অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে কার্যত একটি অপ্রিয় বিতর্কে জড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে বিএনপি। জাপান সফরে গিয়ে ২৯ মে এক বক্তৃতা শেষে প্রশ্নোত্তর পর্বে ড. ইউনূস বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন, একটি মাত্র দল ডিসেম্বরে নির্বাচন চায়। প্রধান উপদেষ্টার এই বক্তব্যে স্বাভাবিকভাবেই বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে, তারা বেশ নাখোশ।
বিএনপির একজন জ্যেষ্ঠ নেতা মির্জা আব্বাসের বক্তব্যে সেই বিরূপতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। ৩০ মে সকালে শেরেবাংলা নগরে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তার সমাধিতে শ্রদ্ধা জানানোর পর তিনি বলেন, একজন ব্যক্তিই শুধু ডিসেম্বরে নির্বাচন চান না, তিনি হলেন ড. ইউনূস!
রাজনীতিতে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য আমাদের দেশে নতুন কোনো ঘটনা নয়। তবে বর্তমান পরিস্থিতিটা স্বাভাবিক নয়, দেশের রাজনীতিতেও স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে না।
ড. ইউনূস কোনো রাজনীতিবিদ নন। তার রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ থাকতে পারে কিন্তু তিনি ঠিক পোড় খাওয়া রাজনীতিক বলতে যা বোঝায় তা নন। একবার রাজনীতির মাঠে নামার প্রস্তুতি নিয়েও শেষপর্যন্ত নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। আর গত বছর অগাস্টে এক বিশেষ পটভূমিতে তিনি সরকার প্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার পর রাজনীতি তাকে আঁকড়ে ধরেছে।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে সরকার গঠিত হয়েছে, সেই সরকার কোনো স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার সরকার নয়। এই সরকারের মেয়াদকাল নিয়েও কোনো স্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে বিএনপির মতো অনেকেই এটাই ধরে নিয়েছিল যে দ্রুততম সময়ের মধ্যে দেশে নির্বাচনের আয়োজন করে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা দিয়ে মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার বিদায় নেবে। যদিও অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকার শুরু থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলে আসছে। সরকারের কাছে জুলাই অভ্যুত্থানের নেতাদের গঠিত নতুন দল এনসিপির দাবির মধ্যে সংস্কারের সঙ্গে আওয়ামী লীগের বিচারের বিষয়টিও যুক্ত রয়েছে। তারা চায় এই সবকিছুর পর হবে নির্বাচন।
বাংলাদেশের রাজনীতি বরাবরই একটি দোলাচলের মধ্যে থাকে—যেখানে ক্ষমতার লড়াই, আদর্শের মুখোমুখি অবস্থান এবং আন্তর্জাতিক স্বার্থের টানাপোড়েন এক সুতোয় গাঁথা। এবার এই দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছেন একজন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব মুহাম্মদ ইউনূস। তার বক্তব্য, তার অবস্থান এবং তাকে ঘিরে সরকার ও বিরোধী দলের পাল্টাপাল্টি প্রতিক্রিয়া যেন প্রকাশ করে দিয়েছে বাংলাদেশের গভীর রাজনৈতিক সংকট, একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার সঙ্গে একটি ব্যক্তির অবস্থান কীভাবে জাতীয় বিতর্কে পরিণত হয়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেছেন, ‘দেশের মাত্র একজন ব্যক্তিই ডিসেম্বরের মধ্যে সংসদ নির্বাচন চান না, তিনি ড. ইউনূস।’ তিনি এই বক্তব্য দেন এমন এক সময়, যখন জাতির চোখ ভবিষ্যতের নির্বাচন ঘিরে তৈরি হওয়া দোলাচলে স্থির হয়ে আছে। ড. ইউনূস টোকিওতে ৩০তম নিক্কেই ফোরাম: ‘ফিউচার অব এশিয়া’র উদ্বোধনী অধিবেশনে বলেছিলেন, ‘দেশের কেবল একটি দল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়’ এবং ‘দেশের মাত্র একজন ব্যক্তিই ডিসেম্বরের মধ্যে সংসদ নির্বাচন চান না, তিনি ড. ইউনূস’ বক্তব্যে দুটি অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। এনসিপি তো স্পষ্ট করে বলছে, সংস্কার, বিচার ইত্যাদি শেষে তারা নির্বাচন চায়। নির্বাচন নিয়ে তাড়াহুড়ো নেই জামায়াতে ইসলামীরও। তবে ডিসেম্বরে নির্বাচন চাওয়াদের দলে কিন্তু বিএনপির সঙ্গে বিএনপির সমমনারাও রয়েছে, দল হিসেবে যাদের গুরুত্ব খুব একটা নেই। তবে মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের ইঙ্গিত রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। সরকারের প্রধান উপদেষ্টার মুখ থেকে বের হওয়ায় এ বক্তব্যের ওজন এবং তাৎপর্যও বহুগুণ বেড়ে গেছে।