
এই সময়ের ছেলেমেয়েদের জন্য এই সময়ের মতো করে রবীন্দ্রনাথকে ছড়িয়ে দিতে হবে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৮৪তম প্রয়াণদিবস উপলক্ষে আজ একাধিক টেলিভিশন চ্যানেলে গাইবেন রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের চেয়ারম্যান অণিমা রায়। গতকাল তাঁর সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো।
আজ কী কী আয়োজনে গাইছেন?
অণিমা রায়: বাংলাভিশনে ‘তুমি রবে নীরবে’ শীর্ষক আয়োজনে চারটি গান গাইব। সঙ্গে ফেরদৌস বাপ্পী ভাইয়ের আবৃত্তি থাকবে। আয়োজনটি সঞ্চালনাও করেছেন তিনি। এতে আমার প্রতিষ্ঠান সুরবিহারেরও দুটি গান থাকবে। বাংলাদেশ টেলিভিশন, এটিএন বাংলা, চ্যানেল আই, একুশে টিভিতেও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আয়োজনে থাকব।
সুরবিহার কেমন চলছে?
অণিমা রায়: ভালোই চলছে। ছেলেমেয়েরা নিজেরাই গান করছে। বছরটা আমরা নানা রকমের ভাবনার মধ্য দিয়ে গেছি। কিন্তু সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, বিশেষত আমার থেমে থাকেনি, সুরবিহারও থেমে থাকেনি। বসন্ত উৎসব থেকে বর্ষা উৎসব—সব উৎসবেই গান করেছি। সুরবিহার সব সময়ই সরব ছিল। এখনো ঠিক তা–ই।
এই সময়ের তরুণ শ্রোতাদের কাছে রবীন্দ্রনাথের গান কতটা ছড়াচ্ছে?
অণিমা রায়: এই প্রজন্ম রবীন্দ্রনাথের গান ভালোবাসে। আমাদের অনেকের পারিবারিক বলয়ে রবীন্দ্রনাথ বিরাজ করেন। ফলে রবীন্দ্রসংগীত করছেন, এমন শিল্পীর তালিকা কম নয়, অনেক। বাংলাদেশে রবীন্দ্রসংগীতের সাধনা ব্যাপক হারে হয়। আর কমন জেনারেশনের কথা যদি বলি, এখন এত অনেক রকমের বৈষয়িক প্রলোভন, সেখানে রবীন্দ্রনাথের গান অনেক স্থির, অনেক মনোযোগ দিতে হয়। সময় নিয়ে ধ্যানস্থ হওয়ার ব্যাপার রয়েছে। ধ্যানস্থ হওয়ার সুযোগটা আমরা ছেলেমেয়েদের কোথায় দিচ্ছি? একটা ভারী ব্যাগ চাপিয়ে দিয়ে বলছি, দৌড়াও। আমরা কতটা নাম–যশ হবে, কতটা অর্থবিত্তের মালিক হব, সেটা চিন্তা করি। কিন্তু সন্তানদের মানবিক ও দেশপ্রেমী হিসেবে গড়ে তুলতে হলে অবশ্যই আমাদের সন্তানদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও লালনের পরিচয় করিয়ে দিতেই হবে। অন্যথায় আমরা ব্যর্থ হবই। মানবিক মূল্যবোধ সুগঠিত হওয়ার জন্য আমাদের প্রজন্মের রবীন্দ্রচর্চার অনেক বেশি প্রয়োজন। পাঠ্যপুস্তকেও রবীন্দ্রনাথকে অবশ্যই বাধ্যতামূলকভাবে রাখা জরুরি।
আমি এই সরকারের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাব। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুলে চিঠি পাঠিয়েছে সরকার, যেন রবীন্দ্রজয়ন্তী ও নজরুলজয়ন্তী পালন করা হয়। আমরা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে অনুষ্ঠানও করে এসেছি। সরকারিভাবে উদ্যোগটি গ্রহণ করার জন্য সাধুবাদ জানাই। তারা তাদের মতো করে চেষ্টা করছে, সামগ্রিকভাবে নাগরিকদের আরও বেশি সচেতনভাবে রবীন্দ্র, নজরুল বা লালনকে আঁকড়ে ধরে রাখতে হবে।
আপনি তো সংগীতের শিক্ষক। রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে তরুণদের মধ্যে কেমন আগ্রহ দেখেন?
অণিমা রায়: তরুণেরা রবীন্দ্রনাথকে ভালোবেসেই পড়তে আসে। সুরবিহারে রবীন্দ্রনাথকে ভালোবেসেই গান শিখতে আসে। সাধারণ মানুষের মধ্যেও আগ্রহ রয়েছে। যেহেতু স্বরলিপি মেনে গাইতে হয়, সাধনারও ব্যাপাার। সেসব চিন্তা করতে গেলে ওরা হয়তো খানিকটা দমে যায়। এত সময় আসলে ওদের কোথায় দিই? ওদের তো অনেক ধরনের দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়। ওরা যখন ফিউশন করে, তখন একটা সমালোচনার সৃষ্টি হয়। হওয়াটাই প্রাসঙ্গিক। সে ক্ষেত্রেও দমে যায়। শিক্ষকের কাছে গানগুলো যদি দেখিয়ে নিয়ে আসি, তাহলে সেটা সহজ হবে। যেমন অর্ণব তরুণদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের গানকে পৌঁছে দিচ্ছে। আমিও এই প্রজন্মের জন্য গানটা করার চেষ্টা করি। বর্তমান প্রজন্ম ছাড়া ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দাঁড়াবে কিসের ওপর। এই সময়ের ছেলেমেয়েদের জন্য এই সময়ের মতো করে রবীন্দ্রনাথের শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে।
এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা অনেক সুর শুনে অভ্যস্ত, যদি ৫০ বছর আগের সুরে গান করি, তাহলে সেটা হয়তো তাদের মনে রেখাপাত করবে না। যদি সুরে পরিমিতবোধের সঙ্গে একটু আধুনিকায়ন করা হয়, হৃদয় দিয়ে স্বরলিপির মধ্য থেকে যদি উপস্থাপন করা হয়, তাহলে যে প্রজন্মই সে হোক না কেন, নেবেই। রবীন্দ্রনাথের প্রতিটি গানে গল্প রয়েছে, চরিত্র রয়েছে। সেই চরিত্রগুলো বিভিন্ন সুরের মধ্য দিয়ে কথা বলে। রবীন্দ্রনাথের গানে ওয়েস্টার্ন সুর রয়েছে, লোক সুর রয়েছে। শাস্ত্রীয় সংগীতেরও মেলবন্ধন রয়েছে। যে কারণে এতগুলো বছর পরও রবীন্দ্রনাথ এতটা প্রাসঙ্গিক। রবীন্দ্রনাথের গান আমরা এখনো শুনি। এই প্রজন্ম যদি ররীন্দ্রনাথকে না গায়, না শোনে, এই দৈন্য আমাদের।