
অগ্নিনিরোধী পদক্ষেপ ও নির্বাপণ-পরবর্তী সচেতনতা
কার্গো ভিলেজের আগুন নিভল ২৭ ঘণ্টা পর। আমরা বাণিজ্যের ক্ষয়ক্ষতি, জানমালের হিসাব মেলাচ্ছি। সরকার তদন্ত চালাচ্ছে পেছনের কারণ উদ্ঘাটনের। এ বিষয়গুলোয় মনোযোগ দেওয়া একান্ত কাম্য। তবে যে বিষয়টি মোটা দাগে উপেক্ষিত থেকে যায় তা হলো, অগ্নিকাণ্ডের সম্ভাব্য কারণগুলো জানা থাকা এবং নির্বাপণের পর আমাদের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা।
আমাদের দেশে আগুন লাগার ঘটনা অনেকটা নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৪ থেকে ১৮ অক্টোবরের ভেতর পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। এতে যে কেবল অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা নয়, ক্ষতি হয়েছে জানমালের, প্রচণ্ড চাপ পড়েছে অগ্নিনির্বাপক বাহিনীর ওপর। সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে একদিকে তদন্ত কমিটি গঠন করছে, অন্যদিকে দুর্যোগ-পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। এর ভেতর আমরা জনগণকে অগ্নিকাণ্ডের পেছনের কারণ ও আগুন নিভে যাওয়ার পরের বায়ুদূষণসংক্রান্ত সতর্কীকরণ করতে ভুলে যাচ্ছি।
গত কয়েক বছরে প্রত্যক্ষ করা অসংখ্য অগ্নিদুর্ঘটনা কখনো ছিল বৈদ্যুতিক, কখনোবা গ্যাস সিলিন্ডার উদ্ভূত। ইচ্ছাকৃত অগ্নিসংযোগ বা আর্সন তো একটি সম্ভাব্য কারণ হিসাবে থেকেই যায়। আগুন কেন ধরে, আসুন এর পেছনের কারণগুলো বোঝানোর চেষ্টা করি। গ্যাস সিলিন্ডার থেকে আগুন ধরে কেন? এর মূল কারণ হলো গ্যাসের অনিয়ন্ত্রিত নিঃসরণ বা গ্যাস-লিক। যে কোনো সিলিন্ডার যদি গ্যাস নিঃসরণ করতে থাকে, তাহলে বিশেষ করে শীতকালে, স্ট্যাটিক বা স্থির বিদ্যুৎ অগ্নিসংযোগ ঘটাতে পারে। সিলিন্ডারের কাছে ধূমপান বা আগুনের ব্যবহার এ ঝুঁকিকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। যদি গ্যাসের সিলিন্ডার বদ্ধ এলাকায়, অর্থাৎ যেখানে বায়ু চলাচল কম হয়, এমন স্থানে রাখা হয়, তাহলে লিক থেকে নির্গত গ্যাস ও বায়ুর অনুপাত দ্রুত বেড়ে যেতে পারে এবং তা আগুনের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দিতে পারে।
বৈদ্যুতিক তার থেকে আগুন লাগে কেন? মূলত, শর্ট সার্কিটের কারণে। অর্থাৎ একটি পরিবাহী তার যদি অপরিবাহী বা নিষ্ক্রিয় তারের সঙ্গে কোনোভাবে জুড়ে যায়, তাহলে হঠাৎ উচ্চ ভোল্টেজের বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয় ক্ষণিকের জন্য। বৈদ্যুতিক শক্তি রূপান্তরিত হয় তাপ শক্তিতে। অনেক ক্ষেত্রে ইলেকট্রিক তারের অন্তরণ বা ইন্সুলেশনে যদি ত্রুটি থাকে, অর্থাৎ তারের বাইরের প্লাস্টিক ছেঁড়া থাকে, তাহলে সেই ত্রুটিপূর্ণ জায়গায় উচ্চ তাপমাত্রা সঞ্চার হতে পারে। একইভাবে শীতকালে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনে বৈদ্যুতিক ওভারলোড হতে পারে, যা ইন্সুলেশন গলিয়ে উচ্চ তাপমাত্রা সঞ্চার করতে পারে। আর উচ্চ তাপ থেকে কাছাকাছি অবস্থানরত যে কোনো দাহ্য বস্তু (যেমন কাপড় বা কাঠ) থেকে আগুন ছড়িয়ে যায়।
আগুন দালানে লাগুক বা বিমানবন্দরে; গ্যাস সিলিন্ডার, বৈদ্যুতিক-তার বা আর্সন থেকে-আগুন-পরবর্তী বায়ুপ্রবাহের কারণে দূষণ ছড়িয়ে পড়ছে অন্যত্র। এতে যেমন রয়েছে স্বাস্থ্যঝুঁকি, তেমনই রয়েছে পরিবেশ দূষণের আশঙ্কা। অগ্নিসংযোগ ঘটে গেলে নির্বাপণের কাজে নিয়োজিত প্রত্যেক ব্যক্তির মাস্ক ব্যবহার করা অত্যাবশ্যক। কেননা আগুনের ধোঁয়ায় কেবল কার্বন মনোক্সাইড নয়, মিশে থাকে অন্যান্য অনেক দূষক।
এবারের কার্গো ভিলেজের আগুনের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। জমা করা কার্গোর ভেতর যেমন ছিল নানারকম ভোগ্যপণ্য, তেমনি ছিল বিপুল পরিমাণ ওষুধ ও রাসায়নিকসামগ্রী। তদুপরি, অধিকাংশ পণ্যের প্যাকাজিং যে পলিথিন বা অন্য প্লাস্টিক-সমেত করা হয়েছে, তা ধরে নেওয়া যেতে পারে। অর্থাৎ, এ আগুনের ধোঁয়ার সঙ্গে একদিকে যেমন নির্গত হয়েছে প্লাস্টিক পোড়া বিষাক্ত জৈব রাসায়নিক পদার্থ (যেমন পলি-এরোমেটিক, হ্যালোজেনেটেড জৈব রাসায়নিক পদার্থ, ইত্যাদি), তেমনই এ ধোঁয়াতে মিশে গেছে ভারী ধাতুসমৃদ্ধ ক্ষুদ্র কণিকা (পিএম ১০ বা পিএম ২.৫)। কেবল তাই নয়, ওষুধ ও রাসায়নিক পদার্থ দহন থেকে সম্ভবত নির্গত হয়েছে ক্যানসার-সৃষ্টিকারী রাসায়নিক পদার্থ (যেমন: ফিউরান কিংবা ডাইঅক্সিন)। ১৭ তারিখে বায়ুপ্রবাহ তীব্র ছিল বলে যদিও নির্গত ধূম্রকুণ্ডলী সরে গেছে আশুলিয়ার দিকে, বিমানবন্দর ও সংলগ্ন এলাকাতেও সম্ভবত ডিপোজিট করেছে ক্ষুদ্র কণিকা ও বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ। ধোঁয়া নির্গত হওয়া থেমে গেছে মনে হলেও বায়ুদূষণ কিন্তু অব্যাহত থাকে। যারা অগ্নিনির্বাপণের সময় মাস্ক ছাড়া কাজ করেছেন কিংবা আগুন নেভানোর পর উত্তরা বা আশুলিয়া এলাকায় অবস্থান করেছেন, তারা কি বায়ুদূষণের শিকার হয়েছেন? হলে কতটুকু হয়েছেন? এর বিশ্লেষণ করা আবশ্যক এবং এসব এলাকা এবং অন্যান্য সম্ভাব্য বায়ুদূষণ সংক্রমিত এলাকার জনগণকে অবহিত করা একান্ত কাম্য।
আমরা আশা করি, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পদক্ষেপ অব্যাহত রয়েছে। তবে কয়েকটি বিষয়ে আলোকপাত করা বাঞ্ছনীয়। বিমানবন্দরের কার্গো টার্মিনালে আগুন লাগার ঘটনা এর আগে কি কোথাও ঘটেছে? ঘটেছে। তুরস্কের আতাতুর্ক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ২০০৬ সালের ২৪ মে এমনই একটি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছিল। ২০২৪ সালে বেলজিয়ামের দুটি শহরের কার্গো টার্মিনালে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। তুরস্কে আগুন নেভাতে সময় লেগেছিল ৬ থেকে ৮ ঘণ্টার মতো; আর বেলজিয়ামে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টার মতো। আমাদের কার্গো ভিলেজের আগুন নেভাতে ৩ গুণের মতো সময় লাগল। কেন? সরকারের উচিত হবে ইস্তাম্বুল পৌরসভা ফায়ার সার্ভিস, আর বেলজিয়ামের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা এবং তাদের পদক্ষেপগুলোর পর্যালোচনা করা। প্রয়োজনে তাদের পরামর্শ নেওয়া। এমনটি শোনা গেছে যে, ১৭ অক্টোবরের আগুন নেভাতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিস পানিস্বল্পতায় ভুগেছে। এর ব্যাখ্যা কী? এর কারণেই কি আগুন ছড়াল এমন তীব্রতায়? আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কি এখনো অপ্রতুল? তুরস্ক আর বেলজিয়াম কীভাবে তাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সংস্কার করেছে? আমরা কী কী শিখতে পারি তাদের অভিজ্ঞতা থেকে? ভবিষ্যতে এমন অগ্নিকাণ্ড ঠেকাতে কী পদক্ষেপ নেবে কর্তৃপক্ষ? বর্তমান সরকার নিশ্চয়ই স্বচ্ছতায় বিশ্বাসী। এ আগুনসংলগ্ন এলাকার জনগণ কি নিজেদের স্বাস্থ্য-প্রতিরক্ষায় সচেতন? সরকার কি তাদের যথাযথভাবে অবহিত করেছে? দীর্ঘমেয়াদি পানি ও মাটির গুণাগুণ যে স্খলিত হতে পারে, এ বিষয়ে যথার্থ বিশ্লেষণ ও স্বচ্ছ ধারণা থাকা জরুরি।
- ট্যাগ:
- মতামত
- জানমাল রক্ষা
- অগ্নি দুর্ঘটনা