ভূমিকম্পের ক্ষতি মোকাবিলায় আধুনিক সরঞ্জাম জরুরি: ড. সারওয়ার জাহান
ড. সারওয়ার জাহান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক। ২০১৭ সালে তিনি এ প্রতিষ্ঠান থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ২০০০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান, স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদের ডিন এবং সেন্টার ফর রিজিওনাল ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৭ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় আরবানা-চ্যাম্পেইন থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষকতা গবেষণা ও পরামর্শদানে তার ৩৫ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত বিভিন্ন প্রকল্পে পরামর্শদাতা হিসাবে কাজ করেছেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে তার ৪০টিরও বেশি গবেষণামূলক প্রকাশনা রয়েছে। তিনি নগর পরিকল্পনা সম্পর্কিত দুটি গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন; বিশ্বব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত একটি গ্রন্থের সহ-লেখক। বর্তমানে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। ভূমিকম্পসহ বিভিন্ন দুর্যোগ মোকাবিলায় করণীয় নিয়ে তিনি যুগান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মোহাম্মদ কবীর আহমদ
কয়েকদিন আগে দেশে যে ভূমিকম্প (রিখটার স্কেলে ৫ দশমিক ৭, আবার কারও মতে ৬ মাত্রার) হলো, এর তীব্রতা ছিল স্মরণকালের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ। এ ঘটনায় হাইরাইজ বিল্ডিংয়ে বসবাসকারীরা সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত হয়েছিলেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে আরও বড় ভয়াবহ ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি ন্যূনতম পর্যায়ে রাখাতে কী পদক্ষেপ নিতে হবে?
ড. সারওয়ার জাহান : আমাদের দেশে অপরিকল্পিত নগরায়ণ হয়েছে। তাই ভয়াবহ ভূমিকম্প হলে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। রাজধানীসহ সারা দেশে যথাযথ নিয়ম না মেনে অনেক ভবন তৈরি করা হয়েছে। সেসব ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের কাঠামো রাতারাতি পরিবর্তন করা না গেলেও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি (রেট্রোফিটিং) অবলম্বন করে ঝুঁকি কমানো সম্ভব। এসব কথা আমরা বহুদিন বললেও মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোকে ঝুঁকিমুক্ত করার জন্য জোরালো পদক্ষেপ নিয়েছে-এমন দৃষ্টান্ত দৃশ্যমান নয়। বরং ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তথ্য মানুষ গোপন করার চেষ্টা করে থাকে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর উচিত এসব ভবন চিহ্নিত করে সেগুলোকে ঝুঁকিমুক্ত করতে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া। সারা দেশে প্রতিটি ভবন যাতে যথাযথ নিয়ম মেনে তৈরি করা হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য জোরালো মনিটর করতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তাদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করছেন কি না, এজন্যও জোরালো মনিটরিং প্রয়োজন। নিয়ম না মেনে কেউ ভবন তৈরি করছে-এমন তথ্য পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্টদের যথাযথ আইনের আওতায় আনতে হবে।
কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ ঐতিহাসিক তথ্য বিশ্লেষণ করে বলেন, ৭ মাত্রার ভূমিকম্প ১০০ থেকে ১২৫ বছর এবং ৮ মাত্রার ভূমিকম্প ২৫০ থেকে ৩০০ বছর পরপর ফিরে আসার আশঙ্কা থাকে। অতীতে এ অঞ্চলে তীব্র মাত্রার যেসব ভূমিকম্প হয়েছে, তেমন ভূমিকম্প মোকাবিলায় আমাদের কী ধরনের আগাম প্রস্তুতি নেওয়া দরকার?
সারওয়ার জাহান : যে কোনো সময় তীব্র মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। এটি বিবেচনায় নিয়েই আমাদের নগর পরিকল্পনা করতে হবে এবং পরিকল্পনার বাস্তবায়নে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।
তীব্র মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানীতে কী ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে?
সারওয়ার জাহান : বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিবেচনায় নিলে এটা স্পষ্ট হয় যে, তীব্র মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানীতে অনেক ভবন ধসে পড়তে পারে; গ্যাসলাইন থেকে বিভিন্ন স্থানে অগ্নিকাণ্ডের মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে পারে; বিদ্যমান সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এমন আরও অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ও ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে পারে, যার কারণে একসঙ্গে অনেক মানুষের হতাহত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল।
তেমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় কী ধরনের প্রস্তুতি নিতে হবে?
