দায়বদ্ধ নৈতিক রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা

বিডি নিউজ ২৪ আলমগীর খান প্রকাশিত: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৪:০৪

সত্য যে, বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার পর থেকে অর্থনৈতিকভাবে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে— অন্নহীন, বস্ত্রহীন, শিক্ষাহীন মানুষের সংখ্যা অনেক হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু একইসঙ্গে সমাজে কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর সংখ্যা ও বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। সবচেয়ে বেশি যা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে তা হচ্ছে সাংস্কৃতিক চর্চা ও নীতিনৈতিকতার পরিবেশ। ধনসম্পদের বাইরে এগুলোও মানুষের সমৃদ্ধির পরিমাপক। দিনে দিনে এই অবস্থা এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির দিকে আগাচ্ছে। আমাদের রাষ্ট্র এখন যে সংকটের মধ্যে পড়েছে তাতে নৈতিক বিভ্রান্তি অনেক বেশি প্রকট। আমাদের চলমান রাজনৈতিক অবস্থাকে এক কথায় চিহ্নিত করলে দৃঢ় মূল্যবোধের অভাবে দিকভ্রান্ত জাহাজ বলা যায়।


দেশজুড়ে দুর্বলের ওপর শক্তিমানের হামলা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যসমূহের উপর আক্রমণ, স্বেচ্ছাচারী আচরণ, মব ও তৌহিদী জনতার উদ্ভব, রাষ্ট্র ও তার প্রচলিত আইনকানুনকে তোয়াক্কা না করা ইত্যাদি যেসব অসুস্থতার পরিচয় এখন রাষ্ট্র বহন করছে তা কেবল বিশেষ কোনো দলের ক্ষমতারোহণেই সারবে না। এর শিকড় যে গভীরে, অর্থাৎ রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে, সেখানে মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে। আমাদের রাজনীতিতে একটি গুণগত পরিবর্তন ছাড়া এ অসুস্থতা বাড়বে বৈ কমবে না। এজন্য প্রয়োজন রাজনীতিতে নৈতিকতা ও দৃঢ় মূল্যবোধের অনেক অনেক দৃষ্টান্ত স্থাপন করা। আমাদের রাজনীতিবিদদের কাছে কথাটা অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি।


নৈতিকতার প্রশ্নটা একবারে গ্রিক আমল অর্থাৎ সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টোটলের কিংবা প্রাচ্যে কনফুসিয়াসের আমল থেকেই একটি রাষ্ট্রীয় আচরণ ও রীতিনীতির প্রশ্ন। সক্রেটিস তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী দ্বারা ধর্মবিরোধী হিসেবে অভিযুক্ত ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন। পালিয়ে বাঁচার সুযোগ থাকলেও শিষ্যদের হতাশ করে তিনি হেমলক পান করে নৈতিক দৃঢ়তার প্রমাণ রেখেছেন এবং ওই দুর্নীতিগ্রস্ত শাসকদের চিরকালের মত ঘৃণার দণ্ডে দণ্ডিত করেছেন। প্লেটো লিখেছেন ‘রিপাবলিক’ নামে গ্রন্থ আর অ্যারিস্টোটল পড়িয়েছেন বিশ্ববিজয়ী আলেকজান্ডারকে।


অতএব একেবারে গোড়া থেকেই রাষ্ট্রের ও রাষ্ট্রনীতির সঙ্গে নীতি-দার্শনিকতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নৈতিকতা যেমন ব্যক্তিগত ও সামাজিক হয়, তেমনি রাষ্ট্রীয় হয় আর তা অধিক গুরুত্বপূর্ণও। রাষ্ট্রের কিছু নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আইনকানুন হিসেবে লিখিত রূপ লাভ করে। কিন্তু রাষ্ট্র যেহেতু স্থির নয় বরং একটি জীবন্ত, চলমান ও পরিবর্তনশীল যন্ত্র— তার পরিবর্তনশীল কঠিন আইনকানুনের উপরেও তাকে ঘিরে থাকে নীতিনৈতিকতার এক বিরাট বায়বীয় মণ্ডল যার ওজন কঠিন স্তরের চাইতেও বেশি। আর সেজন্য তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।


অথচ আমাদের রাষ্ট্রের কেবল আইনি কঠিন স্তরটিই নয়, এই বায়বীয় স্তরটিও ক্রমে দূষিত হচ্ছে। এই বায়বীয় স্তরের একটি অন্যতম উপাদান রাজনৈতিক সংস্কৃতি। স্বাধীনতাপূর্ব ও স্বাধীনতা-উত্তর কেবল নয়, নব্বই-পূর্ব ও শূন্য দশক পরবর্তী রাজনীতির মাঝে তুলনা করলেও এই সংস্কৃতির ক্রমাবনতি স্পষ্ট দৃশ্যমান। তবে এটি নতুন কিছু নয়, বিশ্বে এর বহু নজির আছে। রাষ্ট্রপরিচালকদের নৈতিক আচরণের প্রশ্নে ষোড়শ শতকের এক সাড়া জাগানো বই ম্যাকিয়াভেলির দ্য প্রিন্স— যা একপেশে হলেও বাস্তববাদী এবং রাষ্ট্রপরিচালকদের কেবল ক্ষমতাকেন্দ্রিক হওয়ার পরামর্শ দেয়। আর এটিই পশ্চাৎপদ, অগণতান্ত্রিক, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রসমূহের শাসকগোষ্ঠীর আসল ছবি।


এর বাইরে আরেক রকম রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক উদ্ভব হয়েছে ১৭৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে। যেখানে কোনোরকম আধ্যাত্মিক শক্তির দ্বারা ক্ষমতায়িত না হয়েও বা অনুরূপ দাবি না করেও কেবল মানবিক বুদ্ধিমত্তার জোরে ঘোষণা করা হয়েছে: “সৃষ্টির দিক থেকে সকল মানুষ সমান। স্রষ্টার কাছ থেকে মানুষ কতকগুলো অনস্বীকার্য অধিকার পেয়েছে— যার মধ্যে আছে জীবন, স্বাধীনতা ও সুখের সন্ধান। এসব অধিকার নিশ্চিত করার জন্যই তারা সরকার গঠন করে যার ন্যায়সঙ্গত ক্ষমতার উৎস শাসক দ্বারা শাসিত জনগণের সম্মতি। আর যখনই কোনো সরকার এই সত্যের জন্য ধ্বংসাত্মক হয়, জনগণের অধিকার আছে তাদেরকে বিলোপ করার এবং নতুন সরকার গঠনের যা এমন নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে ও এমনভাবে ক্ষমতা সংগঠিত করবে যা জনগণের নিরাপত্তা ও সুখকেই সবচেয়ে সম্ভবপর করে তুলবে।”


এর মানে এ নয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ এমন একটি সরকার পেয়ে গেছে, কিন্তু সেই লক্ষ্যে তাদের সাধনা স্পষ্ট ও অনস্বীকার্য। এরকম নৈতিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য ইউরোপ জুড়ে বড় বড় বিপ্লব হয়েছে। মার্কসবাদী আদর্শকে ধারণ করেও আরকটি সাধনা হয়েছে পশ্চিমে ও প্রাচ্যে, কোথাও কোথাও তিক্ত ফলসহ। কিন্তু যেরকম বৈশিষ্ট্যপূর্ণই হোক নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড্যারোন অ্যাসেমগলু ও জেমস রবিনসন তাদের হোয়াই নেশনস ফেইল গ্রন্থে রাষ্ট্রকে প্রধান দুরকমে ভাগ করেছেন— এক্সট্রাক্টিভ বা শোষণমূলক ও ইনক্লুসিভ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক। শোষণমূলক রাষ্ট্রে জনগণের শ্রমের ফসল শাসকগোষ্ঠীর অল্পকিছু ব্যক্তির কুক্ষিগত হয়, অন্যদিকে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রে জনগণের শ্রমের ফসল জনগণের মাঝেই ন্যায়সঙ্গতভাবে বণ্টিত হয়। প্রথম রূপের রাষ্ট্র পরিণতি পায় অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী শাসনে আর দ্বিতীয় রূপের রাষ্ট্রটি গণতান্ত্রিক উপায়ে পরিচালিত হয়। স্পষ্টতই শোষণমূলক রাষ্ট্রকে অনৈতিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রকে নৈতিক রাষ্ট্র বলা যায়।


অ্যাসেমগলু ও রবিনসনের মতে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র গঠনের জন্য অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উভয় প্রতিষ্ঠানকে হাত ধরাধরি করে চলতে ও বিকশিত হতে হয়। এ দুই ধরনের প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই আমাদের দারিদ্র্য উচ্চ পর্যায়ের। দেশে নির্বাচন পূর্বকালে এই দারিদ্র্য আরও বেশি বেশি করে প্রকাশ পাচ্ছে। কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতার ক্ষমতা ব্যবহারের ইচ্ছা ও দম্ভ যে কোনো ক্ষমতাসীনের দম্ভকেও ছাড়িয়ে যেতে শুরু করেছে। এমন অসুস্থ পরিবেশেই কোনো রাজনৈতিক নেতা বলতে পারেন, “আমাকে যারা চেনেনি তারা এখনও মাটির নিচে বসবাস করে। ... আল্লাহর মেহেরবানি, আমার জন্য সূর্য দাঁড়িয়ে থাকবে।” ক্ষমতাসীন হলে যারা তাকে চেনে না তার দল তাদেরকে কোথায় বসবাস করতে পাঠাবে ও আল্লাহ জানেন আরও কতজনকে তারা দাঁড় করিয়ে রাখবে— তা কল্পনা করাও দুরূহ। বাংলাদেশে রাজনীতিতে ব্যক্তিগতভাবে বেগম খালেদা জিয়া একটি দৃঢ় নৈতিক অবস্থান বজায় রাখতে পেরেছেন এবং ওই কারণে মানুষের আস্থা অর্জন করেছেন। কিন্তু একইসঙ্গে এটি তার দলের পরিচয়জ্ঞাপক বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠতে পারেনি, যদিও সাম্প্রতিক সময়ে তাদের উচ্চপর্যায়ে অন্তত কথাবার্তায় এরূপ চেষ্টা লক্ষণীয়।


নৈতিক রাজনীতি ও নৈতিক শাসন কেমন হতে পারে তার একটা দৃষ্টান্ত এখন বিশ্ববাসীর চোখের সামনে আছে— নিউ ইয়র্ক শহরে মেয়র হিসেবে জোহরান মামদানির বিজয়। এ নৈতিকতা অনুধাবন করতে হবে রাজনীতির বৃহৎ প্রেক্ষাপট থেকে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় যখন রাজনীতি ঘুরপাক খাচ্ছে ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, জাতি ইত্যাদি পরিচয়ের গোলকধাঁধায় তখন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী শহরে মামদানি রাজনৈতিক বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন সেখানকার গরীব মানুষের স্বার্থের পক্ষে লড়াই করে। আমাদের মত দেশে যখন মানুষে মানুষে নানারকম সামান্য পার্থক্য ঘিরে হিংসা-বিদ্বেষ, সন্ত্রাস, হত্যা, দমন-পীড়ন, হুমকি-ধামকির চর্চা হচ্ছে তখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অভিবাসীদের শহরে ঐক্যের পতাকা তুলে ধরেছেন মামদানি যার নিচে এসে দল বেঁধে দাঁড়িয়েছে মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান, ইহুদি, ল্যাটিনো, বাঙালিসহ বিচিত্র পরিচয়ের মানুষ।


মানুষ আশা করেছিল জুলাই বিপ্লব এক নতুন রাষ্ট্রের জন্ম দেবে— যা হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বৈষম্যহীন। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে বিভাজন, সংঘর্ষ, বাদ দেয়া ও ভীতির সংস্কৃতি সমাজে আসন গাড়ছে। রাষ্ট্রকে জনকল্যাণমুখী, অন্তর্ভুক্তিমূলক, নৈতিক, জনগণের কাছে দায়বদ্ধ করতে হলে প্রয়োজন আমাদের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন— এক নৈতিক জাগরণ, বিভেদের বদলে ঐক্য ও খেটে খাওয়া মানুষের স্বার্থের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান। মনে রাখা দরকার, ব্যক্তির নৈতিক স্খলনে যত ক্ষতি তারচেয়ে সহস্রগুণ বেশি ক্ষতি রাষ্ট্রে ও রাষ্ট্রনীতিতে নৈতিক অবনতি ঘটলে। প্রচলিত রাজনীতির ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত দৃষ্টান্তকে কাজে লাগাতে হবে সেজন্য।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও