আমি যেহেতু তথ্যপ্রযুক্তির শিক্ষক, বহুদিন ধরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা আমার কাছে জানতে চায়, সফটওয়্যার প্রকৌশলী হয়ে তারা কি সফটওয়্যার ফার্মে কাজ করবে, তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক অন্য কোনো ক্যারিয়ার গড়বে, নাকি সরকারি চাকরিতে যোগ দেবে?
প্রতিটি চাকরিরই সুবিধা–অসুবিধা আছে। সরকারি চাকরিও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে সরকারি চাকরিতে কাজের নিরাপত্তা বা সামাজিক স্বীকৃতি অনেকেই পছন্দ করেন। তা ছাড়া একজন সরকারি চাকরিজীবী যে সুবিধা পান, সেটি যদি একজন প্রকৌশলী পেতে চান, তাহলে যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকার পরও কেন তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেবেন না? কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সরকারি চাকরির এই আপাত–সুবিধাও রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে নিয়োগ পাওয়া তথ্যপ্রযুক্তি কর্মকর্তাদের স্বস্তির কারণ হতে পারছে না।
সময়টা এখন তথ্যপ্রযুক্তির। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মেধাবী শিক্ষার্থীরা পড়ছে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং, কম্পিউটারবিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে। এই মেধাবীদের রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে যুক্ত করে নেওয়ার জন্য যেখানে প্রয়োজন ছিল তাদের আকৃষ্ট করার পরিকল্পনা করার, সেখানে পরিকল্পনা তো দূরে থাক, বরং যারা যুক্ত হয়েছে, তারাই এখন বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে, জটিল এক আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে তাদের ক্যারিয়ার। সবারই যে এই মনোভাব, সেটি হয়তো দাবি করা যাবে না, কিন্তু অনেকের ক্ষেত্রে এটিই বাস্তবতা।
গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে প্রোগ্রামার, সিস্টেম অ্যানালিস্ট, রক্ষণাবেক্ষণ কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন সরকারি আইসিটি কর্মকর্তারা, তাঁদের দীর্ঘদিনের নানা অভিযোগের সমাধানের জন্য জরুরি ভিত্তিতে ‘আইসিটি ক্যাডার’ প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন। কেন্দ্রীয়ভাবে বদলি ও পদোন্নতির সুযোগ সৃষ্টি করার দাবিও জানিয়ে আসছেন। সীমিত ক্যারিয়ার অগ্রগতির কারণে প্রতিভাবান আইসিটি পেশাদার এবং নবীন স্নাতকদের দেশত্যাগের বিষয়টিও তাঁরা তুলে ধরেন।
পিএসসির ভাইভা বোর্ডে উপস্থিত হয়ে দেখেছিলাম, তথ্যপ্রযুক্তি বিষয় সংশ্লিষ্ট পদের যে আবেদনকারীর মৌখিক পরীক্ষা নিয়েছি, মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে সে একই আবেদনকারী একই ধরনের পরীক্ষার মৌখিকে পুনরায় উপস্থিত হয়েছে শুধু অন্য মন্ত্রণালয়ের পদ বলে।
মাত্র কয়েক দিন আগে সেই প্রার্থীর যে জ্ঞান যাচাই করে পরীক্ষকেরা নম্বর বসিয়েছিলেন, সেই একই প্রার্থীর একই জ্ঞান আবার যাচাই করে আবারও নম্বর বসাতে হলো পরীক্ষকদের। শুধু তা–ই নয়, ইতিমধ্যে সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে কোনো মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করা প্রার্থীরাও এসেছেন ওপরের গ্রেডের পদের ভাইভা দিতে বা কর্মস্থল পরিবর্তন করতে। স্পষ্টতই এটি হয়রানিমূলক। তরুণ প্রজন্ম এ ধরনের অযৌক্তিক ও অকার্যকর ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলবে এবং তারা যে এই চাকরিতে আগ্রহী হবে না, সেটিই স্বাভাবিক। তার ওপর আছে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ না পাওয়ার সমস্যা।
তথ্যপ্রযুক্তি এমন একটি ক্ষেত্র, যেখানে প্রতিনিয়ত প্রযুক্তি পরিবর্তিত হচ্ছে। নিত্যনতুন জিনিস এসে যুক্ত হচ্ছে চলমান ব্যবস্থার সঙ্গে। রাষ্ট্র যদি মনে করে এই প্রযুক্তি কর্মকর্তাদের কাজ ঊর্ধ্বতনদের জন্য ভিডিও কনফারেন্সিং সিস্টেম প্রস্তুত রাখা আর ইন্টারনেট সংযোগ ঠিক রাখা, তাহলে সেটি হবে মেধার সর্বোচ্চ অপব্যবহার। এ কাজগুলোও গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সেটি টেকনিশিয়ান–জাতীয় পদের জন্য উপযুক্ত কাজ হতে পারে। ভবিষ্যতে উদীয়মান প্রযুক্তি, সাইবার সিকিউরিটি ইত্যাদি বিষয়ে সরকারের যে লোকবল লাগবে, সেটি তৈরি হতে পারে সরকারের নিজস্ব তথ্যপ্রযুক্তি কর্মকর্তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা করার মাধ্যমে।
ডিজিটাল সিস্টেম, সফটওয়্যার সিস্টেমের অনেকগুলো দিক আছে। কেউ ডেটাবেজ ব্যবস্থাপনায় ভালো হবে, কেউ নেটওয়ার্কিংয়ে, কেউ সফটওয়্যার উন্নয়নে, কেউ টেস্টিংয়ে। একজনের পক্ষে সব কটি দিকে দক্ষ হওয়া সম্ভব নয়।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের কোনো প্রকৌশলী হয়তো ডেটাবেজ ব্যবস্থাপনায় ভালো, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কেউ হয়তো ভালো নেটওয়ার্কিংয়ে। কিন্তু কিছুদিন পর কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজন পড়ল নেটওয়ার্কিংয়ের কাজ করার, অন্যদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজন পড়ল ডেটাবেজের কাজ করার। বর্তমান ব্যবস্থায় এক মন্ত্রণালয় থেকে অন্য মন্ত্রণালয়ে এই জনবল বিনিময় করার সুযোগ নেই। দুই মন্ত্রণালয়কেই নতুন লোক নিয়োগ দিতে হবে অথবা তৃতীয় পক্ষকে দিয়ে অতিরিক্ত ব্যয়ে কাজটি সম্পন্ন করতে হবে।