পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ : বয়ানে বিবর্তন

যুগান্তর ড. হাসান মাহমুদ প্রকাশিত: ১৭ আগস্ট ২০২৫, ১৩:৩২

বর্তমানে মূলধারা বাংলাদেশে ‘পাকিস্তান’ শব্দটা জাতীয় শত্রু হিসাবে পরিচিত হলেও এ শব্দের অর্থ ইতিহাসের ভিন্ন ভিন্ন সময়ে অন্যরকম ছিল। ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা আদায়ের প্রেক্ষাপটে ১৯৪০-৪৭ সালে পাকিস্তান ছিল বাঙালি মুসলমানের জন্য মুক্তি, আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণের এক প্রতিশ্রুতিময় ধারণা। কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এসে সেই একই শব্দ হয়ে ওঠে দমন, বৈষম্য এবং সাংস্কৃতিক নিপীড়নের প্রতীক। মাত্র ২৪ বছরের মধ্যেই পাকিস্তান শব্দের অর্থের পালাবদল আমাদের জাতীয় ইতিহাসের ধারাবাহিকতা ও বিচ্ছিন্নতার এক অনন্য উদাহরণ।


১৯৪০-৪৭ : বাঙালি কল্পনায় পাকিস্তান


সাধারণভাবে একাডেমিয়াতে পাকিস্তানের ইতিহাসের আলাপগুলো প্রধানত স্থান হিসাবে পাঞ্জাব এবং নেতৃত্বের ভূমিকায় জিন্নাহর মতো নেতাদের ওপর আলোকপাত করে। আর তা একইসঙ্গে এরই মধ্যে বাংলার স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অবদানকে উপেক্ষা করে। আবার বাংলাদেশে পাকিস্তান সম্পর্কিত ইতিহাসের আলাপগুলোতে মনোযোগের কেন্দ্রে থাকেন ফজলুল হক বা সোহরাওয়ার্দীর মতো ব্যক্তিত্বরা, আর অবহেলিত থেকে যান বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত লেখকরা, যেমন-আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, ফররুখ আহমদ, গোলাম মোস্তফা প্রমুখ। ঐতিহাসিক নীলেশ বোস নানা ঐতিহাসিক তথ্যপ্রমাণাদি বিশ্লেষণ করে দেখান যে, বাঙালি মুসলমানের এসব চিন্তক পাকিস্তানের ধারণাকে বাঙালি সাহিত্যিক ঐতিহ্য, ভূগোল এবং রাজনৈতিক অর্থনীতির সঙ্গে মিশিয়ে ‘পাক-বাংলা’ নাম দিয়ে নিজেদের জন্য একটা সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের স্বপ্ন নির্মাণ করেছিলেন। আবুল মনসুর আহমদের রচিত ‘পাক-বাংলার সংস্কৃতি’ বইতে এ চিন্তার পূর্ণ বিকাশ দেখা গেছে।


তারা পাকিস্তানকে শুধু ধর্মীয় ভিত্তিতে গঠিত একটি রাষ্ট্র হিসাবে ভাবেননি। তাদের কল্পনায় ছিল এমন এক ‘পূর্ব পাকিস্তান’, যেখানে বাংলা ভাষা, বাঙালি মুসলমানের লোকসংস্কৃতি, পুথি সাহিত্য, গ্রামীণ গান ও মুসলিম শব্দভান্ডারের মর্যাদা থাকবে। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল হিন্দু ভদ্রলোক-আধিপত্য থেকে বেরিয়ে এসে বাঙালি মুসলিমের নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয়কে বিকশিত করা। তাদের কাছে পাকিস্তান ছিল বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতির এক নবজাগরণ। তাদের এ সাংস্কৃতিক স্বায়ত্তশাসনের স্বপ্নের কেন্দ্রে ছিল, একইসঙ্গে হিন্দু ভদ্রলোক শ্রেণি এবং এবং অ-বাঙালি মুসলিম শ্রেণির প্রভাব থেকে মুক্তির বাসনা।


পূর্ব বাংলার সেসব চিন্তক বাঙালি মুসলমানের যে পাকিস্তান ভাবনা তৈরি করেন, তা ছিল সংখ্যালঘুর আত্মনিয়ন্ত্রণের রাজনৈতিক দর্শনে প্রভাবিত। কেন্দ্রীয় (দিল্লিকেন্দ্রিক) শাসনব্যবস্থার বিপরীতে প্রতিটি জাতির আলাদা মর্যাদা ও স্বায়ত্তশাসন ছিল এর প্রধান লক্ষ্য। পাকিস্তানকে দেখা হয়েছিল ফেডারেল কাঠামোয় সংখ্যালঘু সুরক্ষা ও স্থানীয় ক্ষমতায়নের পথ হিসাবে। পূর্ব বাংলার কৃষি, নদীনির্ভর জীবন এবং বন্দরকেন্দ্রিক বাণিজ্যকে পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে উন্নত করার স্বপ্ন ছিল। শিল্পোন্নয়ন, কৃষির আধুনিকায়ন ও স্বনির্ভরতা অর্জন করা ছিল এ কল্পনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ।


বাঙালি মুসলমানের এ পাকিস্তানপন্থাকে কবি ও লেখকরা বাংলা সাহিত্য ও কবিতায় তুলে ধরেন। নদী, নৌকা, ভাটিয়ালি গানের সুর এসবের সঙ্গে যুক্ত হয় ইসলামি প্রতীক, যেমন সুজলা-সুফলা, সবুজ গ্রামবাংলার নদী-খালে-বিলে ভেসে চলা পাল তোলা নৌকা বা সকাল-সন্ধ্যায় ভেসে আসা আজানের ধ্বনি। পাকিস্তান হয়ে ওঠে মুক্তি, ন্যায়বিচার ও ভ্রাতৃত্বের প্রতীক, যেখানে ইসলামি নৈতিকতা ও বাঙালি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মিলন ঘটে।


একাত্তরের পর : চেতনার বয়ানে পাকিস্তান


১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর ‘পাকিস্তান’ শব্দটি বাংলাদেশের জনমনে দমনমূলক সামরিক শাসনের প্রতীক হয়ে ওঠে। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় না বসিয়ে সশস্ত্র দমন অভিযান চালায়। তাদের সমর্থন জোগায় পশ্চিম পাকিস্তানে নির্বাচিত আঞ্চলিক নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং সামন্ত ও উচ্চশ্রেণির মুসলমানদের অনেকে। বাঙালি মুসলমানের কাছে পাকিস্তান হয়ে দাঁড়ায় উর্দুভাষী, অবাঙালি প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রতীক। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বাঙালি সংস্কৃতি ও বাংলা ভাষাকে অস্বীকারকারী শক্তি হিসাবে পাকিস্তানবিরোধী সাংস্কৃতিক বয়ান গড়ে ওঠে।


এ বয়ানে পশ্চিম পাকিস্তান ছিল পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক শোষণের কেন্দ্র। পূর্ব বাংলার কৃষি ও শিল্প থেকে অর্জিত সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে ব্যয় হতো। প্রশাসনিক ক্ষমতা চলে যায় পশ্চিম পাকিস্তানের আমলা আর সামরিক নেতৃত্বের হাতে। এরই ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বয়ানে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের এ অসম সম্পর্ককে ‘অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদ’-এর উদাহরণ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। পাকিস্তান হয়ে ওঠে গণহত্যা, ধর্ষণ, শরণার্থী স্রোত এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতীক। একাত্তরের চেতনায় পাকিস্তান মানে স্বাধীনতা ও মর্যাদার সরাসরি বিপরীত শক্তি, তথা স্বাধীনতাবিরোধী।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও