ব্যাংক একীভূতকরণ : উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে?
বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ নাকি প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা। তবে পুনঃতফসিলীকরণ বিবেচনায় নিলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ যে আরও অনেক বেশি হবে তা বলাই বাহুল্য। স্বেচ্ছায় না বাধ্য হয়ে ঋণ খেলাপির তকমা পেলো, তা আপাতত বিবেচ্য বিষয় নয়, বিষয়টা হচ্ছে জনগণের সঞ্চিত অর্থ ফেরত আসছে না, ক্রমেই খেলাপির পরিমাণ ঊর্ধ্বমুখী। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যাংক যে হরিলুটের জায়গা হতে পারে তার জলজ্যান্ত প্রমাণ বেসিক, সোনালি, জনতা, পদ্মা, ন্যাশনাল ইত্যাদি কয়েকটি ব্যাংক থেকে জনগণের অর্থ উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনা।
এমন অভিযোগ আছে যে, যারা লুট করেছেন তাদের অধিকাংশই সমাজের অভিজাত শ্রেণি, রাজনৈতিক শক্তিধর, দেশের প্রচলিত আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে। অভিজাত এলাকায় তাদের বাস, বিদেশি বেশভূষায় তারা বিলাসবহুল গাড়িতে চরে বেড়ান। এক কথায়, তাদের শিল্পকারখানা তথাকথিত রুগণ কিন্তু তারা বেশ সুস্থ ও সবল। রাষ্ট্রযন্ত্র নানান সুবিধা দিয়ে এদের ঋণ ফেরত দেওয়ার প্রচেষ্টা নিয়েছে বটে কিন্তু ‘চোরে না শুনে ধর্মের কাহিনি’ অবস্থা। এদের একাংশ আবার অর্থ পাচার করে বিদেশে অঢেল সম্পদের মালিক বনেছেন।
দুই.
এমন অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক মনে হয় আটঘাট বেঁধে নেমেছে। সব ব্যাংকের অভিভাবক বলে খ্যাত বাংলাদেশ ব্যাংক সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল ব্যাংকের সঙ্গী করে তীর হারা এই লুটের সাগর পাড়ি দেব রে। তবে লুক বিফোর ইউ লিপ–ঝাঁপ দেওয়ার আগে চিন্তা করো– এই প্রবাদটি কেন্দ্রীয় তথা বাংলাদেশ ব্যাংকের মনোজগতে আছে বলে মনে হয় না। ব্যাংক একীভূতকরণ প্রক্রিয়ায় ইদানীং নেওয়া হুটহাট সিদ্ধান্ত অন্তত তাই ইঙ্গিত করে এমন ধারণা অনেকেরই।
বেদনাদায়ক বিষয়টি এই যে বিপুল পরিমাণে খেলাপি ঋণ, প্রাইভেট ব্যাংকে পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ, পাবলিক ব্যাংকে রাজনৈতিক প্রভাব, টপ টু বটম দুর্নীতি এবং এর সাথে যুক্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বল তদারকির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের আর্থিক খাত আজ প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। আর্থিক খাত যদি একটা অর্থনীতির লাইফ লাইন বলে বিবেচনা করা যায় তা হলে বাংলাদেশের অর্থনীতি যে ব্যাংক অব্যবস্থাপনার জন্য মহাসংকটের উপত্যকায় উপনীত সে কথা বুঝিয়ে বলার দরকার পড়ে না। তাই ব্যাংকগুলোর অভিভাবক কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা বাংলাদেশ ব্যাংক সিদ্ধান্ত নিয়েছে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যাংকগুলোকে অপেক্ষাকৃত সবল ব্যাংকের সাথে একীভূত করে সংকট উতরানোর পথ দেখবে। অর্থাৎ, ভালো এবং মন্দের গড়ে যদি অবস্থা হয় মোটামুটি তা হলে মন্দ কি– চিন্তা যেন অনেকটা ওই রকমই।
বিশ্বখ্যাত দার্শনিক বারট্রেনড রাসেলকে – যিনি দেখতে তেমন হ্যান্ডসাম ছিলেন না, প্রতিভায় যদিও ছিলেন অতুলনীয় – একবার এক খুব সুন্দরী নারী বিয়ের প্রস্তাব রেখে বললেন, আমাদের সন্তান যদি তোমার মগজ আর আমার রূপ পায়, তা হলে তো কেল্লাফতে । উত্তরে দার্শনিক রাসেল পাইপ টানতে টানতে বলেছিলেন, আর যদি উল্টোটা ঘটে অর্থাৎ আমার রূপ আর তোমার মগজ পায় তখন কি হবে?
তিন.
প্রসঙ্গত বলে রাখা দরকার যে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের একীভূতকরণের সফলতায় এবং বিফলতায় অনেক উদাহরণ আছে সন্দেহ নেই। বিশেষত, বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক ও শিল্প ঋণ সংস্থা নিয়ে বানানো হল বিডিবিএল যেটা ১৪ বছর ধরে ধুঁকছে উচ্চ ঋণ খেলাপি নিয়ে।
কথায় আছে, সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। একীভূতকরণে স্বর্গবাস না সর্বনাশ হবে, তা মূলত নির্ভর করবে কে কাকে প্রভাবিত করতে পারে তার ওপর। খারাপ ব্যাংকের সাথে থেকে ভালো ব্যাংক যদি খারাপ হয়তো আমছালা দুটোই যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। দুই. একীভূতকরণ বা মার্জার কি স্বেচ্ছায় না বাধ্যতামূলক? ভালো ব্যাংক কি খারাপ ব্যাংকের দায়-দেনা, সম্পদ, ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত হয়ে ‘জেনেশুনে বিষ করেছি পান’ না অনিচ্ছুক ঘোড়াকে টেনেহিঁচড়ে জোর করে পানি খাওয়ানো হচ্ছে সরকারি দণ্ডের দাপট দেখিয়ে?