রপ্তানি পণ্য বহুমুখীকরণ খুবই জরুরি
রপ্তানি পণ্য তালিকা বহুমুখীকরণে ব্যর্থতার কারণে বাংলাদেশকে চীনের দেওয়া বাণিজ্য সুবিধা কাজে লাগিয়ে দেশটিতে আমরা পণ্য রপ্তানি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাড়াতে পারছি না-এ মর্মে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে একটি জাতীয় দৈনিকে। সংক্ষিপ্ত কলেবরে প্রকাশিত সংবাদটি নানা কারণেই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। প্রকাশিত সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে, চীন বাংলাদেশকে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা দিলেও রপ্তানি পণ্য তালিকায় বৈচিত্র্য আনায় ব্যর্থতার কারণে বাংলাদেশ সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারছে না। বাংলাদেশ তার আমদানি পণ্যের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ চীন থেকে আনছে। এর বিপরীতে চীনে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি পরিমাণ মাত্র দেড় শতাংশ। ঠিক একই বিষয় লক্ষ করা যায় ভারতের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ভারত দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। কিন্তু ভারতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির পরিমাণ খুবই কম। ফলে চীন এবং ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে একতরফা সুবিধা পাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের একটি বড় ধরনের ব্যর্থতা বা সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, আমরা যেসব দেশে বিপুল পরিমাণে পণ্য রপ্তানি করি, সেসব দেশ থেকে আমাদের আমদানির পরিমাণ কম। আবার যেসব দেশ থেকে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পরিমাণ পণ্য আমদানি করে, সেসব দেশে আমাদের রপ্তানির পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম। যেমন, বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পরিমাণ পণ্য আমদানি করে চীন এবং ভারত থেকে; কিন্তু এ দুটি দেশে আমাদের পণ্য রপ্তানির পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম। আবার ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র্রে বাংলাদেশি পণ্য সবচেয়ে বেশি পরিমাণে রপ্তানি করা হয়। কিন্তু এ দুটি অঞ্চল থেকে বাংলাদেশের পণ্য আমদানির পরিমাণ কম।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ৪৮ দশমিক ২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করা হয়। এর মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২৭টি দেশে রপ্তানি করা হয় ২১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। এটি মোট রপ্তানি আয়ের ৪৪ দশমিক ২৯ শতাংশ। একই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৮ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করা হয়। অথচ ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ খুব সামান্য পরিমাণ পণ্যই আমদানি করে থাকে। বাংলাদেশ বিশ্বের দেড় শতাধিক দেশে পণ্য রপ্তানি করে থাকে। এর মধ্যে শীর্ষ ১০টি দেশ থেকে আসে মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের কাছাকাছি। বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য তালিকায় ১২৫টি পণ্য রয়েছে। এর মধ্যে তৈরি পোশাক ও সংশ্লিষ্ট পণ্য থেকে আসে মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশের মতো। অবশিষ্ট শীর্ষ ১০টি পণ্য থেকে আসে প্রায় ৮ শতাংশের মতো রপ্তানি আয়।
বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের আরও একটি বড় ধরনের দুর্বলতা হচ্ছে স্থানীয় কাঁচামালনির্ভর পণ্য রপ্তানি বাড়াতে না পারা। বর্তমানে তৈরি পোশাক একক পণ্য হিসাবে রপ্তানি তালিকার শীর্ষে রয়েছে। তৈরি পোশাক রপ্তানি খাত থেকে প্রতিবছর যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়, তা থেকে অন্তত ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্য ও ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানিতে আবারও বিদেশে চলে যায়। ফলে জাতীয় অর্থনীতিতে এ খাতের মূল্য সংযোজনের হার ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ। আমরা যদি পাট, চা, চামড়ার মতো স্থানীয় কাঁচামালনির্ভর পণ্য বেশি বেশি করে রপ্তানি তালিকায় স্থান দিতে পারতাম, তাহলে রপ্তানি আয় বহুগুণ বাড়তে পারত। এক সময় বাংলাদেশের রপ্তানি তালিকার শীর্ষে ছিল পাট ও পাটজাত পণ্য; কিন্তু আমরা পাটের বহুমুখী পণ্য উদ্ভাবন করতে ব্যর্থ হয়েছি। ফলে পাট শিল্প এখন বিপর্যয়ের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। রপ্তানি পণ্য তালিকায় যেসব পণ্য রয়েছে, তাদের বিকল্প ব্যবহার উদ্ভাবন করতে পারলে সার্বিকভাবে রপ্তানি আয় বাড়ানো সম্ভব হতো। উদাহরণ হিসাবে পাট পণ্যের ব্যবহারের বিষয়টি উল্লেখ করা যেতে পারে। বাংলাদেশের গবেষকরা পাট তন্তু দিয়ে সুতা তৈরির পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। এ সুতা তৈরি পোশাক শিল্পের কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে। তৈরি পোশাক শিল্পে যদি তুলার বদলে পাট তন্তু ব্যবহারের কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হতো, তাহলে তৈরি পোশাক শিল্প থেকে জাতীয় অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজনের হার অনেকটাই বাড়তে পারত; পাটচাষিও উপকৃত হতো। তারা উৎপাদিত পাটের উপযুক্ত দাম পেতেন। পণ্য রপ্তানি বাড়ানোর জন্য জাতীয়ভাবে লাগসই পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ আগামী বছর উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন আরও তিন বছর অর্থাৎ ২০২৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশকে দেওয়া জিএসপি (জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স) সুবিধা অব্যাহত রাখবে। তারপর জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহৃত হবে। সেই অবস্থায় ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি নিশ্চিতভাবে হ্রাস পাবে। জিএসপি সুবিধার আওতায় বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২৭ দেশে শুল্কমুক্তভাবে পণ্য রপ্তানির সুযোগ পেয়ে আসছে। ১৯৭৬ সাল থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধা দিয়ে আসছে। কোনো কোনো গবেষকের মতে, বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর বছরে ৬ থেকে ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের রপ্তানি আয় হারাবে।
আগামীতে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে টিকে থাকতে হলে এখন থেকেই উদ্যোগ নিতে হবে। দিন দিন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। অতীতকালে যখন কোনো পণ্য উৎপাদন করা হতো, তখন আন্তর্জাতিক বাজারের কথা বিবেচনা করতে হতো না। স্থানীয় চাহিদা মেটানোর জন্যই পণ্য উৎপাদিত হতো। কিন্তু পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পালটে গেছে। এখন পণ্য উৎপাদনকালে স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারের অবস্থাও বিবেচনায় রাখতে হয়। পণ্য উৎপাদনকারীর মূল লক্ষ্য থাকে কীভাবে স্থানীয় ভোক্তাদের চাহিদা মেটানোর পর বিদেশি ভোক্তাদের কাছে সংশ্লিষ্ট পণ্যের ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি করা যায়। মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু হওয়ার পর বিশ্ব একটি ‘গ্লোবাল ভিলেজে’ পরিণত হয়েছে। সুদূর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি একটি পণ্য অতি দ্রুত বাংলাদেশে চলে আসতে পারে। আবার বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্য স্বল্প সময়ের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা পৃথিবীর অন্য কোনো প্রান্তে চলে যেতে পারে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- আন্তর্জাতিক বাজার
- পণ্য রফতানি