শরিফ ওসমান হাদি আমার সন্তানসম। সে এ বিশেষণটি অর্জন করেছে। একই অঞ্চলে তার ও আমার বাড়ি। আমি পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত থাকার সময় গোটা বরিশালের বিভিন্ন জায়গা থেকে নানা কারণে আমন্ত্রিত হতাম। এমনি এক আমন্ত্রণে আমি ঝালকাঠি যাই। সেখানে একটি ভাষা শিক্ষণ প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধন করি। অনুষ্ঠানে তরুণ হাদি ছিল সঞ্চালক। তার ইংরেজি উচ্চারণ এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থান আমাকে মুগ্ধ করে। মফস্বলের একটি ছেলে, তার উদ্যোগ, তারুণ্য এবং কমিটমেন্ট তাকে আমার কাছে নিয়ে আসে। পরবর্তীকালে সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান আমারও অধীত বিষয়। আরও কাছে আসে সে। রাজনীতি নিয়ে সে আমার সঙ্গে কথা বলত। পুরোদস্তুর বাহাস করত। ইতোমধ্যে তার বাবা ইন্তেকাল করেন। আমাকে সে বাবার আসনে বসায়। তার বাড়িতে নিয়ে যায়। আমার স্ত্রীও তাকে সন্তানের মতো স্নেহ করতে থাকে। একজন সন্তান পিতার প্রতি যে সেবা, সহমর্মিতা এবং দায়িত্ব পালন করে, সেরকম আচরণ করে সে। আমার বাসায় যখন তখন তার যাতায়াত ছিল। কোনো কোনো সময় রাতেও থেকে যেত। মাস্টার্স শেষ করে সে একটি কোচিং সেন্টারে পড়াতে থাকে। আমার ইচ্ছা ছিল তাকে শিক্ষকতায় টেনে আনা। তার অস্থিরতা এবং আদর্শিক সম্পৃক্ততা এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সে ব্যস্ত থাকে সবসময়। উত্তরাধিকার সূত্রে সে ইসলামি ঘরানার ছেলে। তার বাবা আলেম ছিলেন। মসজিদে ইমামতিও করতেন। তিনি ছিলেন স্বভাবধর্মে একজন প্রতিবাদী মানুষ। যেখানে অন্যায় দেখতেন, প্রতিবাদ করতেন। হাদি যথার্থই পিতার উত্তরাধিকারকে ধারণ করে। আমি দিনে দিনে এ ছেলেটির প্রতি আবেগপ্রবণ হয়ে উঠি। আমার নিঃসন্তান হওয়াটাও হয়তোবা কারণ ছিল। সন্তানসুলভ মমত্ব দিয়ে তাকে আগলে রাখার চেষ্টা করি। একজন স্বার্থবাদী পিতার মতো আমি চাইতাম না যে, সে রাজনীতির আপদ-বিপদে জড়িয়ে পড়ুক।
২৪ সালের ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে আসার পরও সেখানে সে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়ে। আন্দোলন সংগ্রামের মাঝেও পিতৃসুলভ আচরণ থেকে সে বিরত হয়নি। বিশেষ করে ইনকিলাব মঞ্চে তার নেতৃত্ব আমাকে ভাবিয়ে তোলে। দু-একবার সে আমাকে ইনকিলাব মঞ্চে নিয়ে গেছে। এ মঞ্চের আদর্শ উদ্দেশ্যের স্বকীয়তা ও সংগ্রামশীল প্রয়াস আমার নীতিগতভাবে ভালো লেগেছে। আবার ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়েছে। তার কারণ, এর কোনো রাজনৈতিক প্রযত্ন ছিল না। মানুষের সতত স্বাভাবিক চিন্তাচেতনা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে ইনকিলাব মঞ্চ। মানুষের দুঃখ, কষ্ট ও ক্ষোভের প্রকাশ দেখা যায় ইনকিলাব মঞ্চে। যখনই কোনো অন্যায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, আশঙ্কার কারণ ঘটেছে, তখনই ইনকিলাব মঞ্চ প্রতিবাদের প্রথম সারিতে অবস্থান নিয়েছে।
ওসমান হাদির ওপর গুলিবর্ষণ আমাকে ব্যক্তিগতভাবে যেমন শোকাহত করেছে, তেমনি নাগরিকদের গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করেছে। এ আঘাত শুধু একজন তরুণ নেতার শরীরে নয়-এটি আঘাত করেছে আমাদের সময়ের বিবেকের ওপর। যে ছেলেটিকে আমি কাছ থেকে দেখেছি-যার চোখে ছিল স্বপ্ন, কণ্ঠে ছিল যুক্তি, আর আচরণে ছিল দায়িত্ব-তাকে নীরব করতে গুলি চালাতে হয়েছে, এ সত্যটাই বলে দেয়, দেশটি কতটা হাদির ওপর গুলিতে বিদীর্ণ। হাদি কখনো সুবিধার রাজনীতিতে হাঁটেনি। সে যে কথা বলেছে, তা বলেছে ঝুঁকি জেনেই; যে পথে হেঁটেছে, তা হেঁটেছে একা পড়ার আশঙ্কা মেনেই। তবু সে থামেনি, কারণ তার রাজনীতির কেন্দ্রে ছিল মানুষ-মানুষের ন্যায়বিচার, মর্যাদা আর অধিকার। ইনকিলাব মঞ্চকে ঘিরে নানা ব্যাখ্যা, নানা আশঙ্কা আছে-এটা অস্বাভাবিক নয়। নতুন কোনো রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক উদ্যোগ মানেই প্রশ্ন উঠবে। কিন্তু আমি যে হাদিকে চিনি, সে প্রতিহিংসার রাজনীতি করে না। সে