ছবি সংগৃহীত

আমাদের বর্তমান সঙ্গীত জীবন যাপন ও উপার্জন

Pritom Ahmed
লেখক
প্রকাশিত: ২২ জানুয়ারি ২০১৫, ০৫:৪৬
আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০১৫, ০৫:৪৬

একজন কণ্ঠশিল্পী বা গীতিকার বা সুরকার সঙ্গীত জগতে আসবেন। সে তার মেধা ও শিল্পের পারঙ্গমতা ও সৌন্দর্য দেখাবেন আর তাকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যম যেমন রেডিও, টেলিভিশন, সিনেমা ও বিনোদন সাংবাদিকরা লেখালেখি করবেন। খোঁজ খবর নেয়া শুরু করবেন, শুভেচ্ছা জানাবেন এটাই ভাবে সবাই। আসলে কি তাই হয়? আসলেই কি একজন সঙ্গীত শিল্পী তার প্রতিটি শিল্প কর্ম সকল মাধ্যমে সমান ভাবে পরিবেশন করতে পারছেন? আসলেই কি প্রতিটি শিল্পীকে সকল রেডিও , টিভি চ্যানেল বা পত্রিকায় সমান ভাবে তার শিল্পের পরিবেশন করতে দেখা যায়? তার শিল্প চর্চার কততুকু সম্মান বা সম্মানী পাচ্ছেন তিনি? অন্য ভাবে বলা যায় আমাদের শিল্প মাধ্যম গুলো একজন শিল্পীকে কি উপযুক্ত সম্মান বা সম্মানী দিচ্ছেন? এতোদিনে আপনারা জেনে গেছেন আমাদের দেশের বিভিন্ন ভাবে অডিও শিল্পের ব্যাবশা প্রতিষ্ঠান গুলোর দুর্নীতি ও ব্যাবস্থাপনা ও শিল্পীদের প্রতি আনাচারের কথা। এবার চোখ ফেরানো যেতে পারে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে টেলিভিশন রেডিও ও অনলাইন স্টোরে শিল্পীদের কি অবস্থা তা দেখতে। বর্তমান যে অনলাইনে বা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ডিজিটাল কন্টেন্ট ( রিং টোন, ওয়েলকাম টিউন, গান ও গানের ভিডিও ) মার্কেটিং বা বিক্রি করার অফুরন্ত সুযোগ সেখানেই কি একজন শিল্পী চাইলেই তার শিল্প কর্মের উপস্থিতি ঘটাতে পারছেন? যদি পেরেই থাকেন তাহলে কেন আজ দেশে অডিও শিল্প বলে কিছু নেই? কেন আজ একটি, দুটি বা একাধিক গান বছরের সম্মিলিত উপার্জনের তালিকায় আসতে পারছেনা । কেন আজ দেশ বিদেশের স্রোতাদের কাছে বার বার অসাধরন কথা সুর ও গেয়ে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছানো শিল্পীরা সঙ্গীত জগত থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। যেখানে পাশের দেশ বা পৃথিবীর যেকোনো দেশে শিল্পীর যত বয়স বাড়ে ততো বেশি সুন্দর কথা সুর বা গান উপহার দেয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। আমাদের মূল সমস্যা কোথায় তাহলে? পুরনোরা পারছেনা নাকি মেধাবিরা আর গান করেন না? নাকি সব কিছু নতুনের দখলে? নাকি এই নতুন পুড়নো বলে কিছু নেই সবই আসলে সিন্ডিকেট। স্বজন প্রীতি আর চোরাই পথে জনপ্রিয় শিল্পী হবার অথবা শিল্পীর জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে তৃতীয় পক্ষের টাকা রোজগারের চেষ্টা? সময়ের সাথে সাথে যেহেতু বিক্রয় মাধ্যম ও পালটে গেছে তাই অনেকদিন ধরেই বাংলা গানের ইন্ডাস্ট্রির অচলবস্থা ও এর উত্তরনের জন্য ডিজিটাল মার্কেটিং এর খোঁজ খবর নিতে গিয়ে দেখলাম মূলত আমাদের দেশের গানের শিল্পী ও তাদের পেশাগত অবস্থান ও উপার্জন তিন ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগ, রিয়েলিটি শো ও টেলিভিশন চ্যানেলের তত্ত্বাবধানে চলা শিল্পীদের নিয়ে। তাদের মঞ্চ অনুষ্ঠান,তারকা খ্যাতি এবং সেসবের ডিজিটাল কন্টেন্ট মূলত ঐ চ্যানেলের কাছে। সেই শিল্পীর সমস্ত উপার্জন চ্যানেলটি নিয়ে শিল্পীকে যা দিয়ে থাকেন তা হচ্ছে তারকা খ্যাতি। চ্যানেল তার নিজের স্বার্থে তাদের অনুষ্ঠানে কখন কোন শিল্পীকে দেশের সেরা তারকা আখ্যা দিবেন সেটা তারাই জানেন। কাকে কখন মার্কেটে বিক্রি