পৃথিবীর সব সরকারের ভেতরে সরকার থাকে
অধ্যাপক আসিফ নজরুল অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা। এক বছরে সরকারের সাফল্য–ব্যর্থতা, জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার, ঢালাও মামলা, গ্রেপ্তার, মব–সন্ত্রাস, রাজনৈতিক দলের প্রতি পক্ষপাতের অভিযোগ, সমাজে বৈষম্য, সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন কমিশন, নির্বাচন, আওয়ামী লীগের কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। আপনি কি আগেই বুঝতে পেরেছিলেন, সরকারের পতন আসন্ন?
আসিফ নজরুল: ধারণা করতে পেরেছিলাম। মিছিলে, সমাবেশে এমন পরিচিত মানুষদের দেখতে পারছিলাম, যাঁরা আগে কখনো আসেননি। তারপর শত নির্যাতনের পরও ছাত্রনেতাদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সংকল্প, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় মানুষের ঢল, দ্রোহযাত্রা, সেনাসদরে সেনাপ্রধানের বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছিল, শেখ হাসিনা এবার আর টিকতে পারবেন না। ৩ আগস্ট শহীদ মিনারে ছাত্র–জনতার বিশাল সমাবেশে বলেছিলাম, জয় তোমাদের সুনিশ্চিত।
সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে কি আপনার সঙ্গে ৫ আগস্টের আগেই যোগাযোগ করা হয়েছিল? তারা কী বলেছিল?
আসিফ নজরুল: জুলাইয়ের একদম শেষ দিকে রাতের বেলায় সেনাবাহিনীর পরিচয় দিয়ে সিভিল ড্রেসে একজন এসেছিলেন আমাদের পাড়ায়।
আমাকে খুব সাবধানে থাকতে এবং রাতে বাসায় না ঘুমাতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি আদৌ সেনাবাহিনীর কি না, তা নিয়ে তখন সংশয় ছিল। ভয়ে অবশ্য তাঁর পরিচয় ভেরিফাই করার চেষ্টা করিনি। এরপর ৫ আগস্ট দুপুর ১২টার দিকে সেনাবাহিনীর একজন ব্রিগেডিয়ার ফোন করে তাঁর পরিচয় জানিয়ে আমাকে ক্যান্টনমেন্টে আসার আমন্ত্রণ জানান। আমি রিজওয়ানা হাসান আর মির্জা ফখরুল ভাইয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। আমার স্ত্রী খুবই ভয় পেয়েছিল। সে দোয়া পড়ছিল, সেনাবাহিনী যে গাড়ি পাঠিয়েছিল, সে সেটার ছবি তুলে রেখেছিল। তারা তাকে বারবার অভয় দিচ্ছিল। এরপর ৫ তারিখ সারা দিন যে অভিজ্ঞতা হলো, তা অকল্পনীয় ও অবিশ্বাস্য।
অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাস পূর্তিতে আমি আপনার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তখন বলেছিলেন, মানুষের নিয়ত যদি সৎ হয়, দেশপ্রেম ও ইচ্ছাশক্তি থাকে, তাহলে যেকোনো কাজ করা সম্ভব। এখন এক বছর পূর্তিতে আমি জানতে চাই, সরকার আসলে কী করতে পারল, আপনার মন্ত্রণালয় কী করতে পারল?
