নেতৃত্বের তিন দিক, আপনি কোন দিকে?
নেতৃত্ব—একটি ছোট শব্দ। কিন্তু এর ভেতর লুকিয়ে আছে মানুষের মন, দৃষ্টি ও প্রভাব বিস্তারের এক বিশাল জগৎ। যুগে যুগে নেতৃত্বের ধরন পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু এর মূল উদ্দেশ্য একটিই—দলকে একটি যৌথ লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নেওয়া।
যুক্তরাষ্ট্রের কিংবদন্তি ফুটবল কোচ ও নেতৃত্বের প্রতীক ভিন্স লোম্বার্ডি বলেছিলেন, ‘লিডারস আরেন্ট বর্ন, দে আর মেড।’ অর্থাৎ ‘নেতারা জন্মগতভাবে তৈরি হন না; তাঁরা গড়ে ওঠেন।’ নেতৃত্ব একটি অর্জিত গুণ, যা মানুষ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চর্চা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, দায়বদ্ধতা ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বিকশিত করে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো—নেতৃত্বের ধরন কি একমাত্রিক? সব সময় কি সামনে দাঁড়িয়েই নেতৃত্ব দিতে হয়, নাকি কখনো পাশে, আবার কখনো পেছন থেকেও নেতৃত্ব দেওয়া যায়? একটি কার্যকর নেতৃত্ব গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা অত্যন্ত জরুরি।
বৈশ্বিক নেতৃত্বচর্চার প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, সামনে থেকে, পাশে থেকে এবং পেছন থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা ও সুষম প্রয়োগ একটি প্রতিষ্ঠানের সংস্কৃতি ও দলের মানসিক পরিবেশ নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই তিন দিকের নেতৃত্ব নিয়েই আজকের আলোচনা।
প্রথমত, সামনে থেকে নেতৃত্ব—দৃষ্টিভঙ্গি ও উদাহরণ স্থাপনের শক্তি। যে নেতা সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন, তিনি কেবল নির্দেশক নন, বরং একজন দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন পথপ্রদর্শক বা ভিশনারি লিডার। তিনি নিজের কাজের মাধ্যমে দেখান কীভাবে লক্ষ্য অর্জন করতে হয়। তাঁর মধ্যে থাকে উদ্ভাবনী শক্তি, সাহস ও প্রবল আত্মবিশ্বাস। এমন নেতৃত্ব দলকে অনুপ্রাণিত করে, ঐক্যবদ্ধ রাখে এবং লক্ষ্যপানে অগ্রসর করে।
এই নেতৃত্বের সুবিধা খুবই স্পষ্ট। এখানে উদ্ভাবনের সুযোগ বৃদ্ধি পায়, দলের ঐক্য দৃঢ় হয় এবং নেতা হিসেবে এক আত্মবিশ্বাসী চিত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
বিশ্ববিখ্যাত সেলফ মোটিভেশনাল বই দ্য সেভেন হ্যাবিটস অব হাইলি ইফেকটিভ পিপল–এর জনপ্রিয় আমেরিকান লেখক, শিক্ষাবিদ ও নেতৃত্বদর্শনের বিশেষজ্ঞ স্টিফেন কোভি বলেছেন, ‘হোয়াট ইউ ডু হ্যাজ ফার গ্রেটার ইমপ্যাক্ট দ্যান হোয়াট ইউ সে।’ অর্থাৎ ‘তুমি যা করো, তার প্রভাব তোমার কথার চেয়েও অনেক গভীর।’
কথা অনুপ্রেরণা জোগায়, কিন্তু কর্মই বিশ্বাস সৃষ্টি করে। যাঁরা নিজেদের দলের কাছ থেকে যে মূল্যবোধ ও আচরণ প্রত্যাশা করেন, তা নিজের কাজে ধারাবাহিকভাবে প্রদর্শন করেন আসলে তাঁরাই প্রকৃত অনুপ্রেরণাদায়ী নেতা।
তবে এর ঝুঁকিও আছে। কখনো নেতা অতিরিক্ত কর্তৃত্ববাদী হয়ে পড়তে পারেন, যা দলের মধ্যে ভয় ও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করে। এতে অনুসারীরা পরনির্ভরশীল হয়ে পড়েন, নিজস্ব চিন্তাশক্তি হারান। এই নেতৃত্ব যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি বা পরিবর্তনের সময় কার্যকর হলেও দৈনন্দিন দলগত কাজ বা সৃজনশীল প্রক্রিয়ায় সব সময় ফলপ্রসূ নয়।
দ্বিতীয়ত, পাশে থেকে নেতৃত্ব—সহযোগিতা ও শেখার সংস্কৃতি। পাশে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া মানে হলো সহযোগিতামূলক ও শেখার পরিবেশ সৃষ্টি করা, যেখানে নেতা নিজেকে দলের অংশ হিসেবে দেখেন। তিনি দলের ‘ঊর্ধ্বতন’ নন, বরং একজন সহকর্মী ও সহযাত্রী। এমন নেতৃত্বে শেখানো, পরামর্শ দেওয়া ও পারস্পরিক শেখার সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
এই ধরনের নেতৃত্বের মূল শক্তি হলো খোলামেলা যোগাযোগ, সহযোগিতা ও বিশ্বাস। এতে দলের প্রতিটি সদস্য নিজেকে মূল্যবান মনে করেন, অংশগ্রহণে আগ্রহী হন এবং একসঙ্গে শেখার সুযোগ পান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সৃজনশীল সংস্থা বা উদ্ভাবননির্ভর প্রতিষ্ঠানে এই নেতৃত্ব সবচেয়ে কার্যকর।
তবে এরও সীমাবদ্ধতা আছে। নেতা যদি অতিরিক্ত নিরপেক্ষ বা নিষ্ক্রিয় থাকেন, তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। দল বুঝতে পারে না প্রকৃত নেতৃত্ব কোথায় বা কার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। ফলে দিকনির্দেশনার ঘাটতি ঘটে, যা কর্মদক্ষতাকে প্রভাবিত করে।
এ প্রসঙ্গে যুক্তরাজ্যের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার, যিনি তাঁর দৃঢ় নেতৃত্বের জন্য ‘আয়রন লেডি’ নামে পরিচিত, বলেছিলেন—‘ডোন্ট ফলো দ্য ক্রাউড, লেট দ্য ক্রাউড ফলো ইউ।’ অর্থাৎ ‘জনতার ভিড়ে হারিয়ে যেও না; এমন হও যেন ভিড় তোমার পথ অনুসরণ করে।’
- ট্যাগ:
- মতামত
- রাজনৈতিক নেতৃত্ব