
ছেলের স্যান্ডেল বুকে চেপে মা বললেন, পানি খাইতে চাইসিল আমার ছেলেটা, ওরা দিল না
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির কাঞ্চন নগর ইউনিয়নের মধ্যম কাঞ্চন নগর গ্রামের তালুকদার বাড়ির কাছে একটি চায়ের দোকানের সামনে ভিড়। দোকানি মুহাম্মদ লোকমান আর তাঁর স্ত্রী খাদিজা আকতারকে ঘিরে আছেন উপস্থিত লোকজন। কাছে যেতেই শোনা গেল খাদিজার বিলাপের শব্দ। এক জোড়া স্যান্ডেল বুকে চেপে ধরে বলছিলেন, ‘আমার বুকের ধন, ছেলেটা শেষ মুহূর্তে একটু পানি চাইসিল। তা–ও দিতে দেয় নাই তারা। আমর সামনে পিটাই পিটাই ছেলেরে মারসে।’
‘চোর’ অপবাদ দিয়ে খাদিজা আকতারের ‘বুকের মানিক’ একমাত্র ছেলে মুহাম্মদ রিহানকে (১৫) গত শুক্রবার ভোরে তাঁর চোখের সামনেই পিটিয়ে মারা হয়। গ্রামেরই চেইঙ্গা সেতু এলাকায় আরও দুই কিশোরের সঙ্গে মব তৈরি করে তাদের পেটানো হয়। নিহত রিহান সপ্তম শ্রেণির ছাত্র ছিল। এ ঘটনায় আহত মুহাম্মদ রাহাত (১৫) ও মুহাম্মদ মানিক (১৪) প্রাণে বেঁচে গেলেও এখনো শঙ্কা কাটেনি। গুরুতর আহত দুই কিশোর এখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
রিহানের বাবা মুহাম্মদ লোকমান স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের ক্যানটিন চালান। বাড়তি রোজগারের জন্য ছয় মাসে আগে বাড়ির পাশে চায়ের দোকান দেন। স্কুল ছুটি শেষে সেখানে সময় দিত রিহান, বেচাবিক্রিতে সহযোগিতা করত বাবাকে। সেই দোকানের সামনেই গতকাল শনিবার দুপুরে তাঁর মা–বাবাকে পাওয়া গেল। শোকে মুহ্যমান এই দম্পতির আহাজারি থামছিল না কোনোভাবেই।
খাদিজা আকতারের দুঃখ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে ছেলের আনা এক জোড়া চুড়ি। গত মঙ্গলবার রাতে বাজার থেকে মায়ের জন্য হাতের চুড়ি কিনে এনেছিল রিহান। খুশিতে চোখ ভিজে গিয়েছিল মায়ের। কে জানত, সেই চুড়িই হবে তাঁর সন্তানের শেষ উপহার? পরদিন বুধবার সকালে মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আরও দুই বন্ধু স্কুলছাত্র মুহাম্মদ রাহাত, মাদ্রাসার শিক্ষার্থী মুহাম্মদ মানিকসহ বেড়াতে গিয়েছিল কক্সবাজারে। দুই দিন সমুদ্রসৈকতে আনন্দ করে বৃহস্পতিবার রাতে বাড়িতে ফিরে আসছিল তারা তিন সমবয়সী বন্ধু। তাদের কল্পনাতেই আসেনি, এই ফেরাটা হবে মৃত্যুর দিকে যাত্রা।
শুক্রবার ভোর ৪টায় একটি অটোরিকশা নিয়ে বাড়ির সামনে রিহানের বাবার চা–দোকানের পাশে নামে তিন কিশোর। এ সময় হঠাৎ চোর চোর বলে তাদের ধাওয়া করেন লাঠিসোঁটা হাতে থাকা সাত থেকে আটজন। তাঁদের পিটুনি থেকে বাঁচতে রিহানরা দৌড়ে আশ্রয় নেয় নিজের বাড়ি থেকে ২০০ গজ দূরের নির্মাণাধীন একটি দোতলা বাড়ির ছাদে।
পরে সেখান থেকে তাদের ধরে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে নিয়ে নেওয়া হয় একটি সেতুর ওপর। সেখানে তিনজনকে বেঁধে লাঠিসোঁটা ও দেশীয় অস্ত্র দিয়ে পেটানো হয় তিনজনকে। মারধরে মৃত্যু হয় রিহানের। শুক্রবার সন্ধ্যায় রিহানকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
রিহানের বাবা মুহাম্মদ লোকমান বলেন, ‘আসামিরা এখন বাঁচতে আমাদের টাকার অফার করছেন মামলা না করতে। ১০ লাখ লাগলে দেবে বলছে। কিন্তু আমি ছেলে বিক্রি করব না।’
কেন রিহানদের এভাবে পেটানো হলো, কেবলই চোর সন্দেহে? এলাকার কিছু লোক বলেন, ভিন্ন পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে তাদের বন্ধুত্ব ছিল বলেই কিশোরদের পেটানো হয়। খাদিজা আকতারও বিলাপের সুরে সে কথা বলছিলেন। তিনি বলেন, ‘শুধু অন্য গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব কেন করছে, সেই জন্য মারছে তাদের। শুধু সেই কারণে। আমি এখন কিছু চাই না। শুধু আসামিদের ফাঁসি চাই।’
- ট্যাগ:
- বাংলাদেশ
- পিটিয়ে হত্যা
- মব জাস্টিস