কুমিরের হঠাৎ এই খ্যাপা আচরণ কেন?
পরবর্তী জলবায়ু সম্মেলন কপ৩০ এ বছরের নভেম্বরে ব্রাজিলের বেলেমে অনুষ্ঠিত হবে। এই সম্মেলনের প্রধান আলোচ্যসূচি হবে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার জন্য জাতিসংঘের নেতৃত্বে বিভিন্ন দেশের মধ্যে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ, বিশেষত অভিযোজন ও জলবায়ু অর্থায়ন।
পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়েই মানুষ বেঁচে আছে শুরু থেকে। অনেক প্রতিকূলতা আর বিপর্যয়ের মধ্যেও টিকে যায় শুধু মানুষ, কেউ কেউ বলেন, ‘তেলাপোকাও’! মানুষ কেবল টিকে থাকেনি, সে তার বিকাশের পথও আজ অবধি চালু রেখেছে। বিকাশ রুদ্ধ হলেই বিনাশ ত্বরান্বিত হয়।
দুনিয়াজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের মাতম গবেষকদের স্পর্শ করার অনেক আগে থেকেই মানুষের এই পথপরিক্রমা জারি ছিল। বিকল্প জীবিকা আর বসতি খুঁজে নেওয়ার কাজ মানুষের মজ্জাগত। অভিযোজনের জ্ঞান তাকে গুহা থেকে গৃহে নিয়ে এসেছে। এনেছে জঙ্গল থেকে নগরে। কিন্তু গোল বেধেছে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা অভিযোজন বিশেষজ্ঞদের তাড়াহুড়ো আর ব্র্যান্ডিং তৎপরতা নিয়ে। সে কথা বলতেই এই লেখার অবতারণা।
২.
সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্ট গণমাধ্যমকর্মী মোহসীন উল হাকিম গত ৩০ সেপ্টেম্বর এক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, ‘কাঁকড়া ধরে ফিরছিলেন সুব্রতরা। পথে বড় খাল করমজল। এখানে কুমির আছে। মাঝে মাঝেই আক্রমণ করে। গত বছর মারা গেল মোশাররফ। তাই সবাই বেশ সতর্ক। পাঁচজনের কাঁকড়াশিকারির দল। সবাই পার হয়ে গেলেন। সুব্রত ছোটখাটো মানুষ। ওঠার সময় পানিতে একটু খাবি খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। এক মুহূর্ত। দুই পা একসঙ্গে কামড়ে ধরল বিশাল এক কুমির। সাথে সাথে সুব্রতর হাত ধরে ফেলল সহযাত্রীরা। শুরু হলো টানাটানি। চারজন মিলে প্রায় তিন মিনিট চেষ্টা করল। কিন্তু পানির নিচে থাকা কুমিরের শক্তির কাছে পরাস্ত হলো। সুব্রতকে নিয়ে গেল সুন্দরবনের কুমির।’
শুধু সুব্রত নন, ২০২৪ সালের ১৫ মে সুন্দরবন–সংলগ্ন ফকিরকোনা এলাকায় খাইরুল ইসলাম মোড়ল প্রাণ হারান কুমিরের আক্রমণে। একই বছর যুবক রাজু হাওলাদার নদীতে গোসল করতে গিয়ে কুমিরের কামড়ে আহত হন।
২০২৫ সালের ১১ মে শনিবার আবদুল কুদ্দুস কুমিরের আক্রমণে আহত হয়ে ভাগ্যক্রমে বেঁচে ফেরেন। কুদ্দুস ও হালিম দলবল নিয়ে ৩৫ থেকে ৩৬ বছর ধরে মাছ, কাঁকড়া শিকারে সুন্দরবনে যাতায়াত করেন, কিন্তু কুমিরের এ রকম মারমুখী আচরণ তাঁদের নজরে পড়েনি।
এর আগে ২০১৫ সালে মধু কাটতে তালপট্টি এলাকায় গিয়ে বাঘের কবলে পড়লেও কুমিরের তাড়া খাননি কখনো। কুমিরের এ রকম আক্রমণাত্মক আচরণ সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সুন্দরবনের পশ্চিমবঙ্গ অংশেও বেশ বেড়েছে। কুমিরের হামলায় সেখানকার মানুষ তটস্থ।
২০২৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার দুপুরে সুনীল মণ্ডল সুন্দরবনের গোসাবা ব্লকের ট্রিবলিঘেরি লাগোয়া দত্ত নদে কাঁকড়া ধরতে যান। এলাকাটি পড়েছে পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন কোস্টাল থানার লাহিড়িপুর পঞ্চায়েতের মধ্যে। কাঁকড়া ধরার সময় আচমকা পেছন থেকে কুমির সুনীলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাঁকে টানতে টানতে নদীর মাঝখানে নিয়ে যায়।
৫০ বছরের সুনীল মণ্ডলকে আর জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। কুমিরের আক্রমণে নিহত ও আহতের তালিকা ক্রমে বাড়ছে। বাড়ছে বাঘ–বিধবার মতো কুমির–বিধবার সংখ্যা। কাঁকড়া ধরতে গিয়ে বা গ্রামের লাগোয়া নদীতে ঘরগৃহস্থালির কাজ করতে গিয়ে নারীরাও কুমিরের শিকার হচ্ছেন।
ওডিশা উপকূলের এক নারীকে কুমিরে টেনে নিয়ে যাওয়ার ভিডিও ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে ভাইরাল হয়েছিল। ওডিশার জাজপুরের পালাতপুর গ্রামের সেই ঘটনা নদীর কাছেই উপস্থিত এক ব্যক্তি ভিডিও করেছিলেন বলে ঘটনাটি সবার সামনে এসেছিল, না হলে আর পাঁচটা নিখোঁজ ঘটনার সঙ্গে সেটাও সবাই গুলিয়ে ফেলতেন।
এদিকে দাকোপসহ সুন্দরবনের কাছাকাছি সব কটি লোকালয়ে কুমিরের আনাগোনার খবর আগের যেকোনো সময়ের থেকে এখন বেশি। বিশেষ করে নাগর নদী সংলগ্ন এলাকায় মানুষ কুমিরের উপস্থিতিতে আতঙ্কে রয়েছেন, যা তাঁদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অনেকটা থামিয়ে দিয়েছে। দৈনন্দিন কাজে নদীর ব্যবহার নিয়ে ভয় বাড়ছে ক্রমে।