জাতীয় জীবনে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তির কথা, বিজয়ের কথা, যদি বলা হয় তবে তা হলো ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধে বিজয় অর্জনের দিনটি।
আজ থেকে ৫৪ বছর আগে সেদিন যারা শিশু ছিল আজ তারা পৌঁছে গেছে ৬০-এর কোঠায়। একটা স্বাধীন দেশ পাওয়ার গৌরব নিশ্চয়ই তারা বোঝে। সহজ কথা হলো মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের চাইতে বড় কোনো প্রাপ্তি নেই এই বাংলাদেশের মানুষের জাতীয় জীবনে। যারা বলেন, ‘আমরা একাত্তর দেখি নাই, চব্বিশ দেখেছি’–তারা সত্য কথা বলেন বটে। নিশ্চয়ই তারা একাত্তর দেখেননি, কিন্তু যখন একাত্তরের সঙ্গে চব্বিশকে তুলনা করেন, সেটা ধৃষ্টতা হয়ে যায়। ৩০ লাখ শহীদের জীবনের বিনিময়ে পাওয়া এই স্বাধীনতা, এই মানচিত্র, এই পতাকা–অন্য কোনো কিছুর সঙ্গেই তুলনীয় নয়; হতে পারে না। তাই ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরকে প্রতিস্থাপিত করা যায় না।
৩০ লাখ শহীদের প্রসঙ্গ এলেই একদল মানুষ সংখ্যাটি নিয়ে বিতর্কে অবতীর্ণ হয়ে পড়েন। সর্বশেষ আমরা দেখলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য শামীম উদ্দিন খান বললেন, বুদ্ধিজীবীদের পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হত্যা করেছে, এটা অবান্তর। তার ভাষায়, “যে সময় পাকিস্তানি সৈন্যরা আমাদের দেশ থেকে পালানোর চেষ্টা করছে, সে সময় পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করবে; আমি মনে করি এটি রীতিমত অবান্তর। কারণ, ওই সময় তারা তাদের জীবন শঙ্কায় ছিলেন।”
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার একেবারে নতুন বয়ান হাজির করেছেন। তিনি একাত্তরে বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ‘ভারতীয় সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশ’ বলে দাবি করেছেন।
এই সব নতুন সব বয়ানকে তারা এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যে নতুন প্রজন্ম সংশয়ে পড়ে যাচ্ছে। অবশ্য নতুনদের অনেকে আবার ইতিহাস অনুসন্ধানে ব্রতী হয়ে প্রতিবাদও করছে। শহীদের সংখ্যা ৩০ লাখের কম হলে যেন পাকিস্তানিদের এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের অপরাধের মাত্রা কিছু কম হয়ে যাবে।
১৯৮১ সালের জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ৩৩তম বছর উপলক্ষে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুসারে মানব ইতিহাসে যত গণহত্যা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের গণহত্যা স্বল্পতম সময়ে সর্ববৃহৎ। সেই সময় প্রতিদিন গড় প্রাণহানির সংখ্যা ছয় থেকে ১২ হাজার। পৃথিবীর গণহত্যার ইতিহাসে এটিই সর্বোচ্চ গড়।
পৃথিবীর কোনো গণহত্যায় নিহতের সংখ্যা তালিকা ধরে গণনা করে নির্ণয় করা হয়নি। বাস্তবে তা সম্ভবও ছিল না। গণহত্যার পরিসংখ্যান করার সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিটি আবিষ্কার করেছেন আমেরিকার রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রুডলফ যোসেফ রুমেল। ‘এস্টিমেটিং ডেমোসাইড: মেথডস অ্যান্ড প্রোসিডিওরস’ নিবন্ধে তিনি এই পদ্ধতি ব্যাখ্যা করেছেন। এক কথায় এই পদ্ধতিটি এমন যে, গণহত্যার সময় প্রতিদিন নিহতের গড় সংখ্যাকে যতদিন গণহত্যা চলেছে সেই সংখ্যা দিয়ে গুণ করলে মোট গণহত্যার সংখ্যাটি পাওয়া যায়। রুমেল রচিত ‘স্ট্যাটিসটিক্স অব ডেমোসাইড’ গ্রন্থটি ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থের অষ্টম অধ্যায়ে স্থান পেয়েছে– ‘স্ট্যাটিসটিক্স অব পাকিস্তান ডেমোসাইড, স্টিমেটস ক্যালকুলেশন অ্যান্ড সোর্সেস’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ। যেখানে তিনি তার আবিষ্কৃত গণহত্যার পরিসংখ্যান পদ্ধতি ব্যবহার করে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, ১৯৭১ সালের গণহত্যায় নিহতের সংখ্যা ৩০ লাখ তিন হাজার।
