জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও বেগম জিয়ার অংশগ্রহণ : প্রাসঙ্গিকতা
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়ার মনোনয়নপ্রাপ্তি নিয়ে কিছু আলোচনা চারপাশে আছে। সেগুলো কেন এবং কী উদ্দেশ্যে, সেটা নিয়েও বিস্তর বলাবলি। হতেই পারে, খালেদা জিয়া বলে কথা। তাদের কথায় যুক্তির অভাব নেই-‘তিনি কঠিন রোগে আক্রান্ত, প্রায়ই হাসপাতালে ভর্তি হন, প্রকাশ্যে আসেন না, দলীয় প্রধানের দায়িত্ব ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ছেলে তারেক রহমানের কাছে অর্পণ করেছেন, তার নির্বাচন করার দরকার কী?’ যুক্তি হিসাবে নেহায়েত মন্দ নয়। এগুলোর পালটা যুক্তি হিসাবে সোজাসাপটা-‘নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা একজন বাংলাদেশি হিসাবে তার গণতান্ত্রিক নাগরিক অধিকার, অন্যরা বলার কে? এমনটা বললে পালটা যুক্তি একটা দাঁড়ায় বটে। তবে উত্তরটা শতভাগ ‘কিন্তু’ মুক্ত হয়, কি না? সে প্রশ্নও থেকে যায়-কারণ খালেদা জিয়া বলে কথা। সম্মান দেখিয়ে সবাই তাকে দেশনেত্রী বলেন।
শেখ হাসিনার রোষানলে পড়ে তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বাড়ি ছাড়া হয়েছেন, নির্জন কারাবাস ভোগ করেছেন, দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছেন। তার হঠাৎ নির্বাচনে আসা নিয়ে কথা হতেই পারে, বিশেষ করে শেখ হাসিনার সব লিখিত অলিখিত ভাষণের প্রধান আক্রমণ লক্ষ্য ছিলেন তিনি। খালেদা জিয়ার মৃত্যুসংবাদ প্রতীক্ষায় তার অস্থিরতা তিনি কখনোই গোপন করেননি। আর তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে অন্ধ ভক্তরাও রাখঢাক না করে সুর মিলিয়েছে পৈশাচিক আনন্দে। কিন্তু সমস্যা হলো মহান আল্লাহর ইচ্ছায়-দেশবাসীর দোয়ায় তিনি এখনো জীবিত আছেন সব শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে।
এর মাঝে কাতারের আমিরের পাঠানো এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে লন্ডন গমন ও একই বাহনে প্রত্যাবর্তন আর তার সঙ্গে বিমানবন্দরে যাওয়া ও আসার পথে ভক্ত সমর্থকদের জনস্রোত কুৎসা রটনাকারীদের অন্তর্জ্বালা বাড়িয়েছে মাত্র।
এতটা যাও বা সহ্যের মধ্যে ছিল, নির্বাচনে তার অংশগ্রহণের খবরে দুর্জনের অন্তর্জ্বালা ও প্রতিক্রিয়ার তীব্রতা সাধারণের কাছে অস্পষ্ট থাকেনি মোটেও।
দেখা যাক, খালেদা জিয়ার নির্বাচনের ইতিহাস কী বলে। ১৯৯১ সালে তিনি সর্বোচ্চ অনুমোদিত পাঁচ আসনে নির্বাচন করেছিলেন, বগুড়ার দুটি আসন (৬, ৭) ঢাকার একটি (ঢাকা-৯), ফেনী-১, চট্টগ্রাম-৮ থেকে-জয়ী হয়েছিলেন পাঁচটিতেই। বলা বাহুল্য, সে নির্বাচনে শেখ হাসিনা তিনটি আসনে নির্বাচন করেছিলেন এবং ঢাকায় তখনকার উদীয়মান নেতা সাদেক হোসেন খোকার কাছে প্রায় ২০,০০০ ভোটে ও ততোধিক অপরিচিত মেজর (অব.) মান্নানের কাছে প্রায় ১৬,০০০ ভোটে পরাজিত হয়েছিলেন, সে যাত্রায় টুঙ্গিপাড়ার সবেধন নীলমণি একমাত্র আসন থেকে নির্বাচিত হয়ে সংসদযাত্রার শেষ সুযোগ কাজে লাগাতে পেরেছিলেন।
১৯৯৬-এর নির্বাচনেও খালেদা জিয়া পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন বগুড়া (৬, ৭) ফেনী-১ লক্ষ্মীপুর-২ ও চট্টগ্রাম-১ থেকে, বলা বাহুল্য, তিনি পাঁচ আসনেই বিজয়ী হয়েছিলেন বিপুল ভোটে।
২০০১-এর নির্বাচনেও খালেদা জিয়া বগুড়া-(৬,৭) খুলনা-২, ফেনী-১, লক্ষ্মীপুর-২-এই ৫ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সবকটিতেই বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছিলেন, যেখানে শেখ হাসিনা চার আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে রংপুর-৬, নড়াইলের দুটি আসন ও গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া থেকে। এবারও তার সফলতার হার ৫০ শতাংশ ছাড়ায়নি। অর্থাৎ একান্তই অপরিচিত রংপুরের নূর মোহাম্মদ মন্ডল ও নড়াইলের শহিদুল আলমের কাছে তাকে পরাজয় বরণ করতে হয়েছে।
২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশন একজনের জন্য সর্বোচ্চ তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ নির্ধারণ করলে খালেদা জিয়া সেই বিতর্কিত নির্বাচনে বগুড়া (৬, ৭) ও ফেনী-১ আসন থেকে নির্বাচন করে শতভাগ সফলতা অর্জন করেছিলেন। এমনকি ২০১৮ সালের কুখ্যাত নির্বাচনেও খালেদা জিয়া প্রার্থিতার আবেদন করেছিলেন। কিন্তু তার আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার রেকর্ডকে থামিয়ে দিতে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে তার প্রার্থিতা বাতিল করা হয়েছে।
বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে খালেদা জিয়াই একমাত্র উদাহরণ, যিনি এযাবৎ চারটি সংসদীয় নির্বাচনে ১৮টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে শতভাগ সফলতা পেয়েছেন। বিপরীতে ঈর্ষাকাতর শেখ হাসিনার বিজয়ের রেকর্ড তাকে যতটা সমৃদ্ধ করেছে, তার চেয়েও অনেক বেশি বিব্রত করেছে পরাজয়ের গ্লানি।
‘এবারের নির্বাচনে খালেদা জিয়ার প্রার্থিতা কেন’-এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাক। অনেকেই বলবেন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত খালেদা জিয়া যেখানে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের জায়গা ছেড়েছেন অনেক আগেই, জনসম্মুখে তার সর্বশেষ আবির্ভাবও বেশ অতীত এখন। তারপরও তার নির্বাচনে প্রার্থিতা এবং একটা-দুটো নয়, তিন-তিনটে আসনে, কারণটা কী? একটা প্রশ্ন করা যাক, খালেদা জিয়া কি এখন একজন সাধারণ রাজনীতিবিদ? নাকি তার চেয়ে বেশি অন্য আর কিছু? এ দেশের রাজনীতির ইতিহাসে তার আবির্ভাব কোনো পরিকল্পিত ঘটনা তো ছিল না!
রাষ্ট্রপতি জিয়ার শাহাদতবরণের পরও তিনি ছিলেন অন্তঃপুরে, রাজনীতির মাঠ থেকে যোজন দূরত্বে। বিচারপতি সাত্তার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়ী হয়ে রাষ্ট্রপতি হলেন; কিন্তু দুরভিসন্ধির মহানায়ক এদেশের রাজনীতিকে কলঙ্কিত করা নাম হোসেন এরশাদ সাত্তার সাহেবকে হটিয়ে প্রেসিডেন্ট হয়ে বসলেন, একেবারে ছক কষে। দেশ স্বৈরাচারের কবলে পড়ল। শুধু বিএনপির রাজনীতি নয়, দেশের রাজনীতিতে তখন ঘোর অমানিশা। ‘রাজনীতিতে শেষকথা নেই’-এই বয়ান প্রতিষ্ঠিত করতে এরশাদ তখন দলছুটের রাজনীতিকে প্রায় শিল্পের (!) পর্যায়ে নিয়ে গেছেন, ঠিক তখনই সবার চাপে খালেদা জিয়ার আবির্ভাব-অতিসাধারণ অভিষেক।
অকাল বৈধব্যের শোক আর বেদনা সহনীয় হওয়ার আগেই প্রায় এক দশকের স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে নিজেকে সম্পৃক্ত করলেন। গৃহকোণ থেকে উত্তাল রাজপথ-রাজনীতির পাঠশালায় নবাগত হয়েও সংক্ষিপ্ত সময়ই বিচক্ষণ আর প্রবীণ হতে হলো প্রয়োজনে। বিএনপির চেয়ারপারসন হিসাবে যাত্রা শুরু-তারপর সংগ্রামের মহাযাত্রা।
অর্থের সোনালি প্রলোভন আর পদ-পদবি অবজ্ঞা করে রইলেন আপসহীন, যখন আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা ও তার সহযাত্রী জামায়াতের কপালে কলঙ্কতিলক আঁকা হলো, বিশ্বাসঘাতকতার লজ্জা-চিহ্ন জাতীয় বেইমানের চিরস্থায়ী উপাধি দেওয়া হলো।
এলো ১৯৯১-এর জাতীয় নির্বাচন। অতীতে যিনি কখনো নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগই পাননি, তিনি শুধু সংসদ-সদস্যই নয়, প্রথম প্রদর্শনীতে হলেন প্রধানমন্ত্রী, দেশের প্রথম নারী সরকারপ্রধান। তিন দলীয় জোটের অলিখিত রূপরেখা বাস্তবায়ন করলেন অঙ্গীকার রক্ষার সততা থেকে। দেশ রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থা থেকে রূপান্তরিত হলো সংসদীয় গণতন্ত্রে। অথচ তার আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তায় তিনি যুগ যুগ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হতে পারতেন অনায়াসে। সংসদীয় ব্যবস্থায় শত-শত সংসদ-সদস্য নির্বাচনের ঝুঁকি নিতে হতো না। দেশের কর্তৃত্ব নিজের হাতে রাখার সুবর্ণ সুযোগ তিনি প্রতিজ্ঞা ভঙ্গের কালিমায় কলঙ্কিত করেননি। ১৯৯৬-এ স্থাপন করলেন আরেকটি অসাধারণ কীর্তি। সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ আর অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে সংবিধানে যুক্ত করলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। ২০০৬-পরবর্তী বাংলাদেশে হলেন আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার, এক-এগারোর সরকারের হঠকারিতায় হলেন কারা অন্তরিন। আর তারপর আওয়ামী শাসনের জাঁতাকলে পৃষ্ঠ হলেন দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে। প্রত্যক্ষ করলেন রাজনীতির আদর্শহীন নির্মমতা, হারালেন কনিষ্ঠ ছেলে আরাফাত রহমানকে আর জ্যেষ্ঠ ছেলে তারেক রহমান নির্যাতনে প্রায় পঙ্গুত্ব নিয়ে চিকিৎসার জন্য হলেন দেশছাড়া। নিজে রইলেন মাটি কামড়ে এ বাংলাদেশে।