শোনে, তর্ক করে, যুক্তি দেয়-কখনো আবেগি হয়, কখনো কড়া; কিন্তু ভণ্ডামি তার স্বভাব নয়। তার নেতৃত্বে ইনকিলাব মঞ্চ ছিল ক্ষোভের ভাষান্তর-অপরাজনীতির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের নৈতিক জবাব। এ মঞ্চে ছিল না প্রথাগত দলের শৃঙ্খল, ছিল না ক্ষমতার হিসাব-ছিল দাবির স্বচ্ছতা। এ স্বচ্ছতাই তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। গুলির শব্দে কেউ কেউ ভেবেছে, একটি কণ্ঠ থেমে যাবে। কিন্তু ইতিহাস বলে, গুলি কণ্ঠ স্তব্ধ করতে পারে, চিন্তা নয়। হাদির ওপর হামলা আমাদের মনে করিয়ে দেয়-এই দেশে সত্য বলার মূল্য এখনো রক্তে দিতে হয়। তবু আমি বিশ্বাস করি, হাদি শুধু একজন ব্যক্তি নয়; সে একটি ধারার নাম। সে ধারার শক্তি তার ব্যক্তিগত সাহসে নয়, মানুষের আস্থায়। আজ সে শয্যাশায়ী-কিন্তু তার উচ্চারিত প্রশ্নগুলো জেগে আছে; তার রেখে যাওয়া সাহস অন্যদের দাঁড়াতে শেখাবে।
পিতৃসুলভ আশঙ্কা নিয়ে আমি সবসময় চাইতাম সে নিরাপদ থাকুক। কিন্তু আজ বুঝি-কিছু সন্তান নিরাপত্তা নয়, দায়িত্ব বেছে নেয়। ওসমান হাদি তেমনই এক সন্তান। তার রক্ত আমাদের সময়কে প্রশ্ন করছে : আমরা কি ভয়ের কাছে নত হব, নাকি ন্যায়ের পাশে দাঁড়াব? এ প্রশ্নের উত্তরেই নির্ধারিত হবে-দেশটি আর কতটা গুলিবিদ্ধ হবে, নাকি অবশেষে সুস্থতার পথে হাঁটবে। আমার কখনো কখনো মনে হয়েছে তাকে নিবৃত্ত করি। মনে হয়েছে বাধা দিলে বাধবে লড়াই। সে লড়াই আমার পছন্দ নয়। বলি বলি, বলি বলে আর বলা হয়নি। বিশেষ করে সে যখন নিজেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে ঘোষণা করেছে, অজানা শঙ্কায় কেঁপে উঠেছে আমার বুক।
গণমাধ্যমে জোর গুজব যে, অপরাধীরা সীমান্ত অতিক্রম করেছে। ভারতের হিন্দুস্তান টাইমসে হাদির খবরটি এভাবে পরিবেশিত হয় : “ভারতকে টুকরো টুকরো করতে চেয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঢাকার রাস্তায় গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন বাংলাদেশের ছাত্রনেতা ওসমান হাদি। সেই হামলা প্রসঙ্গে মুখ খুললেন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহম্মদ ইউনূস। তার কথায়, ‘এই হামলা বাংলাদেশের অস্তিত্বের ওপর আঘাত। এ ধরনের হামলার চেষ্টাকে আমরা যে কোনো মূল্যে ব্যর্থ করে দেব। জাতির ওপর এ ধরনের অপশক্তির আঘাত কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যাবে না।’...গুলিবিদ্ধ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগেই এই ওসমান ভারতের বিকৃত একটি মানচিত্র পোস্ট করেছিলেন ফেসবুকে। একটি আলোচনা সভার সেই পোস্টে ভারতের থেকে পাঞ্জাব, লাদাখ এবং জম্মু ও কাশ্মীরকে বিচ্ছিন্ন দেখানো হয়েছিল। সেগুলোকে পাকিস্তানের এলাকা হিসাবে দেখানো হয় মানচিত্রে। এদিকে পশ্চিমবঙ্গ, বিহারের অধিকাংশ এলাকা, গোটা ঝাড়খণ্ড, উত্তরপূর্ব ভারত এবং মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশের উপকূলীয় এলাকাটিকে ‘বৃহত্তর বাংলাদেশ’-এর অংশ হিসাবে দেখানো হয়েছিল। এদিকে বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচন ঘোষণার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ঢাকা-৮ আসনের নির্দল প্রার্থী তথা ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদির মাথায় গুলি করার ঘটনায় চাপে পড়েছে ইউনূস সরকার। বিএনপিসহ একাধিক রাজনৈতিক দল দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে। এই আবহে জুলাই অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া অন্য ছাত্রনেতাদের নিরাপত্তা জোরদার করার বিষয়েও নির্দেশ দেন ইউনূস। এ ছাড়া হাদিকে গুলি করা ‘অজ্ঞাতপরিচয় বন্দুকবাজরা’ যাতে সীমান্ত পার হয়ে অন্য দেশে পালাতে না পারে, তার জন্য সীমান্তে কড়া নজরদারির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।” হিন্দুস্তান টাইমসের এ ভাষ্যটির সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। অতীতেও দেখা গেছে তারা বানিয়ে কথা বলে। মিথ্যাকে সত্য আর সত্যকে মিথ্যা বলে।