করা যাবে সেটা বিজ্ঞাপনেই হোক আর অন্য কোন ডিজিটাল মার্কেটে হোক এটা সম্পূর্ণ নির্ভর করে কর্তা ব্যাক্তির উপর। দর্শক চাওয়া বা মন্তব্য অথবা পছন্দ অপছন্দ সেখানে কোন গুরুত্ব রাখেনা। আবার ব্যাবশা করা শেষে যখন শিল্পীকে ছেড়ে দেয়া হয় তখন আর ঐ শিল্পীর বাজার মূল্য থাকেনা। দ্বিতীয় ভাগ, বিভিন্ন পত্রিকার সাথে সম্পর্কিত গীতিকার, সুরকার ও তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট শিল্পীদের দখলে। মিডিয়ার মানুষ হিসেবে যতটুকু পরিচয় দিয়ে সুবিধা নেয়া যায় এখানে তার সম্পূর্ণ সুযোগ সুবিধা গ্রহন করে থাকেন সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিরা। বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রিকার বেশির ভাগ সঙ্গীত বিষয়ক সাংবাদিক এখন গীতিকার বা এ্যালবাম এরেঞ্জার। ফলে বছরে যে কয়টা সঙ্গীত বিষয়ক সংবাদ বা সমীক্ষা লেখা হয় সবটা জুড়েই তাদের পরিচিত ও কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট শিল্পীদের ঘিরে। এই সিন্ডিকেটে অন্য কারো এন্ট্রি নাই। তৃতীয় ভাগ, হচ্ছে ডিজিটাল কন্টেন্ট বিক্রয় কারীদের হাতে। বিভিন্ন মোবাইল কোম্পানি ও তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট কন্টেন্ট যোগান দাতারাই এর মূল চাবি কাঠি নাড়েন। এই গোষ্ঠী কখন যে কাকে হিট আর কখন যে কাকে কোন কারনে ফ্লপ মনে করে ও বানানোর চেষ্টা করে বোঝা মুশকিল। এই দুই কোম্পানি মিলে শিল্পীদের তাদের উপার্জিত অর্থ উপার্জন থেকে সাধারণত ৭.১৩% পেয়ে থাকেন। যেমন আমার ভোট ফর ঠোঁট এ্যালবামের ৫ মাসের উপার্জন ৬ লাখ ৬২ হাজার আমার আর আমার ভাগে পড়লো মাত্র ৯২ হাজার। আনুপাতিক হারটা ৫০/৫০ হলেও কিছুটা হজম করা যেত। এই ক্ষেত্রে সব চেয়ে বেশি হচ্ছে বৈষম্য মানে যা রেসিজম এর স্বীকার হচ্ছে টেকনিক্যালি পিছিয়ে থাকা ফোক গানের শিল্পীরা। কখনো কখনো দেখা যায় যে ঐ কোম্পানির ৬ মাসের সব চেয়ে বেশি ব্যাবশা (৫০ লাখ টাকারও অধিক) দিয়েছে শরিফ উদ্দিন নামের একজন অখ্যাত শিল্পী অথচ সে হয়তো ৫০ টাকাও পায়নি বা জানেও না। অন্যদিকে কোন রকম প্রচার যেমন বিলবোর্ড বা টিভি বিজ্ঞাপন পাচ্ছেনা অথচ এমন একজন ভুঁইফোড় শিল্পীকে নিয়ে মোবাইল কোম্পানি ব্যাস্ত হয়ে গেলো যাকে হয়তো গাবতলি,শনির আখড়া,টঙ্গী অথবা কেরিনিগঞ্জের পর কেউ চেনেনা। যে হয়তো গান শুরু করেছে ঐ কোম্পানিতে চাকরি শুরু করার পর, চাকুরির পর শিল্প প্রতিভা জেগে উঠেছে সেটাই কাজে লাগাচ্ছেন। অথবা তার কোন ভাই বা আত্মীয় ঐ কোম্পানির বড় বাবু। বাকি যে অংশটা রয়ে গেলো তারা আসলে এই ইন্ডাস্ট্রিতে খুব পুরনো অথবা খুব নতুন। তাদের বড়রা কেউ কোন অনুষ্ঠানের বিচারক হয়ে যাচ্ছে খণ্ডকালীন চুক্তিতে আর ছোটরা ৫ থেকে ১০ হাজার টাকায় হিন্দি টপটেন সিঙ্গার হিসেবে গান পরিবেশন করে মেধার অপচয় করে যাচ্ছে দেশের এই প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্তে। আর এসব চলছে গত কয়েক বছর ধরে। কখনো গ্রামের চেয়ারম্যান মেম্বারের সম্বর্ধনায় অথবা শহরের কোন জাঁকজমক পূর্ণ বিয়ে বাড়িতে। অথবা কোন হোটেল রেস্তোরায় বা ক্লাবে। আকাশ সংস্কৃতির টেলিভিশন মিডিয়া আর বছরে একটা পুরো সময় জুড়ে ভারতীয় গান এবং ভারতীয় শিল্পীদের দাপটে এমনিতেই যখন আমরা ঘরের কোনায় চাপা পড়ে গেছি তখন এদেশের মধ্যস্বত্ব ভোগীরা যেভাবে একজন শিল্পীর প্রায় ৯৩% গ্রাস করে নিচ্ছেন সেখানে বাংলা গান ও গানের শিল্পীরা কতটা সুখে থাকতে পারবে? -প্রীতম আহমেদ ১৫/০১/২০০১৫