সর্বত্র স্বার্থান্বেষী চক্রের জয়জয়কার। চারদিকে তাদের সদর্প-সদম্ভ বিচরণ। সর্বত্র চলছে স্বার্থান্বেষী চক্রের কাজকারবার নিয়ে সরব আলাপ-আলোচনা। বলা হচ্ছে, স্বার্থান্বেষী চক্রের কারণে, সরকার ও প্রশাসন সঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না। রাজনীতিবিদরা বলছেন, স্বার্থান্বেষী চক্র নির্বাচন বানচাল বা পেছানোর ষড়যন্ত্র করছে। সংস্কার আটকে দেওয়ার পেছনে দায়ী করা হচ্ছে স্বার্থান্বেষী চক্রকে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বাজারের বেহাল পরিস্থিতির নেপথ্যেও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে স্বার্থান্বেষী চক্রের কালো হাতের দাপট।
বাস্তব পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে মনে হচ্ছে, এক প্রবল ও পরাক্রমশালী স্বার্থান্বেষী চক্র সমগ্র রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিকে ঘিরে রেখেছে। বিষয়টি নতুন কোনো প্রসঙ্গ নয়। বাংলাদেশের মতো ভঙ্গুর গণতন্ত্র, কর্তৃত্বপরায়ণ রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রাবল্য যেসব উন্নয়নশীল দেশে আছে, সেসব দেশে স্বার্থান্বেষী চক্র নানা মুখোশ ও ছদ্মাবরণে উপস্থিত হয়ে থাকে। আশঙ্কার কথা হলো, শত আন্দোলন, সংগ্রাম, বিপ্লব, অভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদ, স্বৈরতন্ত্র ভেসে গেলেও স্বার্থান্বেষী চক্র রয়েছে বহাল তবিয়তে। বরং এরাই হয়েছে আরও শক্তিশালী ও সক্রিয়।
দেশের মানুষের কাছে স্বার্থান্বেষী চক্র মোটেও অজানা চরিত্র নয়। স্বার্থান্বেষী চক্র বা মহল বলতে বোঝায় এমন গোষ্ঠী, সংগঠন বা ব্যক্তিদের, যাদের মূল উদ্দেশ্য নিজের কোনো বিশেষ সুবিধা অর্জন করা। এরা প্রায়ই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামাজিক পরিস্থিতিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে। এরা প্রশাসন, শিক্ষকতা, সাংবাদিকতা, আইন পেশা ইত্যাদি কর্ম ও বৃত্তিতে নিয়োজিত থেকে উচ্চতর পদ বাগানোর মাধ্যমে একক বা গোষ্ঠীগতভাবে নিজের কোনো বিশেষ সুবিধা, লাভ বা প্রভাব হাসিল করতে কাজ করে। পরিতাপের বিষয় হলো, এদের ষড়যন্ত্র ও অপকর্মের কাছে দেশ ও দেশের মানুষ নানাভাবে জিম্মি হয়ে রয়েছে।
সাধারণ আলোচনার বাইরে একাডেমিক আলোচনায়ও স্বার্থান্বেষী চক্রবিষয়ক নানা ইস্যু আলোচিত হচ্ছে। ১৭ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞান অনুষদ কনফারেন্স কক্ষে সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তা কেন্দ্রের উদ্যোগে ‘জুলাই বিপ্লবের পূর্বাপর : বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি’ শীর্ষক এক সেমিনারেও বক্তারা এ প্রসঙ্গের অবতারণা করেন। তারা বলেন, ‘স্বার্থান্বেষী চক্রের কারণে অতীতের অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম বিফল হয়েছে। তাই রাজনৈতিক শক্তির পাশাপাশি নাগরিক সমাজ ও ছাত্র-যুব শক্তিকে জুলাই বিপ্লবের চেতনাকে সমুন্নত রাখতে ভ্যানগার্ডের ভূমিকা পালন করতে হবে।’
কথাগুলো খুবই সত্য। ইতিহাস তেমন প্রমাণই দেয়। যেমন, ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শক্তির বিদায়ে উপমহাদেশে প্রথমবারের মতো স্বাধীনতা আসে ১৯৪৭ সালে। প্রতিষ্ঠিত হয় ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র। ভারত তার নিজস্ব মতাদর্শিক পথে অগ্রসর হলেও পাকিস্তান তা পারেনি। পাকিস্তানের নীতি, আদর্শ, সংগ্রাম স্বার্থান্বেষী সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের খপ্পরে বন্দি হয়ে পড়ে। গণতন্ত্র নির্বাসিত হয়। ভাষা ও সংস্কৃতি অবদমিত হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশে স্বার্থান্বেষী চক্র লুপ্ত বা দুর্বল হয়ে যায়নি। বরং স্বার্থান্বেষী চক্রের কারসাজিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা পথ হারায়। স্বাধীনতার পর দারিদ্র্য, বৈষম্য ও অর্থনৈতিক সুযোগের সীমাবদ্ধতা অব্যাহত থাকে। বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলেও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও নির্বাচনি সংকটের কারণে গণতন্ত্র পরিপূর্ণতা না পেয়ে একদলীয় স্বৈরতন্ত্রে পর্যবসিত হয়। ভিন্নমত, সংখ্যালঘু, নারী, শ্রমজীবী শ্রেণির অধিকার ও মর্যাদা অনেক ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত হতে থাকে। আঞ্চলিক আধিপত্যের কারণে ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশের গতি পরিপূর্ণ স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হতে পারেনি।
লরেন্স লিফশুল্ৎজ নামের একজন মার্কিন সাংবাদিক ও দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ স্পষ্ট ভাষায় প্রশ্ন উত্থাপন করে একটি আস্ত গবেষণা গ্রন্থ রচনা করেন, যার শিরোনাম ‘বাংলাদেশ : অসমাপ্ত বিপ্লব’ (Bangladesh: Unfinished Revolution)। এতে তিনি মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিপথ বিশ্লেষণ করেন। বিশেষ করে কর্তৃত্ববাদী শাসনের উত্থান, সামরিক অভ্যুত্থান এবং গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার ব্যর্থতা চিহ্নিত করেন তিনি। লিফশুল্ৎজ দেখিয়েছেন, স্বাধীনতার স্বপ্ন-গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও সমতা-রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার লড়াই, দুর্নীতি এবং আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের কারণে পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হয়নি।
পরবর্তীকালে নব্বইয়ের ছাত্র-জনতার আন্দোলনসহ একাধিক জনপ্রচেষ্টা পূর্ণ সফলতা পায়নি। আর এজন্য সংশ্লিষ্টদের ব্যর্থতার পাশাপাশি স্বার্থান্বেষী চক্রের বিরাট ভূমিকা ছিল। এ চক্র জনতার স্বপ্নকে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর কব্জায় অবরুদ্ধ করে। এতে কারও কারও ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত বা দলীয় কিছু লাভ হলেও সামগ্রিকভাবে জাতির অপরিসীম ক্ষতি হয়েছে। জুলাই বিপ্লবের পরও এমন সংকুল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। অভ্যুত্থানের চেতনা বারবার লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছে। টিআইবির পক্ষ থেকে এমনও বলা হয়েছে যে, গণ-অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক দল ও আমলাতন্ত্র বৈষম্যবিরোধী চেতনা বাস্তবায়নে সফল হয়েছে-এমন উদাহরণ খুবই বিরল।