গত কিছুদিন ধরে দেখছি, সংখ্যার রাজনীতি নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হচ্ছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই উপ-উপাচার্য ও জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেলের মতো যারা পাকিস্তানিদের দায় মুক্তি দিতে চান, তারা আসলে তাদের পূর্বসূরিদের, তাদের দলের সাবেক নেতাদের অপরাধও কমাতে চাইছেন। বুঝতে পারছেন না, এতে তাদের অপরাধের পাল্লা আরও ভারী হচ্ছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য বলছেন, ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানিরা পালানোর চেষ্টা করছিল বলে দাবি করেন। অথচ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের ইস্টার্ন কমান্ডের জিওসি জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী এক সাক্ষাৎকারে পরিষ্কার করে বলেছেন, ভারতীয়দের সঙ্গে তার যোগাযোগই শুরু হয় ১৪ ডিসেম্বর, মার্কিন দূতাবাসের মাধ্যমে।
১৯৯৮ সালের ১৯ মার্চ সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের (ইউপিএল) প্রতিষ্ঠাতা মহিউদ্দিন আহমেদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। নিয়াজীর সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ হয়েছে ‘পাকিস্তানীদের দৃষ্টিতে একাত্তর’ নামের বইয়ে।
খোদ পাকিস্তান যখন একাত্তরের হত্যাযজ্ঞের জন্য তাদের সেনাবাহিনীকে সমালোচনা করছে, তখন বাংলাদেশে নতুন করে দায়মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়েছে। পাকিস্তানে বেলুচ রাজনীতিবিদ ও নারী অধিকারকর্মী নায়লা কাদরি বলেছেন, “ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া পাকিস্তান সমগ্র বিশ্বে সবচাইতে বেশি মুসলিম হত্যা করেছে। বাংলাদেশে ৩০ লাখ, আফগানিস্তানে চার লাখ, বেলুচিস্তানে দুই লাখ।”
পাকিস্তানের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানও বাংলাদেশে তাদের দ্বারা সংগঠিত গণহত্যা নিয়ে একই ধরণের কথা উচ্চারণ করেছেন জনসমক্ষে। কাজেই ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক নেহায়েত কুতর্ক বৈ কিছু নয়।
শুধু ৩০ লাখ শহীদই নয় আরো দুই লাখ নারীর ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন-সম্ভ্রমহানি, পরবর্তীতে গর্ভপাত এবং যুদ্ধশিশুর জন্ম। যাদের খবর কেউ জানে না। কিন্তু আজকাল দেখছি, কতিপয় ইউটিবার মাঠে নেমেছেন, এটা প্রমাণ করতে যে বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধারা মিছেমিছি পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন।
প্রকৃতপক্ষে সমস্ত ত্যাগের বিনিময়ে প্রাপ্ত স্বাধীনতা যেন স্বেচ্ছাচারিতায় পরিণত হয় স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকে। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে এসে আমরা নিজেদের শৃঙ্খলাবোধও ভুলে যাই। রাষ্ট্রকর্তৃক বিরুদ্ধ মতের দমনপীড়ন বাংলাদেশের জন্ম থেকেই আমাদের বৈশিষ্ট্য। দুর্নীতি, আইন অমান্য করার প্রবণতা আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে যায়। সবাই বা সবকিছু তো এক রকম নয়। সর্বকালে সবখানে অনেক ভালো মানুষ থাকে। অন্তত আপাত ভালো–‘ওরা কাজ করে নগরে বন্দরে’। অনেক প্রতিকূলতার মাঝেও সময়ের সঙ্গে দেশও এগোয়। এই এগোনো মাঝে মাঝে তৈলাক্ত বাঁশ ও বানরের মতো–কয় ফুট উঠল, কয় ফুট নামল–সে এক জটিল সমীকরণ।
৫৪ বছরে আমাদের দেশের স্কুলের পাঠ্যবইয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস ভিন্ন থেকে ভিন্নতরভাবে লেখা হয়েছে অন্তত চারবার। আমাদের শিশুদের ইতিহাস জানবার কোনো ধারাবাহিকতা নেই। পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রতিক সময়ে পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে নয় মাসের যুদ্ধে পরিণত করা হয়েছে। তা-ও মন্দের ভালো। আগামী দিনে ‘পাকিস্তানিরা বুদ্ধিজীবী হত্যা করেনি’ বলে আওয়াজ তুলেছেন যারা, তারা আরেকটু ক্ষমতাবান হলে হয়তো বলবেন, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ বলে কিছু হয়নি।