
ভিকটিম উপযোগী রাষ্ট্র গঠনে কী ধরনের প্রস্তুতি প্রয়োজন
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা শুধু অপরাধী দমন নয়, ভিকটিমকে রক্ষা, সেবা ও পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতি দেয়। তাই ধর্ষণ, এসিড-আক্রমণ, পারিবারিক সহিংসতা, যুদ্ধ-নিপীড়ন বা লিঙ্গ-ভিত্তিক বৈষম্যের শিকার যেই হোক-তাদের জন্য একীভূত, সম্মানজনক, মানবিক ও দ্রুত প্রতিক্রিয়ার ব্যবস্থা গড়ে তোলাই রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব।
একবিংশ শতাব্দীতে মানবিক রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত ভিকটিম যেন রাষ্ট্রের বোঝা নয় বরং রাষ্ট্রের অঙ্গ হয়ে পুনর্জন্ম নিতে পারেন। যখন কোনো রাষ্ট্রে ধর্ষণের মতো ঘৃণিত অপরাধ সংঘটিত হয়, তখন সেটি শুধু একজন নারীর ওপর নৃশংস আঘাত নয়- এটি রাষ্ট্র, সমাজ ও মানবিক মূল্যবোধের ওপর সরাসরি প্রশ্নচিহ্ন।
বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে নারীর প্রতি সহিংসতা যখন সংঘটিত হয়-বিশেষ করে ধর্ষণের মতো ভয়ংকর অপরাধ-তখন সেটি শুধু একজন নারীর ওপর শারীরিক-মানসিক আঘাত নয়; এটি গোটা রাষ্ট্র ও সমাজের মানবাধিকারের পরিস্থিতির ব্যর্থতা হিসেবে বিবেচিত হয়। রাষ্ট্রের দায়িত্ব তখন শুধু অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া নয় বরং ভিকটিমকে একটি নিরাপদ, সম্মানজনক ও সহানুভূতিশীল কাঠামোর মাধ্যমে সুরক্ষা দেওয়া।
দুঃখজনক হলো, অনেক ক্ষেত্রে বিচার বিলম্ব, ভিকটিম-ব্লেমিং ও মিডিয়া ট্রায়াল পরিস্থিতিকে আরও সংকটজনক করে তোলে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, একজন ধর্ষণ, এসিড-আক্রমণ, পারিবারিক সহিংসতা অথবা রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের শিকার মানুষের রাষ্ট্রের কাছে মূল প্রত্যাশা হলো—নিরাপত্তা, সম্মান ও ন্যায়বিচার।
ভিকটিমের প্রতি কেমন আচরণ হবে, কীভাবে সে বিচার পাবে, সমাজ তাকে কীভাবে দেখবে—এই প্রশ্নগুলোর উত্তরই নির্ধারণ করে একটি রাষ্ট্রের সভ্যতা ও দায়িত্ববোধ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, অনেক সময় দেখা যায়, বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অমানবিকতা কিংবা মিডিয়ার অসচেতনতা ভিকটিমকে আরও বিপদগ্রস্ত, নিঃস্ব এবং অসহায় করে তোলে।
এই বাস্তবতায়, আজ সময় এসেছে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি আদর্শ রেসপন্স প্রদানের মডিউল গঠনের, যেখানে আইন, চিকিৎসা, মনস্তত্ত্ব, মিডিয়া এবং সমাজ সবাই ভিকটিমের পাশে দাঁড়াবে। আর এ বিষয়গুলো মোটেও লজ্জার নয় বরং মর্যাদার জায়গা থেকে। এই পরিস্থিতির উত্তরণে প্রয়োজন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, অংশীজনভিত্তিক আদর্শ মডিউল, যা রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে দ্রুত ও মানবিক প্রতিক্রিয়ার পথ তৈরি করতে পারে।
জাতিসংঘের UN Women বারবার বলেছে, ধর্ষণের পর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে Survivor-Centered Approach-কে। অর্থাৎ প্রতিটি পদক্ষেপে ভিকটিমের নিরাপত্তা, গোপনীয়তা, মর্যাদা এবং মানসিক অবস্থাকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান।
উদাহরণস্বরূপ, সুইডেন বা নরওয়ের মতো দেশে ধর্ষণের অভিযোগ উঠলেই ভিকটিমের সঙ্গে প্রথম যোগাযোগকারী পুলিশ বা চিকিৎসককে বাধ্যতামূলকভাবে ‘জেন্ডার-সেন্সিটিভ কনসাল্টেশন’ ট্রেনিং থাকতে হয়। এমনকি ফরেনসিক রিপোর্ট তৈরি করার সময়েও ভিকটিমকে পুনরায় ট্রমা না দেওয়ার নির্দেশিকা অনুসরণ করা হয়। বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী ‘Survivor-Centered Justice Model’ এখন যৌন সহিংসতার মোকাবিলায় সবচেয়ে কার্যকর পন্থা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই কাঠামো পাঁচটি মূল স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে। সেগুলো হলো—
(১) জরুরি নিরাপত্তা ও চিকিৎসা:
ভিকটিমের শারীরিক সুরক্ষা, প্রাথমিক চিকিৎসা ও ফরেনসিক প্রমাণ সংগ্রহ করা। UNFPA-এর নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রাথমিক মেডিকেল কেয়ার নিশ্চিত না করলে অনেক প্রমাণই চিরতরে হারিয়ে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) গাইডলাইন অনুযায়ী, প্রতিটি হাসপাতালে ফরেনসিক মেডিকেল এক্সামিনেশন ও প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকতে হবে। এক্ষেত্রে ভিকটিমের সম্মতি ছাড়া কোনো পরীক্ষা করা যাবে না;
(২) আইনি সহায়তা ও দ্রুত বিচার:
ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার পর ভিকটিমের জন্য বিচার প্রাপ্তির পথ দীর্ঘ ও জটিল হলে তা ভিকটিমকে যেমন পুনরায় ট্রমার মুখে ফেলে, তেমনি অপরাধীকেও উৎসাহিত করে। তাই ‘Survivor-Centered Justice Model’ এর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হচ্ছে- আইনি সহায়তা ও দ্রুত বিচার। বিশ্বের অনেক দেশ ইতোমধ্যেই যৌন সহিংসতা সংক্রান্ত মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বিশেষ আদালত প্রতিষ্ঠা করেছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- অপরাধ দমন
- রাষ্ট্র ব্যবস্থা
- ভিকটিম