৮ আগস্ট ২০২৪-এ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যখন দায়িত্বভার গ্রহণ করে, তখন দেশের মানুষ এক নতুন আশায় বুক বেঁধেছিল। দীর্ঘদিনের স্বৈরাচারী শাসন থেকে মুক্তিলাভের পর জনগণের মনে যে আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয়েছিল, তা ছিল এক ন্যায়ভিত্তিক, বৈষম্যহীন এবং সুস্থ প্রতিযোগিতার সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। এ চাওয়া ১৯৭১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত জাতীয় আকাঙ্ক্ষার ধারাবাহিক মূল সুরেরই প্রতিফলন। একটি সুষ্ঠু সমাজ, যেখানে অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও সামাজিক জীবনের সঠিক বিকাশ ঘটবে—এমনটাই ছিল মানুষের স্বাভাবিক চাওয়া। কিন্তু দেড় যুগের অত্যাচারী, কর্তৃত্ববাদী শাসন মানুষের এই চাওয়াকে রুদ্ধ করে রেখেছিল।
সরকার যখন ক্ষমতা গ্রহণ করে, তখন নানা ধরনের পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। একটি লাইনচ্যুত রাষ্ট্র, সমাজ ও অর্থনীতিকে সঠিক প্রক্রিয়ায় ফিরিয়ে আনার এই প্রত্যাশা ছিল প্রবল। দ্বিতীয়ত, একটি বৈরী ভূরাজনৈতিক পরিবেশ ছিল। তাই সরকারের সামনে ছিল নিজেদের সংহত রাখা এবং এই বৈরী পরিবেশ মোকাবিলা করার চ্যালেঞ্জ। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে ঐক্য ছিল বটে, কিন্তু তাদের বিভাজন ও ঐক্যের জায়গাগুলো ওই মুহূর্তে স্পষ্ট ছিল না। তরুণদের যারা এই পরিবর্তনে বড় ভূমিকা রেখেছিল, তাদেরও নতুন রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ছিল। সরকার তাদের এই আকাঙ্ক্ষাকে সমর্থন জানালেও বাস্তবায়ন কতটা হয়েছে, তা এক বছরের মাথায় দেখার বিষয়।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল বিপর্যস্ত। ব্যাংকিং খাত ছিল ধ্বংসপ্রায়, রিজার্ভ ছিল নিম্নমুখী এবং নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যানের অভাব ছিল। অর্থনৈতিক ঝুঁকি ছিল প্রবল। সরকার এই সমস্যা সমাধানে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয় এবং দ্রুত পদক্ষেপ নেয়। এ ক্ষেত্রে তারা অনেকটা সফল হয়েছে। ব্যাংকিং খাতের মাধ্যমে দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের পথগুলো অনেকাংশে রুদ্ধ করা গেছে। রিজার্ভ স্থিতিশীল হয়েছে এবং ডলারের মূল্য নিয়ন্ত্রণে এসেছে। জনগণের আস্থা ফিরে আসায় রেমিট্যান্সপ্রবাহও বেড়েছে। সামষ্টিক অর্থনীতির ঝুঁকি কমানোর এই সাফল্য নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তবে সামষ্টিক অর্থনীতির এই সাফল্যের বিপরীতে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক চাওয়া-পাওয়া কতটুকু পূরণ হয়েছে, তা দেখার বিষয়।
অন্যান্য ক্ষেত্রে সরকারের অগ্রগতি কেমন ছিল, তা বিশ্লেষণ করলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে আসে। এই এক বছরে সরকারের অন্যতম একটি কাজ ছিল লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা। জনগণের আকাঙ্ক্ষা ছিল ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, দৈনন্দিন জীবনে স্বস্তি, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং স্বৈরাচারের অনুষঙ্গগুলো থেকে মুক্তি। স্বৈরাচারী শাসনের অনুষঙ্গগুলোর মধ্যে ছিল হয়রানিমূলক মামলা, আইনশৃঙ্খলার অনুপস্থিতি ও পুলিশের নেতিবাচক ভাবমূর্তি। এই আকাঙ্ক্ষাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার কিছু দৃঢ় পদক্ষেপ নিলেও বাস্তবায়নের জায়গায় কৌশলগত অবস্থান ছিল ভুল। পরিবর্তনটি এসেছিল জনগণের সম্মিলিত অংশগ্রহণে, কিন্তু নির্মাণের কাজটিতে তারা জনগণের পরিবর্তে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপর অতিমাত্রায় নির্ভর হয়ে উঠল।
এই কৌশলগত ত্রুটির ফলে আমলাতান্ত্রিক শাসনকে অতিমাত্রায় ক্ষমতায়িত করা হয়েছে। সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা, কমিউনিটি পর্যায়ের অংশগ্রহণ এবং স্থানীয় সরকারের মতো বিষয়গুলোকে কৌশলগতভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। সরকার হয়তো এটিকে একটি সাময়িক দুর্যোগকালীন ব্যবস্থা হিসেবে দেখেছিল, কিন্তু এক বছর পর দেখা যাচ্ছে, আমলাতন্ত্র নিজেদের সুযোগ-সুবিধা আদায়ের দিকেই বেশি মনোযোগী হয়ে উঠেছে। এর ফলে জনগণের অংশগ্রহণের যে প্রত্যাশা ছিল, তা অনেকাংশে ব্যাহত হয়েছে।
সরকারের আরেকটি বড় উদ্যোগ ছিল রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর সংস্কার। কার্যকারিতার দৃষ্টিকোণ থেকে ধ্বংসপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোকে ঠিক করার জন্য তারা অনেকগুলো কমিশন গঠন করে। এসব কমিশন কিছু প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে, কিন্তু সার্বিকভাবে সংস্কার কার্যক্রমে আমলাতান্ত্রিক ও এলিট পর্যায়ের আলোচনার প্রাধান্য দেখা দিয়েছে। কমিশনগুলোর বেশির ভাগ সুপারিশ তারা আমলে নেয়নি। সংবিধান কমিশন এবং নির্বাচনসংক্রান্ত কিছু বিষয় ছাড়া পুলিশ, স্থানীয় সরকার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এমনকি প্রশাসনিক সংস্কারের কোনো সুপারিশই তারা গ্রহণ করেনি। এর কারণ সম্ভবত তারা সংস্কারের একটি সীমিত এজেন্ডার মধ্যেই নিজেদের শক্তি ব্যয় করতে চেয়েছিল। স্থানীয় সরকারের মতো যে প্রতিষ্ঠানের ওপর সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি নির্ভর করে, সেটির সংস্কার বা শক্তিশালীকরণের বিষয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি।