অর্ধসত্য বনাম তথ্যান্বেষীর যুদ্ধ
একুশ শতকে তথ্যের বিস্ফোরণ একদিকে আমাদের দ্রুত সংবাদপ্রবাহের অভূতপূর্ব সুযোগ দিয়েছে, অন্যদিকে তৈরি করেছে নতুন যুদ্ধক্ষেত্র—যাকে বলে হচ্ছে ভুয়া সংবাদের যুদ্ধ। এটি শুধু ভুল তথ্য নয়; এটি পরিকল্পিত সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্ত্র, যা মানুষের বিশ্বাস, আবেগ এবং আচরণকে মুহূর্তেই প্রভাবিত করতে পারে।
বাংলাদেশ এই যুদ্ধে বহুবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে-সহিংসতা ঘটেছে, নির্বাচন প্রভাবিত হয়েছে, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়েছে এবং বহু নিরীহ মানুষ অন্যায়ের শিকার হয়েছে।
বাংলাদেশে ভুয়া সংবাদ ও মিসইনফরমেশনের বিস্তার বর্তমানে তথ্য-মানদণ্ড, মিডিয়া নীতিশাস্ত্র এবং গণতান্ত্রিক অনুশীলন—সবকিছুর ওপর তীব্র চাপ সৃষ্টি করেছে। ডিজিটালাইজেশনের ইতিবাচক অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এর নেতিবাচক ফলও দৃশ্যমান, বিশেষত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দ্রুত তথ্য-প্রবাহের কারণে সত্য-মিথ্যার ব্যবধান অস্পষ্ট হয়ে উঠছে (Wardle & Derakhshan, 2017)। ফলে সমাজে বিভ্রান্তি এবং জনমত নির্মাণে কৃত্রিম প্রভাব বাড়ছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মিসইনফরমেশনকে একটি কৌশলগত অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়, যা বিভিন্ন গবেষণায় ‘information warfare’ হিসেবে পরিচিত (Bennett & Livingston, 2018)। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল বা স্বার্থসংশ্লিষ্ট অনলাইন নেটওয়ার্কগুলো বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচারের মাধ্যমে জনমতকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে থাকে।
গবেষণায় দেখা গেছে, রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডামূলক ভুয়া তথ্য সাধারণ মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও রাজনৈতিক আচরণে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে (Lazer et al., 2018)। ফলে গণতন্ত্রের স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যদিও বাংলাদেশে কয়েকটি ফ্যাক্ট চেকিং প্ল্যাটফর্ম সক্রিয় রয়েছে, কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে যে মিসইনফরমেশনের পরিমাণ এত বেশি যে মানবসম্পদ দিয়ে তা সামলানো প্রায় অসম্ভব (Graves, 2018)।
তাছাড়া দর্শকরা প্রায়ই তাদের রাজনৈতিক বা আদর্শগত পক্ষপাত অনুযায়ী সত্য-মিথ্যার বিচার করে, যা ‘confirmation bias’ নামে পরিচিত (Nickerson, 1998)। ফলে ফ্যাক্ট চেকিংয়ের ফলাফল অনেক সময় বিতর্কিত হিসেবে বিবেচিত হয় এবং এর গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়।
সম্প্রতি মিস ইনফরমেশন সম্পর্কিত একটি প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছিলাম। তাতে জানলাম, বাংলাদেশের ডিজিটাল পরিবেশে এই অর্ধসত্যই সবচেয়ে দ্রুত ছড়ায়। ফেসবুকের পোস্ট, টিকটকের ক্ষুদ্র ভিডিও, ইউটিউবের অ্যালগরিদম–নির্ভর প্রোপাগান্ডা-সব মিলিয়ে আমাদের চারপাশে এমন এক তথ্যের জট তৈরি হয়েছে, যেখানে তথ্যের পরিমাণ বেশি হলেও যাচাইয়ের প্রবণতা ভয়ংকরভাবে কম।
এআই যুগের আগমনে ভুয়া তথ্যের সংকট আরও জটিল ও বহুমাত্রিক হয়ে উঠেছে। একসময় বলা হতো—‘দেখা মানেই বিশ্বাস’; এখন তা পরিণত হয়েছে—‘দেখা মানেই সন্দেহ’-এ। অত্যাধুনিক এআই ছবি ও ভিডিও এমন নিখুঁতভাবে তৈরি করতে সক্ষম যে বাস্তবতার সীমারেখা প্রায় মুছে গেছে।
২০২৪ সালের একাধিক জাতীয় নির্বাচনে এআই-প্রস্তুত প্রচারণা দৃশ্যমান প্রভাব ফেলেছে, এমনকি মনগড়া তথ্য দিয়ে গবেষণাপত্র পর্যন্ত তৈরি হওয়ার মডেলের দেখা মেলে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক উত্তাপ, সামাজিক বিভাজন ও আবেগ-প্রবণ জনমত এই পরিস্থিতিকে আরও বিপজ্জনক করে তুলছে—ভুল তথ্য এখন শুধু বিভ্রান্তি নয়; সহিংসতা উসকে দেওয়া, সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করা এবং মানুষের জীবন বিপন্ন করার শক্তি অর্জন করেছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- ভুয়া সংবাদ যাচাই