বাংলাদেশের সবার ফাইন্যান্স ম্যানেজমেন্ট শেখা উচিত
বর্তমান বিশ্বে অর্থই সমাজ ও রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি। আমাদের প্রতিদিনের জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্ত—হোক তা শিক্ষা, পেশা, ব্যবসা, কিংবা পরিবার পরিচালনা—সব কিছুর সঙ্গেই অর্থের একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আমাদের সমাজে এখনো “ফাইন্যান্স ম্যানেজমেন্ট” বা অর্থ ব্যবস্থাপনা শেখাকে অপ্রয়োজনীয় বা শুধু হিসাবরক্ষকদের কাজ বলে মনে করা হয়। অথচ বাস্তবে, এটি এমন একটি দক্ষতা যা প্রত্যেক মানুষের জানা উচিত। বাংলাদেশ যেমন : একটি উন্নয়নশীল অর্থনীতি, তেমনি এখানকার মানুষের আর্থিক সচেতনতা এখনো খুব সীমিত। এই সীমাবদ্ধতা দূর করা এখন সময়ের দাবি।
একজন মানুষ যতই পরিশ্রমী বা শিক্ষিত হোন না কেন, যদি তিনি অর্থের সঠিক ব্যবস্থাপনা না জানেন, তবে তার আয়ের যথাযথ ব্যবহার সম্ভব নয়। অনেকেই উচ্চ আয় সত্ত্বেও মাসের শেষের দিকে আর্থিক চাপে পড়ে যান, কারণ তারা জানেন না কীভাবে বাজেট তৈরি করতে হয়, কীভাবে সঞ্চয় রাখতে হয়, বা কীভাবে বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থ বাড়ানো যায়। অর্থ ব্যবস্থাপনা শেখা মানে শুধু খরচ কমানো নয়, এটি একটি সচেতন জীবনধারা তৈরি করা, যেখানে প্রতিটি টাকার পেছনে পরিকল্পনা ও উদ্দেশ্য থাকে।
বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম এখন গ্লোবাল অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত। অনলাইন ফ্রিল্যান্সিং, স্টার্ট-আপ, ই-কমার্স কিংবা রিমোট চাকরির সুযোগে তাদের আয়ের উৎস আগের তুলনায় বৈচিত্র্যময়। কিন্তু এই আয়ের সঙ্গে যদি সঠিক ফাইন্যানশিয়াল প্ল্যানিং না থাকে, তবে দীর্ঘমেয়াদে এই উপার্জনের স্থায়িত্ব থাকে না। অনেক তরুণ উচ্চ আয়ের শুরুতেই অতিরিক্ত ব্যয়ে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, যা পরে ঋণ বা আর্থিক অস্থিরতার কারণ হয়। অথচ যদি স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় থেকেই অর্থ ব্যবস্থাপনা শেখানো হতো, তাহলে তারা ছোটোবেলা থেকেই দায়িত্বশীল আর্থিক সিদ্ধান্ত নিতে পারত।
বাংলাদেশে অনেক পরিবারে অর্থের বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা এখনো অস্বস্তিকর বলে মনে করা হয়। পিতামাতারা সন্তানের সামনে আয় বা খরচের কথা বলেন না, ফলে সন্তানরা বড় হয়ে বাস্তব আর্থিক পরিকল্পনার ধারণা পায় না। সমাজে “অর্থ” বিষয়টিকে এখনো কিছুটা নিষিদ্ধ আলোচনার মতো দেখা হয়। অথচ ফাইন্যান্স ম্যানেজমেন্ট শেখানো মানে সন্তানকে শুধু টাকার হিসাব শেখানো নয়, বরং দায়িত্বশীলতা, মূল্যবোধ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার শিক্ষা দেওয়া। এই পরিবর্তন আমাদের পারিবারিক সংস্কৃতিতেও জরুরি।
একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে ফাইন্যান্স ম্যানেজমেন্ট শেখা রাষ্ট্রের জন্যও উপকারী। আর্থিকভাবে শিক্ষিত মানুষ কম ঋণ নেয়, বেশি সঞ্চয় করে এবং দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে। যদি দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী অর্থ ব্যবস্থাপনায় দক্ষ হয়, তবে ব্যাংকিং সেক্টরে অনিয়ম কমবে, ব্যক্তিগত ঋণ নির্ভরতা হ্রাস পাবে এবং জাতীয় সঞ্চয়ের হার বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে যেখানে প্রতি বছর বিপুল অর্থ প্রবাসী আয় হিসেবে আসে, সেখানে সেই অর্থের যথাযথ ব্যবহারের জন্য ফাইন্যান্স ম্যানেজমেন্ট শিক্ষা অপরিহার্য।
অর্থ ব্যবস্থাপনা শেখার অর্থ কেবল ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা বা বাজেট লেখা নয়। এটি একটি বহুমাত্রিক ধারণা—যার মধ্যে সঞ্চয়, বিনিয়োগ, ঋণ ব্যবস্থাপনা, কর সচেতনতা, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, এমনকি অবসর পরিকল্পনাও অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশে অধিকাংশ মানুষ এখনো জানে না কীভাবে ছোট ছোট বিনিয়োগ দিয়ে ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা গড়া যায়। অনেকেই বিমা বা শেয়ারবাজারকে “ঝুঁকিপূর্ণ” ভেবে এড়িয়ে যান, অথচ সঠিক জ্ঞান থাকলে এগুলো হতে পারে আর্থিক স্বাধীনতার বড় উপায়।
- ট্যাগ:
- মতামত
- অর্থ ব্যবস্থাপনা