
বিলম্বিত শুভ বড় অশুভ হয়ে যায়
সম্প্রতি বিমানবন্দরে অভিনেত্রী নুসরাত ফারিয়ার গ্রেপ্তার নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্নের উদয় হয়েছে। মামলার নথিপত্র প্রকাশ হওয়ায় বিষয়টি আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। হত্যাচেষ্টাটি হয়েছে ১৯ জুলাই, ২০২৪ আর মামলাটি হয়েছে ২০২৫ সালের ৩ মে। একটি হত্যাচেষ্টা মামলা এত বিলম্বে করা যায় কি না, তা অবশ্য আইনি প্রক্রিয়ার বিষয়। এর আগে অবশ্য আইন উপদেষ্টা এবং পুলিশের মহাপরিদর্শক বলেছিলেন, এভাবে মামলা করলেই হবে না, তদন্ত সাপেক্ষে মামলা গ্রহণ করা হবে। রাষ্ট্রের এই দুজন বড় কর্তাও জানেন এসব মামলা হয়রানিমূলক।
নুসরাত ফারিয়া বিদেশে যাচ্ছিলেন, বিমানবন্দর ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তাঁর বিদেশযাত্রা বন্ধ করে এবং গ্রেপ্তার করে আদালতে চালান দিয়ে দেয়। হত্যাচেষ্টার ওই সময়ে যে তিনি বিদেশে ছিলেন, এটা পাসপোর্ট এবং ভিসার প্রমাণসহ আদালতে জমা দেন। এবার বাদীপক্ষের উকিল হত্যাচেষ্টার বাইরেও কিছু কথা বলেন। তা হলো, নুসরাত ফারিয়া শেখ হাসিনার কিছু গুণকীর্তন করেছেন এবং একটা পর্যায়ে অভিনেত্রীকে ওই উকিল ‘নর্তকী’ বলে আখ্যা দেন। প্রশ্ন ওঠে, শেখ হাসিনার গুণকীর্তন নাকি হত্যাচেষ্টা—কোনটা মুখ্য? নুসরাত কী কারণে হত্যাচেষ্টা করতে যাবেন? এত সব প্রশ্ন থাকা সত্ত্বেও আইন উপদেষ্টা একজন শিক্ষক হয়েও এই কথাটা এত দিন ধরে খোলা রেখেছেন কেন? এটি শুধু প্রশ্ন নয়, তার চেয়েও বড় কিছু।
এবার আমার প্রসঙ্গে আসি। নুসরাতের সঙ্গে আমার বিষয়টিও আলোচনার অপেক্ষা রাখে। আমিও ৩০ এপ্রিল, ২০২৫ রাতে ঢাকা বিমানবন্দর হয়ে বিদেশে যাওয়ার জন্য উপস্থিত হই। আমার পাসপোর্ট হাতে নিয়ে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা কিছুক্ষণ বিলম্ব করেন। আমি অবাক বিস্ময়ে অপেক্ষা করি। কারণ ৫ আগস্টের পর আমি দুইবার মুম্বাই ও একবার নেপালে যাই; মুম্বাই শুটিংয়ের কাজে আর নেপালে একটি সাংস্কৃতিক উৎসবে অংশ নিতে। কোথাও কোনো হয়রানির শিকার হতে হয়নি। যাহোক, ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা কিছুক্ষণ পর সসম্মানে পাসপোর্ট ফেরত দিয়ে দেন এবং যথাসময়েই আমি বিমানে আরোহণ করি।
আমি কিছুদিন যাবৎই অসুস্থ। বিশেষ করে, নেপালে গিয়ে ঠান্ডা লাগায় খুবই কাশি হচ্ছিল। চিকিৎসাও করাচ্ছিলাম। ৩০ তারিখের যাত্রায় দোহায় বিমান পরিবর্তন করে ওঠার পর থেকে শরীরটা আরও খারাপ অনুভূত হচ্ছিল। তখনো গন্তব্যে পৌঁছাতে ১৬ ঘণ্টা বাকি। যতই সময় পার হচ্ছিল, ততই শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছিলাম। খেতেও পারছিলাম না, কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছিল। কাতার এয়ারলাইনসের ক্রুরা নানাভাবে চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। বহু কষ্টে ডালাস বিমানবন্দরে পৌঁছার পর দেখলাম এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষ আমার জন্য অ্যাম্বুলেন্স তৈরি করে রেখেছে। সরাসরি চলে গেলাম হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা গেল আমার ডবল নিউমোনিয়া হয়েছে। সঙ্গে সেপসিস হয়েছে (রক্তের ভেতর সংক্রমণ ঢুকে যায়)। সেই থেকে সাত দিন আমাকে আইসিইউতে রেখে নিবিড় পরিচর্যার ব্যবস্থা করা হয়।
হাসপাতালে থাকা অবস্থায়ই সম্ভবত তৃতীয় দিন জানতে পারি, আমার নামেও একটি হত্যাচেষ্টা মামলা হয়েছে, একই সময়ের ঘটনা, গত জুলাইয়ের। সম্ভবত আমার মামলাটিও নুসরাত ফারিয়ার মামলার কাছাকাছি সময়ে করা। আমিও নুসরাতের মতো জুলাইতে দেশের বাইরে ছিলাম। পাসপোর্টের অ্যারাইভাল ও ডিপারচার সিল তার সাক্ষ্য দেবে। এই মামলায় আমার সঙ্গে আবার চঞ্চল চৌধুরী ও রিয়াজকে আসামি করা হয়েছে। যদি মামলাটি ৩০ তারিখেই হতো এবং বিমানবন্দরে কাগজ চলে আসত, তাহলে নুসরাতের মতো আমাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গিয়ে বিনা চিকিৎসায় ফেলে রেখে দিত। এবং যেখানে আইসিইউ প্রয়োজন সেখানে হাজতনিবাসেই আমার হয়তো বিচারটি হয়ে যেত। যারা আমাদের পথের কাঁটা মনে করে, তাদের জন্য একটা স্বস্তির নিশ্বাস দেখতে পাওয়া যেত। নুসরাতসহ অনেকেরই রাত-দিন হয়তো আমার মতো একই রকম হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, শিল্পীদের ওপর এত ক্ষোভ কেন? শিল্পীরা কি জাতির মর্যাদা ক্ষুণ্ন করেছে নাকি আলোকিত করেছে? ৫৩ বছর যাবৎ একেবারে শূন্য থেকে থিয়েটার আন্দোলনকে কোথায় এনেছি আমরা! দেশ-বিদেশ থেকে কত সম্মান আমরা নিয়ে এসেছি। আমাদের কর্তব্যনিষ্ঠার ফলে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিভাগ স্থাপিত হয়েছে। সারা দেশে নাট্যমঞ্চ স্থাপিত হয়েছে। এ সবকিছুই আমরা করেছি কোনো অর্থ ছাড়া, বিনা পারিশ্রমিকে। ওই আগস্টের পর সবাই আমরা ভেবেছিলাম একটা সাময়িক সমঝোতা হওয়া প্রয়োজন।