
ডাকসু-২০২৫: জিতল যারা, কেন জিতল?
বহুবছর পর দেশের মানুষ একটি অসাধারণ নির্বাচন এবং অবাক করা ফলাফল দেখল। বহু আকাঙ্ক্ষিত জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী শিক্ষার্থীদের প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই নির্বাচন ভাদ্রমাসের চরম গরমের মধ্যেও প্রায় ৮০ শতাংশ ভোট প্রদান একদিক থেকে শুধু অভূতপূর্বই নয়, আশাজাগানিয়াও বটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশবাসী, সংবাদমাধ্যম এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ছিল নজরকাড়া।
যদিও ভোটগ্রহণের সময় যত এগিয়েছে, উত্তাপ ততই বেড়েছে। ফলাফল ঘোষণার মধ্যেই জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ভিপি পদপ্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী উমামা ফাতেমা এই নির্বাচনের ফলাফলকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও প্রশাসনকে জামায়াত ঘনিষ্ঠ বলে প্রকাশ্যে অভিযুক্ত করা হয়েছে। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণাকালীনই এই নির্বাচনের অন্যতম অংশীজন, দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কিছু সদস্য এই নির্বাচনের ফলাফলে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অভিযোগ এনেছেন।
উল্লেখ্য, ভোটের আগের দিন পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের এবং তাদের পৃষ্ঠপোষক রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণ ছিল সৌহার্দ্যপূর্ণ এবং সৌজন্যপ্রবণ-পরিশীলিত। এই নির্বাচনে অংশ নেওয়া বড় পদের প্রধানতম প্রার্থীরা প্রায় সবাই জুলাইয়ের ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানের অংশীজন। এই নির্বাচনের প্রধানতম অঙ্গীকার ছিল, লেজুড়বৃত্তি রাজনীতির নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণরুম সংস্কৃতি আর গেস্টরুম নির্যাতনের ফ্যাসিবাদী কালচার আর ফিরবে না—এই প্রত্যয়ে ভরা। অতীতে ছাত্ররাজনীতির পাণ্ডারা বছরের পর বছর যে হুলিগান সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে, জুলাই পরবর্তী রাজনীতি তা প্রত্যাখ্যান করেছে; এই অভিপ্রায়ই ছিল এই নির্বাচনের প্রতীতি। কিন্তু ফলাফল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলো ভোটপ্রাপ্তির সংখ্যা অনেককেই হতাশ ও বিক্ষুব্ধ করেছে। এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে শিবিরের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট বলে অভিযোগ আনতে দেখা গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ বা ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক না কেন, মনে রাখা দরকার এই নির্বাচনের ভোটার, শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ ২০১৮ সালের 'নিরাপদ সড়ক চাই' আন্দোলন, কোভিড মহামারীর দুঃসহ দিন, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের রক্তমাখা স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা নিয়ে এই নির্বাচনের মুখোমুখি হয়েছেন। ফলে রাজনীতির অতীত দিনের যে কোন পরিস্থিতি মোকাবিলার মত সামর্থ্য, স্থিতি ও মানসিক শক্তি এই জেন-জি জেনারেশন অর্জন করেছেন। তাই তাদের স্বাতন্ত্র্য, শক্তিমত্তা ও দেশভাবনাকে গুরুত্বসহ বিবেচনা ও বিশ্লেষণ করাও রাজনীতির একটি বড় কাজ।
ডাকসু নির্বাচনের সর্বশেষ ফলাফল অনুযায়ী, ইসলামী ছাত্র শিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের সাদিক কায়েম-এস এম ফরহাদ-মহিউদ্দিন খান প্যানেল বিজয়ী হয়ে গেছে বলা চলে। তাদের প্রধানতম প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের মো. আবিদুল ইসলাম খান-শেখ তানভীর বারী হামিম-তানভীর আল হাদী মায়েদ প্যানেল। অন্যদিকে স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেলের ভিপি পদপ্রার্থী উমামা ফাতেমা এবং বামপন্থিদের ছাত্রদের জোট প্রতিরোধ পর্ষদের জিএস পদপ্রার্থী মেঘমল্লার বসু, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের জিএস প্রার্থী আবু বাকের মজুমদার ও স্বতন্ত্র ভিপি প্রার্থী শামীম হোসেনের প্রাপ্ত ভোট মন্দের ভালো বলা চলে।
ডাকসু নির্বাচনে সাত কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত ১৬ হলের ফলাফলে বিপুল ভোটে এগিয়ে রয়েছেন ছাত্রশিবিরের ভিপি ও জিএস প্রার্থী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাকি দুটি হলের ফলাফলে যে খুব একটা তারতম্য ঘটবে না এখনই বলে দেওয়া যায়। ১৬ টি হলের মধ্যে শিবিরের ভিপি প্রার্থী সাদিক কায়েম পেয়েছেন মোট ১২,৯৩৫ ভোট, আর ছাত্রদলের আবিদুল ইসলাম খান পেয়েছেন ৫,২২১ ভোট। এছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী উমামা ফাতেমার প্রাপ্ত ভোট ২,৯৪০। জিএস পদে শিবিরের এসএম ফরহাদ পেয়েছেন ৯,৫৩৮ ভোট। আর ছাত্রদলের শেখ তানভীর হামিম পেয়েছেন ৪,৮৭৫ ভোট। এছাড়া বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের আবু বাকের মজুমদার ১,৬৫২ ভোট পেয়েছেন।
এখন দেখা দরকার এই ফলাফল কেন হলো? এই ফলাফল নিয়ে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলসহ অনেকেরই উষ্মা দেখা যাচ্ছে। অনেকেই এই ফলাফলকে প্রশাসনের পক্ষপাতদুষ্টতাও বলে ভাবেন। কিন্তু সেটাই কি এই ফলাফলের মোদ্দা কারণ। নাকি ডাকসুতে ইসলামী ছাত্রশিবিরের এই বিজয়ের পেছনে আছে আরও অনেক কারণ। সেগুলো দেখা যেতে পারে:
০১) ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানের অংশীজন সবাই আলাদা আলাদাভাবে অংশ নিয়েছে। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদসহ বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্রসংগঠন যেমন অংশ নিয়েছেন, তেমনই স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও অংশ নিয়েছেন। সমমনা দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে ভোটের বিভাজন বরাবরই দলীয় প্রার্থীদের বিশেষ সুবিধা দেয়। এবারেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। ইসলামী ছাত্রশিবির সে সুযোগকে কাজে লাগিয়েছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- ডাকসু নির্বাচন