
বাংলাদেশ–নেপাল: গণঅভ্যুত্থানের সাদৃশ্য ও সতর্কবার্তা
ঢাকা থেকে কাঠমান্ডু সোজাসুজি আকাশপথে গেলে মাত্র ৬৭৫ কিলোমিটার দূরে। সড়কপথেও দূরত্ব খুব বেশি নয়। বাংলাদেশ থেকে স্থলপথে নেপাল যেতে মাঝখানে ভারতের ওপর দিয়ে কিছুটা পথ যেতে হয়। তবে পথটা খুব দূরের নয়। ঢাকা থেকে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর দূরত্ব হাজারখানেক কিলোমিটারেরও কম।
দেশ দুটির দূরত্ব সম্পর্কিত এই সব তথ্য প্রায় সবারই জানা আছে। ভৌগোলিক দূরত্ব খুব বেশি না হলেও ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈসাদৃশ্য যথেষ্টই আছে। কিন্তু হঠাৎ করে সমপাতন ঘটল দুই দেশের মধ্যে। এই সমপাতনের ঘটার মাঝে এক বছর এক মাসের মতো একটা ব্যবধান রয়েছে। বাংলাদেশের এই বছরের অভিজ্ঞতা নেপালের জন্য হতে পারে সতর্কবার্তা। কেননা, এরই মধ্যে বাংলাদেশ বুঝতে শুরু করেছে, গণঅভ্যুত্থানের বিজয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করে দিতে পারে, অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকারের দুর্বলতা, মব ভায়োলেন্সের ব্যাপক বিস্তার।
বছরখানেক আগে, ২০২৪ সালের জুলাই-অগাস্টে বাংলাদেশে এক ব্যাপক গণঅভ্যুত্থানের জন্ম দেয়। বাংলাদেশের অভ্যুত্থান শুরু হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে ছাত্রদের বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে। সাদামাটা দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন দমনে শেখ হাসিনার কঠোরতা এটিকে সর্বব্যাপী এক অভ্যুত্থানে রূপান্তরিত করে। আসলে ছোট্ট দাবিটি শেষপর্যন্ত সরকার উচ্ছেদের আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল দেড় দশক ধরে সরকারের গভীর দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন, নির্বাচনি ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে গণতান্ত্রিক স্থান সংকুচিত করা এবং মারাত্মক অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার কারণে। ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পদ্ধতিগতভাবে ভেঙে দিয়ে তরুণদের কাছে একনায়কের প্রতিভূতে পরিণত হয়েছিলেন। অবশেষে ২০২৪ সালের জুলাই-অগাস্টে অন্তত হাজার খানেক মানুষ নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করে দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেন।
নেপালে অবশ্য বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম রক্তপাতের মধ্য দিয়েই সরকারের পতন ঘটেছে। তবে সেখানেও আন্দোলনের জন্ম হয়েছে সাধারণ ঘটনাকে কেন্দ্র করে। একই সময়ে ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করা নিয়ে তরুণরা আন্দোলনের সূত্রপাত করে। বাংলাদেশের মতো নেপালের আন্দোলনটি মূলত ছাত্র-যুব নেতৃত্বাধীন, যা ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রূপান্তরিত হতে বেশি সময় নেয়নি। আন্দোলন এমন ব্যাপকতা পাওয়ার কারণ কিন্তু শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করা নয়, সরকারের প্রতি জনগণের দীর্ঘদিনের অসন্তোষের প্রকাশ।
বাংলাদেশের মতো নেপালের সংবিধানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার স্বীকৃতি রয়েছে। তবে সংবিধানের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসংক্রান্ত ওই অনুচ্ছেদেই, বাংলাদেশের মতো সরকারকে সামাজিক শান্তির প্রয়োজনে মতামতের প্রকাশকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা দেওয়া আছে। সংবিধান প্রদত্ত ওই ক্ষমতাবলে সরকার গোয়েন্দা বিভাগকে টেলিফোনে আড়ি পাতার অধিকার দিয়ে একটা আইন তৈরির কাজ শুরু করেছিল সম্প্রতি। সেটা কাঠমান্ডুর মতো শহরের মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজকে অসন্তুষ্ট করে। ফলে ছাত্র-তরুণদের আন্দোলন দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় নেয়নি।
নেপালে এই সেপ্টেম্বরের অভ্যুত্থানকে কয়েক দশকের মধ্যে দেশটির সবচেয়ে ভয়াবহ অস্থিরতা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। ফেইসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ ও এক্সসহ প্রধান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা একটি চরম ধাক্কা দিয়েছিল, কেননা, এটি করা হয়েছে এমন একটি দেশে যেখানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম জনসংখ্যার ৪৮ শতাংশেরও বেশি মানুষের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগের উপায়, বিশেষ করে প্রবাসী শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য, যাদের পাঠানো রেমিটেন্স অর্থনীতির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। নেপালের অ্যাক্টিভিস্টরা তাৎক্ষণিকভাবে এই পদক্ষেপকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আঘাত এবং একটি স্বৈরাচারী মনোভাব হিসেবে দেখতে শুরু করেন।
তবে, এই নিষেধাজ্ঞা বছরের পর বছর ধরে জমে থাকা গভীর ক্ষোভের সলতেটিতে দিয়াশলাইয়ের জ্বলন্ত কাঠি ছুঁয়ে দেওয়ার মতো অবস্থা করেছে। এর মূলে রয়েছে দুর্নীতি এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য নিয়ে জনমনে জমা হওয়া তীব্র হতাশা।
- ট্যাগ:
- মতামত
- সরকার পতন
- গণঅভ্যুত্থান