
সমাজ মোশাররফ করিমকে মেনে নিচ্ছে; কিন্তু আমাকে নিচ্ছে না
আসমা উল হুসনাকে বন্ধুরা চেনে বৃষ্টি নামেই। করতেন মডেলিং, মনে মনে পুষে রেখেছিলেন সিনেমা বানানোর স্বপ্ন। তবে অমিতাভ রেজা চৌধুরীর সিরিজ ‘বোহেমিয়ান ঘোড়া’ দিয়ে নির্মাতার আগে অভিনয়শিল্পী হিসেবেই অভিষেক হয়েছে তাঁর। তরুণ এই অভিনেত্রীর ক্যারিয়ার-ভাবনা শোনা যাক তাঁর ভাষ্যেই।
সাঁওতালি-কন্যা
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব নিয়ে পড়েছি। তবে অভিনয়ের চেয়ে নির্মাণেই আমার ঝোঁক বেশি। মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম আর চলছিল মডেলিং। এর মধ্যেই একদিন অমিতাভ রেজা চৌধুরীর সিরিজে প্রস্তাব পেলাম।
‘বোহেমিয়ান ঘোড়া’য় সাঁওতালি কন্যা ‘প্রথম’-এর চরিত্র। শুরুতেই এমন চ্যালেঞ্জিং চরিত্র। যে জন্য আমাকে তাঁদের জীবনযাপন, উচ্চারণ রপ্ত করতে হবে। এত তাড়াতাড়ি অভিনয় শুরু করব ভাবিনি, তবে এমন একটি সুযোগ পেয়ে কাজে লেগে পড়লাম। শুরুতে সাঁওতাল সম্প্রদায় সম্পর্কে জেনেছি, তাঁরা যেভাবে কথা বলে সেটা রপ্ত করার চেষ্টা করেছি। কারণ, সিরিজে প্রমিত বাংলায় আমার কোনো সংলাপই ছিল না। আগে থিয়েটারের অভিজ্ঞতা থাকায় খুব একটা সমস্যা হয়নি। চরিত্রটির একটি মনস্তাত্ত্বিক দিকও ছিল, প্রথম তাঁর স্বামীকে নিয়ে সংগ্রাম করে। এটা আমাদের চেনা গল্প, ফলে সহজেই নিজের অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণের সঙ্গে মেলাতে পেরেছি।
চরিত্র হয়ে ওঠা
আমাদের অনেক কাজই নায়ক বা নায়িকা–নির্ভর। সেখানে এমন একটি চরিত্র দিয়ে অভিনয় ক্যারিয়ার শুরু করা ব্যতিক্রমই বলতে হবে। ব্যক্তিজীবনে আমি খুবই অন্তর্মুখী, সেখান থেকে অমিতাভ রেজা চৌধুরীর নির্মাণ, মোশাররফ করিমের মতো অভিনেতার সঙ্গে কাজ বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। আমার অংশের শুটিং হয়েছে দিনাজপুর আর সুন্দরবনে। এত বড় টিমের সঙ্গে আউটডোরে শুটিং, এটাও আমার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। সুন্দরবনে শ্বাসমূলে পা বাঁচিয়ে চলা, প্রচণ্ড কষ্ট হলেও কাজের প্রতি নিবেদন ঠিক করা; এই চ্যালেঞ্জগুলো উপভোগ করেছি। মনে হয়েছে, এমন একটা কাজ দিয়ে শুরুটা দরকার ছিল। সেটে এলাম, নায়িকা হিসেবে কিছু শট দিয়ে চলে গেলাম; এর মধ্যে ততটা রোমাঞ্চ নেই। এই সিরিজে কাজ করে অনেক কিছু শিখেছি।
প্রথাগত সৌন্দর্যের বাইরে
সিরিজের চরিত্রটি ছিল প্রথাগত সৌন্দর্যের বাইরে, এটা নিয়ে অনেকে বিদ্রূপ করেছে। কেউ কেউ অবশ্য প্রশংসাও করেছে। কেবল এই সিরিজই নয়, প্রথাগত বিষয়ের বাইরে কিছু হলেই আমরা বুলিংয়ের শিকার হই। ডার্ক স্কিনের এক তরুণীর চরিত্রে অভিনয় করলাম, আমি নিজে প্রচুর কটাক্ষের শিকার হয়েছি। যেসব দর্শক আমাকে পর্দায় দেখে মানতে পারছেন না, তাঁদের উদ্দেশে বলতে চাই—পৃথিবী এখন অনেক বদলে গেছে।
কে কেমন দেখতে সেটা কোনো বিষয়ই না। এখন চরিত্রনির্ভর কাজ হয়, চেহারানির্ভর কাজ থেকে পুরো পৃথিবীই বের হয়ে গেছে। আমাদের সমাজে সবাইকে দাবিয়ে রাখার একটা চেষ্টা কো হয়। কিন্তু কেউ তলিয়ে ভাবে না, আমি যা নিয়ে বিদ্রূপ করছি, সেটা আমার সঙ্গেও হতে পারে। আমাদের চিন্তাভাবনা এখনো ততটা পরিণত নয়। সিনেমার ক্ষেত্রে আমরা বলিউড দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত। সিনেমা মানেই সুন্দর নায়িকা থাকবে, নাচ-গান হবে; কিন্তু সমাজের সব মানুষ তো তথাকথিত সুন্দর নয়। তাদের গল্পও তো উঠে আসা উচিত। আপনি যদি চিন্তা করেন, মোশাররফ করিম ভাইয়ের চেহারাও কিন্তু তথাকথিত নায়কোচিত নয়, তিনি ঠিকই উঠে এসেছেন। কিন্তু আমি মেয়ে বলে আমার জন্য ব্যাপারটা ততটা সহজ নয়। সমাজ মোশাররফ করিমকে মেনে নিচ্ছে; কিন্তু আমাকে নিচ্ছে না। জীবনের নানা পর্যায়ে সমাজের এই বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হয়েছি।