প্রাচীন, পবিত্র ও স্মারক বৃক্ষগুলো রক্ষা পাক

www.ajkerpatrika.com মৃত্যুঞ্জয় রায় প্রকাশিত: ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ১৩:৩৬

নিসর্গবিদ, কৃষিবিজ্ঞানী ও আলোকচিত্রী ড. নওয়াজেশ আহমদের ‘মহাবনস্পতির পদাবলী’ বইটা যখনই সুযোগ পাই, তখনই দুই-চার পাতা পড়ি। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল মে, ১৯৯৩ সালে। সে বইয়ের ‘মহাদ্রুম সমাচার’ নিবন্ধে তিনি পারিল-বলধারার একটি পবিত্র বটবৃক্ষ সম্পর্কে লিখেছেন: ‘ভর এসেছে, গগন ঋষির উপর বটতলায়। সারা গায়ে ছাই মেখে আধপোড়া গজার মাছ খেয়ে গগন নেচে নেচে দৌড়িয়েছে কয়েক মাইল ঢাকের তালে তালে। মোটা কাছি দিয়ে বেঁধে বিশজন জোয়ান পুরুষও গগনকে ধরে রাখতে পারেনি। এমনি শক্তিধর নিশকাইন্দা দেওয়ের ভর!’


অনেক দিন থেকেই ইচ্ছা ছিল পারিল-বলধারার সেই প্রাচীন বটগাছটা দেখার। অবশেষে এ মাসেই সে সুযোগ এল। ড. নওয়াজেশের ভাইপো নাসিম আহমেদ নাদভী ও আজাদ ভাইয়ের সঙ্গে সেখানে গিয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। বিরাট এলাকাজুড়ে ডালপালা ছড়িয়ে সে গাছটা অনেকটা জায়গা ছেয়ে ফেলেছে। গোড়াটা পাকা করে বাঁধানো। তার তলায় শুয়ে আছে নিশকাইন্দা দেওয়ের মাটির ক্ষয়িষ্ণু অবয়ব, বিশাল দেহ, প্রায় ৪০ ফুট লম্বা আর ৩০ ফুট চওড়া। কে এই নিশকাইন্দা দেও তা কেউ বলতে পারে না। কারও কারও ধারণা, ওটা শিবের এক ভয়ংকর রূপ। প্রতিবছর পৌষসংক্রান্তির দিন সে গাছের তলায় বিরাট মেলা বসে, নিশকাইন্দা দেওয়ের পূজা হয়। ঢাক বাজে, উলুধ্বনি ও শঙ্খধ্বনিতে সে বটতলাটা উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। ভক্তরা মাটির ঘোড়া গাছের তলায় রেখে মানত করে। বড় বড় জটায়, থামের মতো গুঁড়িতে সিঁদুর-তেল দিয়ে দেবতার প্রতীক আঁকে। সে গাছটা স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে হয়ে উঠেছে এক পবিত্র বৃক্ষ। স্থানীয় বাসিন্দাদের ধারণা, গাছটার বয়স প্রায় ৩০০ বছর। গ্রামবাসীর ধারণা, বলধারার সে গাছটাই গ্রামকে ঝড়ঝাপটা ও বিপদ-আপদ থেকে শত শত বছর ধরে রক্ষা করে চলেছে। তাই ওর প্রতি তাদের এ মান্যতা। কিন্তু যে গাছকে তারা বটবৃক্ষ বলে, নামটা যার কারণে হয়েছে বলধারার বটতলা, আসলে সেটি বটগাছ না, অশ্বত্থ না। ড. নওয়াজেশ আহমদেরও সন্দেহ ছিল ওটা নিয়ে, ভেবেছিলেন পাকুড়গাছ। সে যাই হোক, গাছটি যে অনেক প্রাচীন ও পবিত্র, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

এরূপ আরও দুটি প্রাচীন গাছের দেখা পেলাম এ মাসেই। নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার হিরনাল গ্রামে সে গাছ দুটি রয়েছে। এর একটি বটগাছ, অন্যটি খিরনিগাছ। পাশাপাশি দুটি গাছের অবস্থান। বটগাছটা প্রায় তিন বিঘা জমিজুড়ে ডালপালা ছড়িয়ে জায়গাটা অন্ধকার করে ফেলেছে। অনেক খুঁজেও সে বটগাছের মূল গাছ বা গোড়া কোনটি, তা দেখতে পেলাম না। অসংখ্য ঝুরি নামিয়ে মোটা মোটা থামের মতো করে তা দিয়ে ঠেক দিয়ে রেখেছে ভারী ডালপালাগুলোকে। সে বটতলাতেও স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা পূজা করে, মানত করে। কুলাদি মৌজায় অবস্থিত সে গাছটি হিরনাল বটগাছ নামে পরিচিত। অনেকের ধারণা, বটগাছটির বয়স হবে প্রায় ৪০০ বছর। এর কাছেই রয়েছে এর চেয়েও বয়সী আরেকটি গাছ, সেখানকার অনেকেরই ধারণা সে গাছটির বয়স হবে কমপক্ষে ৫০০ বছর। সেটি বট না, খিরনিগাছ। পাশে হজরত শাহ আল হাদী (র.)-এর মাজার। সে বিশাল গাছটির গোড়াটা বৃত্তাকার বেদি করে বাঁধানো। সে গ্রামে ওই খিরনিগাছটিও পেয়েছে পবিত্র বৃক্ষের মর্যাদা, কেউ তার একটা পাতাও ছেঁড়ে না। মানত করে তা পূরণ হলে কেউ কেউ খিরনিতলায় এসে শিরনি দিয়ে যায়। এভাবেই যুগের পর যুগ ধরে মানুষের প্রগাঢ় বিশ্বাস ও ভয় গাছগুলোকে টিকিয়ে রেখেছে। গাছগুলোও গ্রামের মানুষকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে আগলে রাখছে।

