
অজস্র দাবিদাওয়ার আন্দোলন এবং তার পরিণতি
দৈনিক ‘আমার দেশ’ গত ২৪ জুন লিড নিউজ হিসাবে একটি স্টোরি করেছে। এ স্টোরির শিরোনাম হলো, ‘দাবির বহরে ব্যতিব্যস্ত অন্তর্বর্তী সরকার’। এ স্টোরির ভূমিকায় লেখা হয়েছে, ‘দাবি আদায়ের আন্দোলন সরকারের পিছু ছাড়ছে না কিছুতেই। একের পর এক আন্দোলন মোকাবিলায় ব্যতিব্যস্ত থাকতে হচ্ছে সরকারকে। এক পক্ষ নিবৃত্ত হতেই আরেক পক্ষ আসছে দাবি নিয়ে। বেতন-ভাতা বৃদ্ধি, চাকরি জাতীয়করণসহ নানা দাবিতে লাগাতার আন্দোলন চলতে দেখা যাচ্ছে। এসব দাবির আন্দোলনে প্রায় প্রতিদিনই জাতীয় প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণসহ আশপাশের রাস্তা উত্তপ্ত হতে দেখা যাচ্ছে। সরকারের তরফ থেকে নানা আশ্বাস দেওয়ার পরও দাবি আদায়কারীরা পিছু হঠছেন না। কোনো কোনো পক্ষের দাবি মেনে নেওয়া হলেও তারা নিত্যনতুন দাবি নিয়ে আবার মাঠে নামছে। নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে গত সাড়ে দশ মাসে চার শতাধিক আন্দোলন মোকাবিলা করতে হয়েছে।
আমার মনে হয়, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে বিভিন্ন শ্রেণি, পেশা ও গোষ্ঠী যত রকমের আন্দোলন করেছে, অতীতে কোনো সরকারের আমলে এত অল্প সময়ের ব্যবধানে এত রকমের দাবি দাওয়ার আন্দোলন হয়নি। ব্যাপারটা অনেকটাই রহস্যজনক মনে হয়। শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে এর ১০ ভাগের এক ভাগ আন্দোলন হয়েছিল কিনা সন্দেহ আছে। সেই সময় আন্দোলনকারীরা খুব বেশিদূর এগোতে পারত না। সরকারের পুলিশ বাহিনী অত্যন্ত কঠোর হস্তে আন্দোলনগুলো প্রতিহত করত। এসব আন্দোলন প্রতিহত করার কাজে শাসক দলের মাস্তানরাও পুলিশের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আন্দোলনকারীদের ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করে দিত। মাস্তানদের এই বাহিনী হেলমেট বাহিনী নামে কুখ্যাত হয়ে উঠেছিল। শেখ হাসিনার শাসনামলে বড় ধরনের কয়েকটি আন্দোলন হয়েছিল। প্রতিটি আন্দোলনই হয় নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হয়েছে অথবা কৌশলের ফাঁদ পেতে আন্দোলনকে এগোতে দেওয়া হয়নি। ওই শাসনামলে হেফাজতের শাপলা চত্বরের আন্দোলন বুলেট, টিয়ার গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড মেরে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়। শাপলা চত্বরের সমাবেশে কত লোক নিহত হয়েছে, তা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। বিভিন্ন সূত্র বিভিন্ন পরিসংখ্যান দিয়েছে। তবে প্রকৃত অর্থে কত লোক নিহত হয়েছে, তা বোধহয় কখনোই জানা যাবে না। শাপলা চত্বরে আলো নিভিয়ে চরম নিষ্ঠুরতায় আন্দোলনকারীদের হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে হটিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীকালে সরকারবিরোধী কওমি আলেমদের বাগে আনতে শেখ হাসিনার সরকার কোটি কোটি টাকা ছিটিয়েছে। দুঃখের বিষয় হলো, আলেমদের একটি অংশ টাকার লোভে আত্মসমর্পণ করেছে। শুধু তাই নয়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান করে শেখ হাসিনাকে ‘কওমি জননী’ উপাধি দিয়েছে। বোঝা যায়, ধার্মিক মানুষদের যদি স্খলন ঘটে তাহলে সেই স্খলনের সীমা-পরিসীমা থাকে না। কওমি আলেমদের একাংশের ক্ষেত্রে তাই ঘটেছিল। অন্যদিকে আলেমদের অন্য একটি অংশ, যারা আপস করেনি, তাদেরকে জেল-জুলুম ও ভয়াবহ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। হেফাজতের অন্যতম নেতা জুনায়েদ বাবু নগরীকে কারাবাস ও জিজ্ঞাসাবাদের নামে চরম দৈহিক নির্যাতনের কবলে পড়তে হয়েছে। কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পর বাবু নগরী বেশিদিন বেঁচে থাকেননি। হেফাজতের শাপলা চত্বর আন্দোলন দমনের গর্হিত কলাকৌশল এদেশের আন্দোলনের ইতিহাসে এক ভয়ংকর দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
ছাত্রদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন দমনেও কূটকৌশলের আশ্রয় নেওয়া হয়েছিল। স্কুল-কলেজের কোমলমতি ছাত্রদের বিরুদ্ধে হেলমেট বাহিনী ত্রাস সৃষ্টি করেছিল। সর্বশেষ কোটা সংস্কার আন্দোলন, যা পরবর্তী সময়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রূপ পায়, সেই আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দিতে সরকারপন্থি ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের গুন্ডা-মস্তান বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের বেধড়ক মারধর করে। বহু ছাত্রছাত্রী আহত হয় এবং আবাসিক ছাত্রছাত্রীদের হল ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়। ছাত্রলীগের এই চন্ড দমন নীতি বুমেরাং হয়ে গিয়েছিল। অচিরেই ছাত্রছাত্রীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ছাত্রলীগের গুন্ডা, মাস্তান ও সমর্থকদের তাড়া করে। ছাত্রলীগ টের পায় ছাত্র-জনতার ঐক্যের শক্তি কত দুর্জয় হয়ে উঠতে পারে। এমনই এক পরিস্থিতিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্তব্য করলেন, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা চাকরি পাবে না, চাকরি পাবে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা? আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে শেখ হাসিনার এ আপত্তিকর ও অপমানজনক উক্তি আগুনে ঘি ঢালার শামিল হলো। আন্দোলনে সূচিত হলো নতুন এক পর্যায়। এ পর্যায়ে শুধু ছাত্রছাত্রী নয়, সাধারণ মানুষও মরণপণ বাজি রেখে আন্দোলনে শামিল হলেন এবং আন্দোলন চূড়ান্ত পরিণতিতে ৫ আগস্ট ২০২৫ বিশাল গণ-অভ্যুত্থানের রূপ নেয়, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা ছেড়ে প্রভুর দেশ ভারতে পালিয়ে যেতে হয়।
শেখ হাসিনার শাসনামলে জনগণের বিক্ষোভ-সংগ্রামকে যেভাবে মোকাবিলা করতে হয়েছে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে সেই পদ্ধতি অবলম্বন সম্ভব নয়। কারণ এ সরকার একটি ভালো গণতন্ত্রের উত্তরণের জন্য সহায়ক শক্তির ভূমিকা পালন করতে চায়। এ সরকার প্রচলিত অর্থে রাজনৈতিক সরকার নয়। তাই এ সরকারের পক্ষে দমন-পীড়নের পথে দাবি দাওয়ার আন্দোলন প্রতিহত করার প্রয়াস নেওয়া সম্ভব নয়। এখানেই এ সরকারের উভয় সংকট। একদিকে মানুষের দাবি দাওয়ার আন্দোলনের প্রতি সংবেদনশীল হতে হবে, অন্যদিকে জনজীবনে স্বস্তি, শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখতে হবে। এ দুয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে এক অতি দুরূহ কাজ। এমন বিশেষ পরিস্থিতিতে বর্তমান সরকারের মতো একটি অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে কর্মকাণ্ডের সীমারেখা নির্ধারণ এক অতি দুরূহ কাজ।
এমন কোনো দিন নেই রাজধানী ঢাকায় এক বা একাধিক পক্ষ রাজপথে নামে না। আন্দোলনকারীরা সড়কে অবস্থান করে অবরোধ সৃষ্টি করে। যানজটের শহর ঢাকায় যান চলাচল স্তব্ধ হয়ে যায়। শত-সহস্র নাগরিক প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সারতে ব্যর্থ হন। যানজটের মধ্যে যানবাহনগুলো স্থবির হয়ে যায়। মানুষ মহা দুর্ভোগে পড়ে ত্যক্তবিরক্ত হয়ে ওঠে এবং সরকারের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে প্রচণ্ড সমালোচনা করে। শুধু বিভিন্ন শ্রেণিপেশার আন্দোলন নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো, এমনকি হাসপাতালগুলোও আন্দোলন বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ফলে অচল হয়ে পড়ে। সাতে-পাঁচে নেই, এমন সব মানুষ মন্তব্য করে, হাসিনার আমলে এতসব আন্দোলন কোথায় ছিল? কাউকে তো টুঁ শব্দও করতে দেখিনি। গণতান্ত্রিক অধিকারের এমন বেপরোয়া চর্চা গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎকে শঙ্কাপূর্ণ করে তোলে। প্রশ্ন জাগে, এমন মানসিকতা অব্যাহত থাকলে অন্তর্বর্তী সরকারের পর যে নির্বাচিত সরকার আসবে, তার পক্ষে দেশ পরিচালনা অত্যন্ত কঠিন হয়ে যাবে। মানুষ একবার বিশৃঙ্খল হয়ে উঠলে তাকে শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব। তাই আগামী দিনগুলোতে নৈরাজ্য আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে বলে মনে করতে চাই। এই অবস্থার সমাধান কীভাবে হবে, তা আমাদের কারও জানা নেই।