ছাত্রলীগের কোন্দলে পণ্ড বৈশাখী আয়োজন
এ যেন বৈশাখী ঝড়। নিমিষেই লণ্ডভণ্ড সব আয়োজন। দুই দিনব্যাপী লোকসংগীত উৎসব ও কনসার্টের আয়োজন ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে পণ্ড হয়ে গেছে। চৈত্রসংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে ছাত্রলীগ আয়োজিত এ কনসার্টকে ঘিরে ছিল সাধারণ শিক্ষার্থী ও নেতাকর্মীদের মধ্যে উৎসবের আমেজ। কিন্তু সংগঠনটির একটি অংশের ক্ষোভের আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে সব আয়োজন। শুক্রবার রাত ১টা ও শনিবার সকালে দুই দফায় কনসার্টস্থলে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এতে কনসার্টের আয়োজন গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে স্পন্সর প্রতিষ্ঠান কোমল পানীয় মোজো’র প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। তাদের দাবি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ছাত্রলীগের একটি অংশের দাবি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের সঙ্গে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন জড়িত। যদিও এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন শোভন নিজে। তবে কেন্দ্রীয় সভাপতি হয়েও এ আয়োজন সম্পর্কে তাকে অবহিত করা হয়নি বলে দাবি করেন তিনি। এদিকে দুই দিনব্যাপী কনসার্টের আয়োজক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ বলে এতোদিন প্রচারণা চালানো হলেও ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর থেকে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতারা কনসার্টের আয়োজক ছাত্রলীগের পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) বলে প্রচার করেন। যদিও ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুর গতকাল এক স্ট্যাটাসে দাবি করেছেন এর সঙ্গে ডাকসুর কোনো সম্পর্ক নেই। এ কনসার্ট ছাত্রলীগের। স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন, ‘নিজেরা কোটি টাকার স্পন্সরের ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে মারামারি, ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করেছেন। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে কোণঠাসা করতে প্রচার চালাচ্ছেন এটি ডাকসু ও ছাত্রলীগের প্রোগ্রাম। অথচ ডাকসুতে এই প্রোগ্রাম নিয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি। দয়া করে নিজেদের ধান্দাবাজি, চাঁদাবাজিতে ডাকসুর নাম জড়িয়ে ডাকসুকে কলঙ্কিত করবেন না। ডাকসুর সঙ্গে এই বাণিজ্যিক কনসার্টের কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা নেই।’ প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাত পৌনে ১টার দিকে ভিসি চত্বরে এলাকায় হঠাৎ বাইকে মহড়া দিতে থাকে ছাত্রলীগের রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনের অনুসারী নেতাকর্মীরা। এর পর পরই বিভিন্ন হল থেকে প্রায় শ’খানেক নেতাকর্মী এসে মল চত্বর এলাকায় কনসার্ট স্থলে নির্মিত স্টেজ, স্পন্সর প্রতিষ্ঠানের ব্যানার ফেস্টুন, স্টল, বুথ, ফ্রিজসহ কনসার্টের বিভিন্ন সরঞ্জামে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ চালায়। প্রায় ২০ মিনিট ধরে চলে এ অগ্নিসংযোগ। এ ছাড়াও ক্যাম্পাসজুড়ে টানানো স্পন্সর প্রতিষ্ঠান মোজোর সব ব্যানার ফেস্টুনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। রাত দেড়টার দিকে ঘটনাস্থলে আসেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীসহ তার অনুসারীরা। এরপর আসেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সঞ্জিত চন্দ্র দাস ও সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন। এ সময় তাদের সঙ্গে যোগ দেয় বিভিন্ন হল থেকে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী। এ সময় তারা আগুন নেভায়। এরপর ছাত্রলীগের শীর্ষ এ তিন নেতা ডাকসুতে গিয়ে মিটিং করে। অন্যদিকে তাদের অনুসারী নেতাকর্মীরা মল চত্বর ও মধুর ক্যান্টিন এলাকায় মিছিল করে। ‘সন্ত্রাসীদের কালো হাত, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’ ইত্যাদি স্লোগান দেয়। ঘটনাস্থলে উপস্থিত একাধিক কেন্দ্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের নেতা মানবজমিনকে বলেন, মূলত এ কনসার্ট আয়োজন নিয়ে কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনকে অবহিত করা হয়নি বলে তার নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়ে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। তারা বলেন, ডাকসুতে নির্বাচিত কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী, বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সঞ্জিত চন্দ্র দাস মিলে কনসার্টের আয়োজন করে। অথচ কেন্দ্রীয় সভাপতি হওয়ার পরও তাকে এ বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। তাই তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছেন। অন্যদিকে সঞ্জিত চন্দ্র দাসেরও কয়েকজন নেতাকর্মী বলেন, আয়োজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের হলেও কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী সেটিকে ডাকসুসহ ছাত্রলীগের আয়োজন বলে প্রচার করছেন। এবং ডাকসুর ক্ষমতা জাহির করছেন। এটি নিয়ে সঞ্জিতও মনঃক্ষুণ্ন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের সময় সেখানে মোটরসাইকেল নিয়ে মহড়া দিয়েছেন- সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান তাপস, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের সাধারণ সম্পাদক আল আমিন রহমান, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আতিকুর রহমান খান, অমর একুশে হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি এহসান উল্লাহ, মুহসীন হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান সানী, স্যার এফ রহমান হলের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান তুষার, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের যুগ্ম আহ্বায়ক আমির হামজাসহ অনেকে। এরা সবাই ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনের অনুসারী। এদিকে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের পর দু’টি হলে রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনের অনুসারীদের ওপর হামলা ও কক্ষে ভাঙচুর হয়েছে। রাত ৩টার দিকে এ এফ রহমান হলে শোভনের অনুসারী সাগর, মেশকাত ও মামুনকে মারধর করা হয়। পরে তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হলটিতে ভাঙচুর করা হয়েছে শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান তুষারের কক্ষে। আহতদের দাবি, ডাকসুর এজিএস সাদ্দাম হোসেনের সমর্থকরা তাদের মারধর করেছেন। এর কিছুক্ষণ পর শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আমির হামজার কক্ষেও ভাঙচুর করা হয়। এ ব্যাপারে ডাকসুর এজিএস সাদ্দাম হোসেনের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এদিকে গতকাল দুপুরে ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন। এ সময় ভিসি তাকে বলেন, তারা যদি নিজেদের মধ্যে সমস্যা মিটিয়ে চারজন এক হয় তবে তাদের প্রোগ্রাম করতে দেয়া হবে। তা না হলে কোনো প্রোগ্রাম করতে দেয়া হবে না। এরপর বিকাল তিনটার দিকে সংগঠনটির কেন্দ্র ও ঢাবির শীর্ষ চার নেতা ভিসির বাসভবনে গিয়ে বৈঠক করেন। মলচত্বরে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনা প্রসঙ্গে ঢাবি ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, এ ঘটনায় যারা দোষী তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। এদিকে হামলায় ক্ষয়ক্ষতির বর্ণনা দিয়ে মোজোর মার্কেটিং বিভাগের অপারেশন হেড (ব্র্যান্ড) আজম বিন তারেক দাবি করেন, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে তাদের প্রায় ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকার মালামালের ক্ষতি হয়েছে। তিনি বলেন, ৩৪টি স্টলের সবক’টি ভাঙচুর, ৬টিতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এ ছাড়া, ২২টি ফ্রিজের মধ্যে ১৭টি ভাঙচুর করা হয় এবং ১টিতে আগুন দেয়া হয়। এ ছাড়া সকাল সাড়ে ৮টার দিকে পুনরায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এতে সাউন্ড সিস্টেমস নষ্ট হয়ে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ এ কে এম গোলাম রব্বানী বলেন, যারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সঞ্জিত চন্দ্র দাস গত রাতে মানবজমিনকে বলেন, কনসার্টস্থলে যে বা যারাই হামলা চালিয়েছে তাদের কাউকে ছাড় নয়। আমরা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করবো এবং এ হামলার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, আমরা ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেছি। তারাও এ বিষয়টি দেখবেন। তবে কনসার্ট আর হওয়ার সম্ভাবনা নেই।