়ালেন আরও পাঁচ-ছয়জন। দু’পাশে দেয়াল দিয়ে ঘেড়া। শুধু সামনের রাস্তাটা দেখা যায়। রাস্তায় মানুষজন প্রায় নেই বললেই চলে। শুধু কিছু গাড়ি যাওয়া আসা করছে। আমরা অপেক্ষা করছি বৃষ্টি থামার। ঘটনাটা ঘটলো তখনই। একজন ভদ্রমহিলার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। “এই কুকুরের বাচ্চা, এই শয়তানের বাচ্চা দাঁড়া।” দু’পাশে দেয়াল থাকায় আমরা ভদ্রমহিলাকে দেখতে পেলাম না। দেখতে পেলাম একজন ভদ্রলোককে (দুঃখিত ভদ্রলোক বলায়, তখনও আমাদের কাছে ভদ্রলোক ছিলেন, তার পরক্ষণেই ধারণাটা বদলে যায়)। লোকটি খুব স্বাভাবিক ভাবে হেঁটে যাচ্ছেন। বয়স ত্রিশের উপরে হবে। পোশাক-আশাকে পুরোপুরি ভদ্র ঘরের মনে হচ্ছিল। মাথা নিচু করে হেঁটে আমাদের ডান পাশের দেয়ালের আড়ালে চলে গেলেন। লোকটি আড়াল হওয়ার পর এবার বাম পাশের দেয়ালের দিক থেকে সেই ভদ্রমহিলা আসলেন। উনিও ত্রিশের উপরে হবে। ভদ্র ঘরের হবেন নিঃসন্দেহে। হাতে ছাতা। গালি দিতে দিতে আমাদের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। একটু দাঁড়ালেন। “এই কুকুরের বাচ্চা, এই শয়তানের বাচ্চা যাচ্ছিস কোথায়? দাঁড়া।” আমার এক মুহূর্তের জন্য মনে হল তারা স্বামী-স্ত্রী। রাস্তায় হঠাৎ ঝগড়া করছেন, অতিরিক্ত পর্যায় চলে যাওয়ায় গালি দিচ্ছেন। কিন্তু আমার এই ধারণা কেটে গেল নিমিষেই, যখন শুনলাম দেয়ালের ওপাশের কাওকে উদ্দেশ্য করে ভদ্রমহিলা বলছেন, “আপনারা এই কুকুরের বাচ্চাটা ধরছেন না কেন? এই কুকুরের বাচ্চাটা এইমাত্র আমার গায়ে হাত দিয়ে চলে গেল।” আমি আঁতকে উঠলাম। পুরো ব্যাপারটা তখন আমার কাছে পরিষ্কার। তারা স্বামী-স্ত্রী তো নয়ই বরং ‘কুকুরের বাচ্চাটা’ অতি জঘন্য একটি কাজ করেছে। দেয়ালের ওপাশে চলে গেলেন ভদ্রমহিলা। হয়তো ‘কুকুরের বাচ্চাটাও’ চলে গেছে এলাকার বাইরে। ভদ্রমহিলা আমাদের দেখলেন না, তবে আমরা দেখলাম কি হল। আমি ভাবছিলাম কি করবো? দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পরবো ‘কুকুরের বাচ্চাটার’ উপর? আমি কখনও মারামারি করিনি। খুব ছোট বেলায় এক বন্ধুর সাথে করেছিলাম যেটাকে ঠিক মারামারি বলে না। আমি কি করবো? গিয়ে ওকে দুই গালে দুইটা চড় দিব, অথবা ঘুষি, নাকি রাস্তায় ফেলে লাথি দিব? নিজের সাথে যুদ্ধ করছিলাম, কি করবো? কিন্তু ততক্ষণে ঘটনাটা শেষ। কাপুরুষের মত দাঁড়িয়ে রইলাম। হজম করলাম ঘটনাটা, কিন্তু কিছুই করতে পারলাম না। আমার সাথে যারা ছিলেন তারাও দাঁড়িয়ে। জানিনা তারা কি ভাবছিলেন, তবে সবাই দাঁড়িয়েই ছিলেন। ঘটনাটা শেষ। তবে আমার কাছে তো শেষ হলনা। নতুন করে শুরু হল। আমি কিছুই করলাম না, কিছুই করতে পারলাম না। এই রকম একটা জঘন্য অপরাধ ঘটে গেল কিছুই করতে পারলাম না? পারতাম তো ওই ‘কুকুরের বাচ্চাটাকে’ একটা উচিত শিক্ষা দিতে। পারলাম না? এখন কি হবে, এখন ও তো সাহস পেয়ে গেল। এই রকম একটা জঘন্য অপরাধ করেও পার পেয়ে গেল। কেউ তাকে কিচ্ছু করতে পারলো না। এখন তো ও আরও জঘন্য অপরাধ করার সাহস পেয়ে গেল। অথচ আজকে যদি ওকে একটা উচিত শিক্ষা দেওয়া যেত হয়তো আর কোন দিন আর এই রকম জঘন্য অপরাধ করতে পারতো না। নিজেকে খুব বেশি অপরাধী মনে হচ্ছে। নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না, এটা ঠিক। তবেও এটাও ঠিক দ্বিতীয়বার যদি আমার সামনে এমন কিছু ঘটে, আর আমি নিশ্চিত হই ব্যাপারটা কি, তাহলে অপরাধী পার পাবে না। এটা আমার নিজের সাথে প্রতিজ্ঞা। এটা কেমন কথা! আমরা আমাদের মা-বোনদের এতটুকু নিরাপত্তা দিতে পারছি না? এ কোন সমাজে বাস করি আমরা! ধানমণ্ডির মত একটা উন্নত আবাসিক এলাকায় দিনে-দুপুরে এই রকম ঘটনা ঘটছে! আর আমরা কিছুই করছি না, করতে পারছি না। আমাদের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এতটাই অবনতি হয়েছে, যে আমাদের মা-বোনরা নির্দ্বিধায় রাস্তায় বেরুতে পারবে না? প্রতিনিয়ত ছিনতাই, ইভ টিজিং হচ্ছেটা কি এই সমাজে! আর এই সমাজেই আমাদের প্রতিবাদহীন বসবাস। প্রায়ই আমরা ইভ টিজিং-এর কথা শুনি। আমরা কি কখনও একবারও ভেবেছি, যার সাথে এই ঘটনাটা ঘটেছে তার কেমন লাগছে? আমি আমার সাথে প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছি। যদি আর কখনও নিশ্চিত হতে পারি এমন কিছু, এমন জঘন্য অপরাধ আসলেই কেউ করেছে, উচিত শিক্ষা সে পাবে। যারা আমার এই লেখাটি পড়ছেন তাদের উদ্দেশ্যে বলি, আপনারা কেউ যদি এমন পরিস্থিতিতে পড়ে যান আমার মতন দ্বিধায় পড়ে যাবেন না। শুধু এতটুকু চিন্তা করবেন, আপনার মা, বোন বা স্ত্রীর সাথে কেউ যদি এমন আচরণ করে তাহলে আপনি কি করতেন, তাই করবেন। আমরা চাইলেই পারি খুব সুন্দর একটা সমাজ গড়তে। সুন্দর একটা সমাজ, যেখানে সবাই একে অপরকে শ্রদ্ধা করবে। শুধু প্রয়োজন প্রবল ইচ্ছাশক্তি, সুন্দর ও সুস্থ মন-মানসিকতা, উৎকর্ষ বুদ্ধিমত্তা এবং প্রয়োজন একতা। অপরাধ, সেটা যেমনই হোক তাকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। রুখে দাঁড়াতে হবে তখনই। সুন্দর একটি সমাজ গড়ে তোলার প্রত্যাশা রইল সবার কাছে, আমার নিজের কাছেও। বি:দ্র: মতামত বিভাগে প্রকাশিত লেখা একান্তই লেখকের নিজস্ব। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়।