অভিনব পন্থায় খুলনার আবাসিক হোটেলগুলোতে দেহ ব্যবসা
অভিনব পন্থায় খুলনার একশ’টির বেশি আবাসিক হোটেলে দেহ ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছে। কৌশলে যৌনকর্মীদেরকে হোটেলের আয়া ও বাবুর্চি সাজিয়ে পরিচালনা করা হচ্ছে এ ব্যবসা। খুলনার সোনাডাঙ্গা মডেল থানা, সদর থানা ও খালিশপুর থানাধীন (আংশিক) এলাকাজুড়ে ১১২২ জন যৌনকর্মী রয়েছে। এর বাইরে নিরালা, সোনাডাঙ্গা, ময়লাপোতা, ডালমিল মোড়, রূপসা মোড়, খালিশপুর এলাকায় বিউটি পার্লার ও একাধিক আবাসিক ভাড়া বাড়িতে গড়ে উঠেছে মিনি পতিতালয়। সেক্ষেত্রে পেশাদার ও অপেশাদার মিলিয়ে যৌনকর্মীর সংখ্যা ১২ হাজারেরও বেশি। প্রতি বছর হাজারের উপরে যৌনকর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দারিদ্র্যতা ও কর্মসংস্থানের অভাবে সংসারে সচ্ছলতা আনতে নারীরা অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ছেন। সমপ্রতি খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ (কেএমপি) কয়েকটি আবাসিক হোটেলে অভিযান চালিয়ে অসামাজিক কার্যকলাপের অভিযোগে পুরুষ ও মহিলাসহ ৯ জনকে আটক করে। অভিযানটি ঝিমিয়ে পড়ায় কিছু অসাধু পুলিশ কর্মকর্তার ছত্রছায়ায় পুনরায় এই ব্যবসাগুলো অভিনব পন্থায় পরিচালনা করা হচ্ছে। খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার খন্দকার লুৎফুল কবির বলেন, আবাসিক হোটেল আর ভাড়াবাড়িতে যারাই এই অসামাজিক কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত থাকবে তাদের কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। এ ধরনের কোনো তথ্য থাকলে আমাকে জানিয়ে সহযোগিতা করুন। সমাজ সুরক্ষায় হোটেলগুলোতে প্রয়োজনে বিশেষ অভিযান চালানো হবে। দেহ ব্যবসার বিরুদ্ধে আমার জিহাদ ঘোষণা রইলো। জানা গেছে, খুলনা মহানগরীতে শতাধিক আবাসিক হোটেলে যৌনাচার চলছে। এসব হোটেলগুলোতে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার ছাত্রীদেরকে নিয়ে দেহ ব্যবসা পরিচালনা করা হচ্ছে। অনেক নারীকে ফাঁদে ফেলে এই পেশায় আসতে বাধ্য করা হচ্ছে। অনিরাপদ এসব যৌনাচার সামাজিকভাবে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। গোয়েন্দা সূত্র মতে, নগরীর নিরালা, সোনাডাঙ্গা, বয়রা, খালিশপুর, নিউমার্কেট এলাকায় একাধিক ভাড়াবাড়িতে গড়ে উঠেছে মিনি পতিতালয়। অবৈধ কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বিভিন্ন সময় এলাকাবাসী প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করে থাকে। এক শ্রেণির অসাধু পুলিশের সহযোগিতার কারণে অভিযানের বাস্তবতায় কোনো ফল হয় না। নগরীর বেশ কিছু বাসাবাড়িতে বিভিন্ন স্থান থেকে যৌনকর্মীদের সংগ্রহ করে আত্মীয় পরিচয় দিয়ে কয়েকজন সচতুর মহিলা দেহ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে নগরীর ডালমিল মোড় এলাকা, নিরালায় দু’টি বাড়ি, খালিশপুর হাউজিংয়ে একটি বাড়ি, রূপসা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় একটি বাড়িতে এক মহিলার নেতৃত্বে দেহ ব্যবসা চলছে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় গড়ে ওঠা বিউটি পার্লারের আড়ালে দেহ ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছে।স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন লাইট হাউজ-এর হিসাব অনুযায়ী এ বছরের ২৪শে জুন পর্যন্ত নগরীর তিন থানাধীন এলাকায় যৌনকর্মীর সংখ্যা রয়েছে ১১শ’ ২২ জন। এর মধ্যে হোটেলে যৌনকর্মীর সংখ্যা রয়েছে ৭৫ জন, আবাসিকে রয়েছে ৪৮৬ জন ও ভাসমান যৌনকর্মী রয়েছে ৫৬১ জন। এসব যৌনকর্মীকে লাইট হাউজের মাধ্যমে বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়। এর আগে ২০১৮ সালে যৌনকর্মী ছিল ১ হাজার ৪২ জন এবং ২০১৭ সালে ছিল ৮৫০ জন যৌনকর্মী। এর আগে ২০১৬ সালে ছিল ৭১৯ জন।সূত্র মতে, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন লাইট হাউজ খুলনা সদর থানা, সোনাডাঙ্গা থানা, খালিশপুর আংশিক এলাকা ও পূর্ব রূপসার আংশিক এলাকায় তাদের এই সংগঠন যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্যসেবা, প্রশিক্ষণসহ নানা ধরনের সেবা প্রদান করে থাকেন। সূত্র মতে, এই পরিসংখ্যানের বাইরে খুলনায় যৌনকর্মীর সংখ্যা রয়েছে ১২ হাজারের বেশি। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন দুর্জয় নারী সংঘের সর্বশেষ ২০০৪ সালের হিসাব অনুযায়ী নগরীতে পেশাদার যৌনকর্মী ছিল ৩ হাজার ৫০০ জন। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ওয়ার্ল্ড ভিশনের সর্বশেষ ২০০৫ সালের তথ্য অনুযায়ী নগরীতে অপেশাদার যৌনকর্মী রয়েছে প্রায় ৫ হাজার ৫০০ জন। এ ছাড়া রয়েছে ভ্রাম্যমাণ যৌনকর্মী। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কাজ করে তারা চলে যায়। শহর সংলগ্ন বিভিন্ন উপজেলা এবং বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা অঞ্চলের অভাবী মেয়েরা যৌনকাজে লিপ্ত হচ্ছে। তারা দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় শহরে আসছে এবং কাজ শেষে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে।গোয়েন্দা পুলিশের গোপন প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, নগরীর বড়বাজার হেলাতলা এলাকায় হোটেল সোসাইটি। এ হোটেলের মালিক এসএম আলম। হোটেলের ম্যানেজার সিদ্দিকুর রহমান দেহ ব্যবসা পরিচালনা করছেন। এ ছাড়া নগরীর পিকচার প্যালেস মোড়ে হোটেল আর্কেডিয়া, হোটেল আজম হোসেন ইন্টারন্যাশনাল থানার সামনে হোটেল স্টার, ফেরিঘাট মওসুমী আবাসিক হোটেল, লোয়ার যশোর রোডের সোনার বাংলা আবাসিক হোটেল, হোটেল বসুন্ধরা, হোটেল আমিনা, হোটেল সোহাগ মিলন, হোটেল শাহীন, হোটেল কদর, হোটেল সুফি, খুলনা হোটেল, হোটেল আরাম, বৈশাখী হোটেল, সুন্দরবন হোটেল, হোটেল পার্ক, হোটেল আরাফাত, বরিশাল হোটেল, হোটেল মুন, হোটেল প্যারাডাইস, সাতক্ষীরা হোটেল, হোটেল সানলাইট, হোটেল সানডে, হোটেল গোল্ডেন কিং, হোটেল মালেক গার্ডেন, হোটেল জেলিকো, হোটেল এনিটাসহ নগরীর শতাধিক হোটেলেই দেহ ব্যবসা হচ্ছে। এসব আবাসিক হোটেলগুলোতে রাতের চেয়ে দিনের বেলায় দেহ ব্যবসা হয় বেশি বলে সূত্রটি জানায়। পুলিশ ও প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিতে তারা ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছেন। যৌনকর্মীদের হোটেলের আয়া বা বাবুর্চির কার্ড ঝুলিয়ে রাখলেও মূলত তাদেরকে দিয়ে দেহ ব্যবসা পরিচালনা করা হচ্ছে। নিউমার্কেটে প্রায় অর্ধশতাধিক কলগার্ল বিচরণ করে। এক শ্রেণির দালাল তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে দেয়। নগরীর বয়রা এলাকায় দুইজন মেয়ে নিউমার্কেট থেকে ক্রেতাদের সঙ্গে কলগার্লদের কন্ট্রাক্ট করে দেয়। নিউমার্কেটের মধ্যে অনেক সময় তারা একটি নির্দিষ্ট স্থানে বসে আড্ডায় মেতে থাকেন। নগরীর বৈকালি ঝুড়ির ভিটা, মুজগুন্নী স্টেডিয়ামের পাশে, ফুলবাড়ীগেট ও বয়রা এলাকায় কয়েকটি হোস্টেলের নিবাসীদের বিরুদ্ধে যৌন কাজে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের।