দেশের ব্যাংক খাতসহ আর্থিক খাত দীর্ঘদিন ধরে ভগ্নদশায় নিমজ্জিত। বিগত সরকারের দুর্নীতি, অর্থ পাচার, লুটপাটে দেশের অর্থনীতি প্রায় ধ্বংস হয়েছিল। ৫ আগস্টের পর অন্তর্বর্তী সরকারের বিশেষ উদ্যোগের ফলে ধীরে ধীরে আর্থিক খাতের কিছুটা উন্নতি লক্ষ করা যাচ্ছে। তবে আরও বেশি দৃশ্যমান উন্নতি আশা করছে জাতি। অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক বর্তমানে দেশের আর্থিক খাতের উন্নতির জন্য বিশেষ কর্মসূচি নিয়ে কাজ করছে। উন্নতিও দৃশ্যমান। তবে আরও দ্রুত উন্নতি প্রয়োজন।
যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে পারছে না এবং যাদের খেলাপি ঋণ অনেক বেশি, সেগুলোর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব এনবিএফআই’র বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, তা জানতে চেয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এর আগে দীর্ঘদিন ধরে সংকটে থাকা, উচ্চ খেলাপি ঋণ ও গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে না পারা বেশ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসব প্রতিষ্ঠানের যে ঋণ রয়েছে, তার বিপরীতে জামানতও খুবই কম। এ অবস্থায় এসব এনবিএফআই’র বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব প্রতিষ্ঠান একীভূত বা অবসায়নের উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে।
আর্থিক খাতের বহুল আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যে অনিয়ম করে গেছেন, তার জের টানতে হচ্ছে পুরো খাতকে। পি কে হালদারের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় ছিল এমন কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানও রয়েছে এ তালিকায়। পি কে হালদার যখন এসব অনিয়ম করেন, তখন তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘনিষ্ঠ এস আলমের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছিলেন। পি কে হালদারের মাধ্যমে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের পর ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোরও একই দশা করেন এস আলম। তাতে পুরো আর্থিক খাতই এখন ধুঁকছে।
সমস্যা কী : কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নথিপত্র থেকে জানা যায়, দেশে মোট এনবিএফআই রয়েছে ৩৫টি। এর মধ্যে ২০টির অবস্থা খুবই নাজুক। গত ডিসেম্বরে এসব প্রতিষ্ঠানের আমানতের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ১২৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক আমানত ১৬ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা এবং ব্যক্তি আমানত ৫ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরে এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণের পরিমাণ ছিল ২৫ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা। এ ঋণের ৮৩ শতাংশই খেলাপি হয়ে পড়েছে, যার পরিমাণ ২১ হাজার ৪৬২ কেটি টাকা। ঋণের বিপরীতে জামানতের পরিমাণ ৬ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা। জামানতের অর্থ দিয়ে ব্যক্তি আমানতকারীর অর্থ ফেরত দেওয়া সম্ভব। সব মিলিয়ে ২০টি প্রতিষ্ঠানের ক্রম পুঞ্জিত ক্ষতির পরিমাণ ২৩ হাজার ৪৪৮ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠান আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে ভালো আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর। এতে পুরো খাতের ওপর আস্থাহীনতা তৈরি হচ্ছে। ভালো প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা ও বাজারে বিরূপ প্রভাব পড়ছে, যা থেকে উত্তরণ প্রয়োজন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, চিহ্নিত ২০টি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বছরে বেতন ১৭২ কোটি টাকা ও এমডিদের বেতন ১২ কোটি টাকা। ভাড়া, অন্য খরচসহ সব মিলিয়ে ব্যয় ২০৬ কোটি টাকা। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত কোনো সুদ আয় নেই। তাই আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠন ও একত্রীকরণের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিস্থিতি আর যাতে খারাপ না হয়, এ জন্য কঠোর তদারকির মধ্যে রাখা হয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠান চলতে পারছে না, সেগুলোর বিষয়ে সামনে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে।
চিঠিতে যা বলা হয়েছে : সংকটে থাকা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠিতে বলা হয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠানে আমানতকারীর দায় পরিশোধে সম্পদের অপর্যাপ্ততা, শ্রেণিকৃত ঋণের উচ্চহার, মূলধন ঘাটতি তথা ন্যূনতম সংরক্ষিতব্য মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থতাসহ নানা বিষয় পরিলক্ষিত হয়েছে। তাই এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাখ্যা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাওয়া হয়। চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, আইন অনুযায়ী কেন প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হবে না, জানাতে হবে।