রংপুরের পীরগাছা উপজেলার ইটাকুমারী জমিদারবাড়িতেও আছে প্রায় আড়াই শ বছর বয়সী একটি কাঠগোলাপগাছ। বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার ব্রাহ্মণবাড়িয়া গ্রামে আছে প্রায় ২০০ বছর বয়সী একটি শিমুলগাছ। ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার গ্রামে আছে ২২০ বছর বয়সী একটি সূর্যপুরী আমগাছ। গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার হিরণ্যকান্দিতে আছে একটি শতবর্ষী আমগাছ। বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার কাটাখালী গ্রামের কাছে আছে একটি প্রাচীন গাবগাছ। ধারণা করা হয়, এশিয়ার বৃহত্তম ও সবচেয়ে বেশি বয়সী একটি গাবগাছ আছে মাগুরা জেলার সদর উপজেলার রাঘবদাইড় ইউনিয়নের পাটকেলবাড়িয়া গ্রামে। এ দুটি গাবগাছেরই বয়স হবে কয়েক শ বছর। চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার শুড়রা গ্রামে আছে প্রায় ৫০০ বছর বয়সী একটি তেঁতুলগাছ, যা তেভাগা আন্দোলন ও সাঁওতাল বিদ্রোহের নীরব সাক্ষী হয়ে বেঁচে আছে। এসব সুসংবাদের পাশাপাশি দুঃসংবাদও শুনতে পাই। রাজশাহীর তানোরের অমৃতপুর গ্রামের সেই শতবর্ষী তেঁতুলগাছটা কেন কাটা পড়ল?


ঢাকা শহরেও কিছু শতবর্ষী বৃক্ষ আছে। এগুলোর মধ্যে হেয়ার রোডের পাদাউক, রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার সীমানাপ্রাচীরের কোলে ব্ল্যাকবিন গাছ, ফুলার রোডে উদয়ন স্কুলের সামনে থাকা তেঁতুলগাছ ও রোডের মুখে থাকা বিশাল আকৃতির রেইনট্রিগাছ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শামসুন্নাহার হল ও টিএসসির সামনে আছে শতবর্ষী বুদ্ধ নারকেলগাছ, কার্জন হলের সামনে আছে শতবর্ষী নাগলিঙ্গম ও মেহগনিগাছ, একটু দূরেই আছে কনকচূড়া ও গ্লিরিসিডিয়াগাছ। রমনা পার্কের মধ্যে আছে বিশাল আকৃতির দুটি ছাতিমগাছ। এ ছাড়া সেখানে আছে শতবর্ষী মহুয়া ও কুসুমগাছ। লেদার টেকনোলজি কলেজ চত্বরে আছে একটি প্রাচীন খিরনিগাছ। এ রকম শত শত প্রাচীন বৃক্ষ পাওয়া যাবে সারা দেশে।


অতীতে প্রায় গ্রামেই একটা বিশাল বটগাছ থাকত। সে বটগাছগুলো বিভিন্ন দেবতার থান (স্থানের বিকৃত শব্দ) হিসেবে পরিচিতি পেত। সেসব থানে প্রতিবছর বিশেষ কোনো দিনে বিশেষ দেব-দেবীর পূজা হতো, এখনো কোথাও কোথাও তা হয়। বটতলায় মেলা ও হাটবাজার বসত। নদীর ধারে খেয়াঘাটের পাড়ে বট আর অশ্বত্থগাছ লাগানো হতো, যাতে খেয়ার যাত্রীরা সেখানে জিরিয়ে অপেক্ষা করতে পারে। এমনকি অনেক স্কুলের বিশাল মাঠের কোণে থাকত বিশাল বিশাল বৃক্ষ, যার তলায় শিশুরা খেলত। আজ সেসব অনেকের কাছেই অতীতের স্মৃতি। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীপল্লিতে গিয়েও দেখেছি, সেসব গ্রামে অন্তত একটি প্রাচীন বৃক্ষ রয়েছে। মারমা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা কোনো স্থানে তাদের নতুন বসতি স্থাপনের আগে প্রথমে সে জায়গায় একটি তেঁতুলগাছ লাগিয়ে রেখে আসে। কয়েক বছর পর সেখানে গিয়ে যদি দেখতে পায় যে গাছটি খুব বেড়েছে, তাহলে সে জায়গায় তারা নতুন বসতি স্থাপন করে। সে তেঁতুলগাছই যেন ওদের রক্ষক ও প্রহরী হয়ে দাঁড়ায়।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও