আড়িয়ল বিলের প্রাণপ্রাচুর্য

whttps: শাইখ সিরাজ প্রকাশিত: ১৪ অক্টোবর ২০২৫, ১৩:১০

বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলের এক বিশাল জলাভূমি—আড়িয়ল বিল। এটি যেন এক প্রাচীন প্রাণকোষ, যা যুগ যুগ ধরে দেশের মধ্যাঞ্চলের কৃষি, মৎস্য ও জীববৈচিত্র্যের কেন্দ্র হিসেবে টিকে আছে। মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলা এবং ঢাকার নবাবগঞ্জ ও দোহার উপজেলার বিস্তীর্ণ অংশজুড়ে বিস্তৃত প্রায় ১ লাখ ৬৭ হাজার একর আয়তনের এই বিল পদ্মা ও ধলেশ্বরীর মাঝে অবস্থিত। প্রাচীন ভূপ্রকৃতির এই জলাভূমি দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ, যেখানে প্রকৃতি, কৃষি ও মানবজীবন একে অপরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত।


বিগত কয়েক দশকে আমি বহুবার গিয়েছি আড়িয়ল বিলে। কখনো বর্ষায় নৌকায় চড়ে জেলেদের মাছ ধরা দেখেছি, কখনো শুকনো মৌসুমে কৃষকের সঙ্গে মাঠে নেমেছি। টেলিভিশনে এই বিলে নির্ভর মানুষের জীবন, তাদের সুখ-দুঃখ, বেঁচে থাকার সংগ্রাম তুলে ধরেছি।


কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আবার যখন আড়িয়ল বিলে যাওয়ার সুযোগ হলো, তখন এক ভয়ানক পরিবর্তনের মুখোমুখি হলাম। ভোরের অন্ধকার কাটিয়ে ফজরের সময় পৌঁছালাম মুন্সিগঞ্জের হাসাড়া মাছবাজারে। একসময় এই বাজারের খ্যাতি ছিল পুরো দেশে। হাসাড়া বাজারে একসময় সকালবেলা বিলের দেশি মাছের হাট বসত। কিন্তু এবার গিয়ে দেখি, সেই চিত্র বদলে গেছে। বিলের মাছ নেই বললেই চলে। বাজারভর্তি চাষের মাছ—তেলাপিয়া, পাঙাশ, রুই। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানালেন, বিলে এখন আর আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না; ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়ে তাঁরা এখন চাষের মাছ বিক্রি করছেন। মনে পড়ে গেল চলনবিলের মহিষলুটি বাজারের কথা। সেখানেও একই বিষয় দেখেছি। বিল ভরাট, পুকুর খনন, পরিবেশ ধ্বংস—সব মিলিয়ে বিলের স্বাভাবিক মাছ উৎপাদন শেষ হয়ে গেছে। মনে হলো, আড়িয়ল বিলও যেন সেই পথেই হাঁটছে।


হাসাড়া থেকে আমরা রওনা হলাম ইছামতী নদীর ঘাটে। ভোরের আলো ফুটছে, নদীতীরের মানুষ ঘুম থেকে জেগে উঠছে। ট্রলারে চড়ে যখন আমরা নদীর বুক চিরে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন মনে হচ্ছিল একসময়ের উজ্জ্বল প্রকৃতি এখন ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। নদীর জল ঘোলা, পাড়ের গাছপালা কেমন ধূসর হয়ে গেছে। দুই তীরজুড়ে এখন গড়ে উঠেছে আধুনিক ঘরবাড়ি, শহুরে রূপ নিচ্ছে গ্রাম। কোথাও কোথাও চলছে আবাসন প্রকল্প, ঝুলছে জমি বিক্রির সাইনবোর্ড।


ইছামতী নদী শেষ হয়ে মিশেছে আড়িয়ল বিলে। ১৩৬ বর্গকিলোমিটারের এক বিস্তীর্ণ জলাভূমি, যা একসময় ছিল প্রাণবৈচিত্র্যের অভয়ারণ্য। বিলে কেউ জাল ফেলছেন, কেউ কচুরিপানা জড়ো করে শুকনো মৌসুমের সবজিচাষের ধাপ তৈরি করছেন, কেউবা বিলের বুক থেকে শাপলা তুলছেন। কিন্তু আগের মতো মাছের প্রাচুর্য আর নেই। স্থানীয় জেলেরা জানালেন, সারা রাত জাল ফেলে হাতে আসে অল্প কিছু মাছ। এমনকি নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল দিয়েও তেমন কিছু ধরা পড়ে না। অথচ একসময় এই বিল ছিল দেশি মাছের ভান্ডার। রুই, কাতলা, মৃগেল, ট্যাংরা, শিং, পাবদাসহ নানান মাছ পাওয়া যেত এখানে।


আড়িয়ল বিল একসময় দেশের মাছের পুষ্টি চাহিদার বড় একটি অংশ জোগাত। বিলসংলগ্ন কৃষকেরা নিজেরাই তৈরি করতেন মাছের অভয়াশ্রম। বাঁশ, গাছের ডাল ও ঝোপঝাড় দিয়ে বানানো ‘ডেঙ্গা’ থেকে একেকজন কৃষক বছরে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার মাছ বিক্রি করতে পারতেন। আমি একাধিকবার সেই দৃশ্য টেলিভিশনের জন্য ধারণ করেছি নৌকাভর্তি মাছ, উৎসবের মতো আনন্দ। আজ সে দৃশ্য যেন শুধুই স্মৃতি।
বিলের অর্থনীতি শুধু মাছের ওপর নির্ভরশীল নয়। শুকনো মৌসুমে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো কচুরিপানার ধাপ শুকিয়ে তৈরি হয় সবজিচাষের জমি। কৃষকেরা একত্র হয়ে এখনো সেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, আড়িয়ল বিলে প্রায় ৭,৯৭০ হেক্টর আবাদযোগ্য জমি আছে। ধানই প্রধান ফসল, তবে শীতকালে প্রচুর সবজি হয় এখানে। বেগুন, লালশাক, মিষ্টিকুমড়া, কাঁচা মরিচ, টমেটো, ঢ্যাঁড়স, আরও অনেক কিছু। বিশেষ করে আড়িয়ল বিলের মিষ্টিকুমড়া বড় আকারের, ঘন মিষ্টি স্বাদের জন্য সুপরিচিত। এমন কুমড়া দেশের আর কোথাও জন্মে না।


আড়িয়ল বিলের আরেক আশ্চর্য সৌন্দর্য হলো শাপলা। বর্ষা ও শরতের সংযোগকালে পুরো বিল ঢেকে যায় শাপলায়। হাজার হাজার শাপলার ফুল যেন বিলের বুকজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এক জীবন্ত রঙিন চাদর। এই শাপলা শুধু সৌন্দর্যের নয়, অর্থনীতিরও উৎস। অনেক নারী-পুরুষ শাপলা তুলে বাজারে বিক্রি করেন, কেউ শিকড় শুকিয়ে বিক্রি করেন। বিল যেন হয়ে ওঠে জীবিকার উৎসস্থল।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও