শহরে রাস্তার কুকুর-বিড়াল মেরে ফেললে ড্রেন থেকে উপরে উঠে আসে ইঁদুর। ইঁদুরের বিপদ সামলাবে কে? ক্ষেতের ফসল বাঁচায় সাপ। শহুরে সাপাতঙ্ক কৃষকের নেই—বরং ইকোসিস্টেম বা বাস্তুতন্ত্রের সহাবস্থানে অভ্যস্ত তারা। সমাজ-রাজনীতিতেও কি এমনই ঘটে?
ডনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের ‘জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল ২০২৫’ বা এনএসএস প্রকাশ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুনিয়ার কোন অঞ্চলে কেমন ভূমিকা রাখবে সেটির সাধারণ ধারণা বিবৃত হয়েছে এতে।
গুরুত্বের ক্রম অনুসারে সাজানো এই ডকুমেন্টে মার্কিনের প্রথম মাথা ব্যথা ‘পশ্চিম গোলার্ধ’ বা আমেরিকা নিয়ে। এরপরই এশিয়া— ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল — ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরকে ঘিরে থাকা বিশাল ভৌগোলিক এলাকা, যে এলাকায় রয়েছে ভারত, চীন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশ। বিশ্বের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জনসংখ্যার বাস এই অঞ্চলে। এটি এখন চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মত পরাশক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতার কেন্দ্র। বৈশ্বিক বাণিজ্য-অর্থনীতির বড় অংশী এই অঞ্চলের গুরুত্ব তাই ওয়াশিংটনের কাছে তার মিত্র শক্তি ইউরোপের চেয়েও বেশি।
ক্রয়-ক্ষমতার কল্যাণে, পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি (পিপিপি), বিশ্ব জিডিপির অর্ধেক অর্জন করে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল। একবিংশ শতাব্দী জুড়ে বাড়তেই থাকবে এই সমৃদ্ধির ধারা। আর অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক প্রধান যুদ্ধক্ষেত্রও এই অঞ্চল—এমনটাই উল্লেখ করা হয়েছে এই মার্কিন নথিতে।
অঞ্চলটি এত গুরুত্ব পেলেও ডকুমেন্টের কোথাও বাংলাদেশের নামটি নেই! ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বে বাংলদেশের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ওঠার দামামা বাজানো বয়ান এতে হোঁচট খায় বটে। তারপরও এই সমৃদ্ধির অংশীদার হওয়ার জন্য কী কৌশল নেবে তা বাংলাদেশের ভাবা উচিত।
সরকার বদল হলে এনএসএস বদল হয়। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন একটি এনএসএস প্রকাশ করেছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে কি কি বদলে যায়? এনএসএস মূলত সেদেশের সরকারি দলের দৃষ্টিভঙ্গি ও এস্টাবলিশমেন্টের কৌশলের মিশেল। যেমন প্রাজ্ঞ কূটনীতিক হেনরি কিসিঞ্জারের কথার মধ্য দিয়ে মার্কিন এস্টাব্লিশমেন্টের মনোভাব পেতাম আমরা। তিনি স্থিতিশীলতার খাতিরে রাশিয়ার কাছে ইউক্রেইনের কিছু এলাকা ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে ছিলেন। এমন কি এক সময় ইউক্রেইনকে নেটোতে অন্তর্ভুক্তির বিপক্ষেও মত ছিল তার। তাই যুদ্ধ থামাতে রাশিয়া-ইউক্রেইনের মধ্যে যা হতে যাচ্ছে তা মার্কিন এস্টাব্লিশমেন্টের আগেই ভেবে রাখা বিষয়ই মনে হচ্ছে। প্রশ্ন জাগতে পারে, তাহলে এত রক্তক্ষয়, এত জল ঘোলা কেন? কারো উসকানি ছাড়া তো আর ভলোদিমির জেলেনস্কি নিজে নিজে রাশিয়ার লেজ দিয়ে কান চুলকাতে যাননি।
আমাদের আলোচনা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের কৌশল নিয়ে। এই বিষয়ের নিয়ন্ত্রকও মার্কিন এস্টাব্লিশমেন্ট— প্রতিরক্ষা দপ্তর, পররাষ্ট্র দপ্তর, গোয়েন্দা সংস্থা ও জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ। এতে রিপাবলিকান বনাম ডেমোক্রেট দলীয় পলিটিক্সের প্রভাব কম। তাই বর্তমান এনএসএসের সুফল পাওয়া না-পাওয়ার ওপর নির্ভর করছে কৌশলটির খোলনলচে।
বিশ্ব রাজনীতির উদ্দেশ্য ও পদক্ষেপের বেশিটাই গোপনীয়তায় মোড়া—তাই এনএসএস মোটেও সহজপাঠ্য নয়। বিভিন্ন দেশের প্রতিক্রিয়ায় চোখ রেখে বুঝে নিতে হবে এর ভূত ভবিষ্যৎ।
রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেইন যুদ্ধ এখনও থামেনি। তার আগেই অবস্থান বদলেছে আঙ্কেল স্যাম। তাদের কাছে রাশিয়া আর ‘হুমকি’ নয়। এতে চটেছে ইউরোপ; বিশেষ করে পোল্যান্ড, ইউক্রেইন ও বাল্টিক দেশগুলো। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিনের পুরো ফোকাসের ঘোর বিরোধী তারা। অন্য দিকে এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছে ক্রেমলিন। মোদ্দা কথা—মার্কিন ফোকাস এখন ইন্দো-প্যাসিফিকে—এতটুকু নিশ্চিত হওয়া গেল তাদের প্রতিক্রিয়ায়।
একটা মজার খবর দিই—এনএসএসের গোপন নথি ফাঁসের দাবি উঠেছে। ওই খবরের দাবি—যুক্তরাষ্ট্র নাকি ইউরোপীয়দের নিয়ে গড়া জি-সেভেনকে পাশ কাটিয়ে ‘কোর-ফাইভ’ নামে নতুন জোট গড়তে চায়—যার অংশী দেশ যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ভারত আর জাপান। অবশ্য হোয়াইট হাউস বলছে, এটা ভুয়া খবর। তবে এনএসএসে ইউরোপ সম্পর্কে আশাব্যঞ্জক কথা নেই —ইউরোপ ভুল পথে চলছে উল্লেখ করে সেখানে বলা হয়েছে—‘the continent will be unrecognizable in 20 years or less.’ মানে ২০ বছর বা তারও কম সময়ের মধ্যে মহাদেশটি গুরুত্ব হারাবে।
ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান দেখে নেওয়া যাক। প্যাসিফিক মহাসাগরে চীনের প্রভাব রোধে রয়েছে জাপান, তাইওয়ান ও ফিলিপিন্স নিয়ে ‘ফার্স্ট আইল্যান্ড চেইন’। দ্বিতীয় মাথা ব্যথা দক্ষিণ চীন সাগরে বাধাহীন চলাচলের সুরক্ষা। সেটি বেশ নাজুক মনে করেন আঙ্কেল স্যাম। ভারত থেকে জাপান পর্যন্ত মিত্র দেশগুলোর শক্তি বৃদ্ধির মাধ্যমে তা রক্ষার নীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া নিয়ে গঠন করেছে কোয়াড। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভারতের গুরুত্বের কারণ এখানে স্পষ্ট। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশও কি এই শক্তিবৃদ্ধির ঠিকাদারি পেতে পারে?