
‘বেশি কিছু আশা করা ভুল’!
মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন সরকার যে পরিস্থিতিতে দেশের দায়িত্ব নিয়েছে, সেটা বিবেচনায় নিয়েই তাদের বাজেটের ওপর আলোচনা করা উচিত। তারা দলীয় রাজনৈতিক সরকার নয়; আগেকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারও নয়। তাদেরকে বলা হচ্ছে ‘অন্তর্বর্তী সরকার’। এ সরকার আবার এক-এগারোর অন্তর্বর্তী সরকারের মতোও নয়। দুইয়ের প্রেক্ষাপট আলাদা; চরিত্রও পৃথক। গণঅভ্যুত্থানে যে দলটি কার্যত পলাতক, তাদের বাদ দিলে আর যেসব রাজনৈতিক দল থাকে– ইউনূস সরকার হলো তাদের সরকার। অন্তত তাত্ত্বিকভাবে।
সে কারণেই এ সরকারের উচিত ছিল বাজেট প্রদানের আগে অন্তত তাদের মনোনয়ন দানকারী দলগুলোর সঙ্গে কথা বলে নেওয়া। সেটা হয়নি। গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী দলগুলোও দাবি করে বলেনি, তাদের মনোভাব জেনেই বাজেট প্রণয়নে হাত দিতে হবে। বাজেট পেশের পর অবশ্য তারা কথা বলতে শুরু করেছে।
এখন যেহেতু সংসদ নেই, তাই ‘বিশেষ পরিস্থিতি’তে আগে যেভাবে বাজেট দেওয়া হতো, সেভাবেই কাজটা হয়েছে। এতে তেমন কোনো সমস্যা অবশ্য নেই। আমরা জানি, সংসদ থাকাকালে বাজেট অধিবেশনে কী মানের আলোচনা হতো। একটা সময় পর থেকে তো সংসদে সত্যিকারের বিরোধী দলও ছিল না। বিরোধী দল নিজেও বুঝতে পারতো না– তারা সরকারি না বিরোধী দল!
সেইসব দিন গত হয়েছে। এ আশাতেই এখন থাকব যে, কোনো অবস্থাতেই সেইসব দিন আর ফিরে আসবে না। আশা করব, দ্রুতই নির্বাচন হবে এবং সেটা ‘নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন’ হবে না। কেননা এতে ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ জন্ম নিয়ে থাকে। এ আশাও করব, ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরা ‘অর্থবিল’ পাসে একতাবদ্ধ থাকলেও অর্থবহ বাজেট আলোচনায় অংশ নেবেন। বিরোধী দলও যুক্তিপূর্ণভাবে বাজেটের নানা দিক নিয়ে মত দেবে।
কথা হলো, সেটি ঘটার আগে কী হবে? সংসদের অনুপস্থিতিতে যে বাজেট দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে মানসম্মত আলোচনা কি হবে রাজনৈতিক দলসহ সংশ্লিষ্ট মহলে? ব্যবসায়ীসহ যাদের নিজস্ব ফোরাম আছে, তারা তো নিজ স্বার্থেই কথাবার্তা বলবেন। দেন-দরবারও করবেন। দলীয় রাজনৈতিক সরকার থাকাকালেও এসব ঘটে থাকে। বিভিন্ন ব্যবসায়ী মহলের অঘোষিত প্রতিনিধি হিসেবেও কিছু সংসদ সদস্য কাজ করেন।
সংসদে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের ভেতর থেকে উঠে আসাটাও বেড়েছে অনেক। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো সেটা মেনেও নিয়েছে। সেইসব দলের একটি অবশ্য এ মুহূর্তে দেশে প্রায় অনুপস্থিত। তাদের কার্যক্রমও নিষিদ্ধ। এ অবস্থায় যারা মাঠে রয়েছে, তাদের মধ্যে যে দলটির নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা উজ্জ্বল, তারা পেশকৃত বাজেট নিয়ে কী ভাবছে– এটা সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তাদের বক্তব্য এ কারণেও গুরুত্বপূর্ণ যে, চলতি বছর ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হওয়ার জোর সম্ভাবনা রয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের বড় অংশীজন সেনাবাহিনীর তরফ থেকেও ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রত্যাশার কথা সবার জানা।
ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হলে আলোচ্য বাজেটের ৫০ শতাংশ বাস্তবায়ন করবে নতুন নির্বাচিত সরকার। সেই সরকার কি এটাকে নির্দ্বিধায় নিয়ে বাস্তবায়ন করবে? এমনিতেও ছ’মাস পর একই সরকারকে বলা হয় বাজেট ‘পর্যালোচনা’ করতে। তিন মাস পরপরও এটা করতে বলা হচ্ছে। এতে বাজেট পরিশুদ্ধ হয়ে ভালোভাবে বাস্তবায়িত হওয়ার সুযোগ বাড়ে।
আর নতুন সরকার এলে তো স্বভাবতই চাইবে অন্যের দেওয়া বাজেটটির নিবিড় পর্যালোচনা করতে। এর আগে এক-এগারো সরকারের দেওয়া দ্বিতীয় বাজেট নিয়ে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ফখরুদ্দীন সরকারের দেওয়া বাজেট বাস্তবায়ন করেছিল অর্থবছরের বাকি ছ’মাসে। একথা অবশ্য ঠিক, প্রচলিত কাঠামোয় বাজেট দেওয়া হলে উত্তরাধিকার সূত্রে সেটার বাস্তবায়নে বিশেষ সমস্যা হওয়ার কথা নয়। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ তেমন বাজেট দিয়ে থাকলে এবং নতুন সরকারকে তার অর্ধেকটা বাস্তবায়ন করতে হলে সেটাই হওয়ার কথা। তবে পরবর্তী বছরের জুন পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকার থাকলে পুরো অর্থবছরই তারা পাবে। বাজেটের পুরোটা সেক্ষেত্রে তাদের হাতেই বাস্তবায়িত হবে।