আসিফ নজরুল: আপনাকে যেটা বলেছিলাম, তা অনেকাংশে সত্যি। যেকোনো কাজ করা সম্ভব না হলেও অনেক কিছু করা যায়। আমার মন্ত্রণালয় কী করেছে, তার একটা হিসাব দিয়েছি ৩১ জুলাই। আমরা ১৬-১৭টি আইন (নতুন ও সংশোধন) করেছি। দেওয়ানি ও ফৌজদারি দণ্ডবিধিতে যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন করা, লিগ্যাল এইড সার্ভিসকে সম্প্রসারিত করা, অনলাইন বেল (জামিন) বন্ড দেওয়ার আইন করা, ডিজিটালাইজেশনের পদক্ষেপ—এমন অনেক কিছু আছে। কিছু কাজ আমরা করেছি, যেটা আগের কোনো সরকারের আইন মন্ত্রণালয়কে করতে হয়নি। আমরা ১৬ হাজারের বেশি হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছি। এটা শুধু বৈঠক করে হয় না, মামলার নথি ধরে ধরে পর্যালোচনা করতে হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ রকম নেই যে একটা মন্ত্রণালয় এক বছরে প্রায় পাঁচ হাজার সরকারি আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছে, সেটি করেছি।
আমি মনে করি, সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য অর্থনৈতিক খাতের শৃঙ্খলা আনা। আমরা শেখ হাসিনার আমলে শুনতাম, তিনি নিজেও বলেছিলেন, দেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে। অর্থনীতিতে ধস নামার লক্ষণ ছিল। সেটা ঠেকানো গেছে। আমি সব সময় শুনতাম যে এ রকম একটা পরিস্থিতিতে বিনিময় হার (ডলারের দাম) অত্যন্ত বেড়ে যায়। সেটা বাড়েনি, বরং এখন কমতির দিকে। আমাদের রিজার্ভ (বৈদেশিক মুদ্রার মজুত) বেড়েছে, ব্যবস্থাপনা ভালো হয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে, ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা আসছে, মানুষের আস্থা ফিরছে। রোজার মাসে দ্রব্যমূল্য কিছু কিছু কম রাখা গেছে। হজ ব্যবস্থাপনার উন্নতি হয়েছে। অপচয় কমানো গেছে। ফাওজুল কবির ভাইয়ের (বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান) হাতে যেসব মন্ত্রণালয় আছে, সেখান থেকে তিনি ৪৫ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করেছেন। এটা অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কাটছাঁট ও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দিয়ে করা হয়েছে।
বিপ্লব-উত্তর পরিস্থিতিতে যে বিশৃঙ্খল একটা অবস্থা থাকে, সেটা যদি না থাকত, আরও বেশি কিছু করা যেত।
জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। বিচার কতটা এগোল?
আসিফ নজরুল: দুই জায়গায় বিচার হচ্ছে। একটা হলো সাধারণ আদালতে। অন্যটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। আমি মনে করি, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা যথেষ্ট ভালোভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের তদন্ত ও প্রসিকিউশন দলের কাছে প্রথম থেকে প্রত্যাশা ছিল, মামলা যেন যেনতেনভাবে পরিচালিত না করা হয়। শক্ত প্রমাণ যাতে থাকে এবং তা নিয়ে প্রশ্ন না ওঠে। আপিলের আদালতে রায় যেন টিকে থাকে। শেখ হাসিনার আমলে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যে বিচার হয়েছিল, সেখানে টেলিফোনে-স্কাইপে রায় লিখে নিয়ে আসত। এখানে এ রকম কিছু হবে না। আমরা গত নভেম্বরে কাজ শুরু করেছি। আট মাসের মাথায় মামলার বিচার শুনানি পর্যায়ে চলে গেছে। আমি মনে করি, এটা যথেষ্ট অগ্রগতি।
আমি জানি, আপনি প্রশ্ন করবেন যে আমি বলছি বিচার এত দিনে হয়ে যাবে। দেখেন, এ বিষয়ে আমি আমার ধারণা ও প্রত্যাশার ভিত্তিতে কথা বলি। যখন শহীদ পরিবারগুলো কাঁদতে থাকে, তখন খুব ইচ্ছা করে যে আমি নিজের ধারণার কথা বলি। প্রসিকিউশন টিমের সঙ্গে আমি যোগাযোগ রাখি। আমি জানি, মামলা কোন জায়গায় রয়েছে। সেটার ভিত্তিতে অ্যানালাইজ করে (বিশ্লেষণ) বলেছি। প্রথমবার বিচারে যথেষ্ট অগ্রগতি ছাড়াই বলেছি, অক্টোবরের মধ্যে হয়তো রায় হবে। এখন বিচারের গতি দেখে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি, অক্টোবরে না হলেও ডিসেম্বর-জানুয়ারির মধ্যে হবে। আমি যখন অক্টোবরের মধ্যে বলেছিলাম, তখন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিচারপতিরা আমাকে সতর্ক করেছিলেন। এটাই তো প্রমাণ যে আমাদের আদালত কতটা নিরপেক্ষ।
সরকারের ভেতরে কি কোনো সরকার আছে?
আসিফ নজরুল: আচ্ছা, পৃথিবীতে কোন দেশে সরকারের ভেতর সরকার থাকে না? পৃথিবীর সব সরকারের ভেতরে সরকার থাকে, যাকে ‘কিচেন কেবিনেট’ (যাঁদের প্রভাব বেশি) বলা হয়। তবে সরকারের বাইরের কেউ সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রণ করে না।