সারওয়ার জাহান : তেমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় আগে থেকেই জোরালো প্রস্তুতি নিতে হবে। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী কর্মী বাহিনীর পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবক দলও গড়ে তুলতে হবে। রাজধানীতে খালি জায়গার সংকট তীব্র। অনেক জায়গায় দুই ভবনের মাঝে পর্যাপ্ত জায়গার অভাব রয়েছে। তীব্র মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানীতে বিভিন্ন স্থানে ভবনে আটকে পড়া মানুষকে দ্রুততম সময়ে উদ্ধার করা এক বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখে দিতে পারে। যেসব এলাকায় সড়ক সরু, সেখানে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢুকতে পারবে না। সরু সড়কের কারণে আরও নানা সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। মনে রাখা দরকার, তখন ফায়ার সার্ভিসের ভবনও ভেঙে যেতে পারে। সে পরিস্থিতি মোকাবিলায় করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও কর্মী তৈরি করতে হবে। তীব্র মাত্রার ভূমিকম্প হলে বিদ্যমান সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কাজেই ভবনে আটকে পড়া মানুষকে দ্রুততম সময়ে উদ্ধার করার জন্য বিকল্প পথে ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে পৌঁছাতে হবে। এ লক্ষ্যে রাজধানীতে প্রয়োজনীয়সংখ্যক খাল খনন করা দরকার। একসময় রাজধানীতে অনেক খাল ছিল, সেসব উদ্ধার করতে হবে; পাশাপাশি নতুন করে আরও খাল খনন করতে হবে। আকাশপথেও যাতে জোরালো উদ্ধার তৎপরতা চালানো যায়, সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
আপনি বলছিলেন, তীব্র মাত্রার ভূমিকম্প হলে গ্যাসলাইন থেকে বিভিন্ন স্থানে অগ্নিকাণ্ডের মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। তেমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় কী করণীয়?
সারওয়ার জাহান : এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরাই ভালো বলতে পারবেন। সাধারণভাবে বলা যায়, তেমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে অনেক মানুষ আহত হবে। আমাদের দেশে আগুন নেভানোর কাজে পানির সংকট দেখা দেয়। এ সমস্যা দূর করার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। আহতদের দ্রুত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের হাসপাতাল ভবনগুলোকে এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যাতে তীব্র মাত্রার ভূমিকম্পে আশপাশের অন্য ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হলেও হাসপাতালের ভবনগুলো ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী আগাম পদক্ষেপ নেওয়া হলে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনা সম্ভব।
কী ধরনের আগাম পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?
সারওয়ার জাহান : তীব্র মাত্রার ভূমিকম্প হলে সম্ভাব্য যে পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, তা বিবেচনায় নিয়ে মোকাবিলায় পদক্ষেপ নিতে হবে। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী তৈরি করে নিয়মিত মহড়া দিতে হবে। রাজধানীসহ সারা দেশে যথাযথ নিয়ম না মেনে তৈরি করা ভবনগুলো কম মাত্রার ভূমিকম্পেও ধসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। রানা প্লাজার ঘটনার পর যে ধরনের উদ্ধার তৎপরতা দেখেছি, তাতে আমাদের কর্তৃপক্ষগুলোর সক্ষমতা সম্পর্কে আমরা একটা ধারণা পেয়েছি। তীব্র মাত্রার ভূমিকম্পে রাজধানীতে একসঙ্গে অনেক ভবন ধসে পড়লে পরিস্থিতি মোকাবিলায় করণীয় নিয়ে আগে থেকেই ভাবতে হবে।
১৯৫৯ সালে যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল, তা ছিল ঢাকার ১৫ লাখ মানুষের জন্য। ১৯৭৪ সালে ঢাকার লোকসংখ্যা ছিল ২০ লাখের মতো; ১৯৮০ সালে প্রায় ৩৫ লাখ। বর্তমানে এ মহানগরীর লোকসংখ্যা প্রায় দুই কোটি। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকায় নগর পরিকল্পনা যথাযথভাবে হয়েছে কি?
সারওয়ার জাহান : সেই ১৯৫৯ সালে ১৫ লাখ লোকের জন্য ঢাকায় যে নগর পরিকল্পনা করা হয়েছিল, বলা যায় প্রায় সেই পরিকল্পনা দিয়েই এখনো চলছে। একজন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের বিভিন্ন বয়সে বিভিন্ন চাহিদা তৈরি হয়। সে চাহিদা পূরণ না করলে তার নানাবিধ শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। তেমনই একটি শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এর বিভিন্ন রকমের চাহিদা তৈরি হয়। সেসব চাহিদা পূরণ করতে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া না হলে ধীরে ধীরে নানারকম সমস্যা তৈরি হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, ঢাকায় নগর পরিকল্পনার ক্ষেত্রে তেমনটিই ঘটেছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- ভূমিকম্প
- দুর্যোগ মোকাবেলা